Home গল্প সুরা কাহাফের যুবকদল

সুরা কাহাফের যুবকদল

by Jafor Salah
0 comment

আরিফ আজাদ: সুরা কাহাফের যুবকদল, যাদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন সুদীর্ঘকাল, একদিন তাদের ঘুম ভাঙে এবং ঘুম ভাঙার পর তাদের প্রচন্ড খিদে পেয়ে যায়। তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে লোকালয়ে পাঠায় খাবার কিনে আনবার জন্যে। যখন তাদের একজন খাবার কিনতে যাচ্ছিলো, তখন দলের অন্যরা একটা সতর্কবাণী তাকে শুনিয়ে দিয়েছিলো সাথে সাথে। সেই সতর্কবাণীটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কুরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
‘সে যেন খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করে এবং তোমাদের ব্যাপারে লোকালয়ের কেউ যেন টের পেয়ে না যায়। তারা যদি টের পেয়ে যায় তাহলে তোমাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করবে অথবা তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাদের ধর্মে। (যদি তা হয়) তাহলে তোমরা কোনোভাবেই সফলকাম হতে পারবে না’- সুরা কাহাফ ১৯-২০
আসল ঘটনা হচ্ছে— এতো দীর্ঘকাল যে ঘুমের মাঝে কেটে গেছে সেটা যুবকদল বুঝতে পারেনি। ঘুম থেকে জাগার পর তাদের মনে হলো, তারা বোধকরি একদিন কিংবা একটা দিনের কিছু অংশ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কেবল।
তারা একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে লোকালয় থেকে পালিয়েছিলো একদিন। তাদের জনপদের সবাই যখন আল্লাহকে ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন ইলাহের উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়লো, যখন আল্লাহর দ্বীন থেকে তারা পুরোপুরি ছিটকে পড়লো, তখন নিজেদের ঈমান বাঁচাতে যুবকদল আশ্রয় নিয়েছিলো একটা গুহার মধ্যে। তারা ভেবেছিলো— জনপদে অবস্থান করলে সেখানকার বিভ্রান্ত লোকগুলো তাদের বাধ্য করবে ধর্ম পরিবর্তন করতে। বিভ্রান্তদের মাঝে অবস্থান করে নিজেদের ঈমান সংকটে ফেলবার চাইতে তারা বেছে নিয়েছিলো স্বেচ্ছা নির্বাসন।
ঈমান বাঁচাতে তারা এক-কদম পা বাড়ালো, আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাদের জন্য এগিয়ে আসলেন এক ক্রোশ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এমন উপায়ে তাদেরকে নিরাপত্তা দিলেন যে— কীভাবে তারা নিরাপত্তা লাভ করলো সে বিষয়ে তারা নিজেরাও ওয়াকিবহাল ছিলো না।
সুতরাং, এক সুদীর্ঘকালের ঘুম-যাত্রা সমাপ্ত করে যে সদ্যই জেগেছে তারা, সেটা তাদের কাছে অজানা। তারা ধরে নিয়েছিলো অন্যান্য দিনের মতো একটা স্বাভাবিক ঘুম থেকেই হয়তো তারা জেগে উঠেছে।
যেহেতু ঘুমটাকে তারা অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের ঘুমের মতোই ভেবেছিলো, তারা মনে করলো— জনপদে এখনও সেই অত্যাচারী রাজা, সেই বিভ্রান্ত, বিচ্যুত জনগোষ্ঠীরা রয়ে গেছে। সুতরাং, খাবার কিনতে গেলে সাবধানে কিনতে হবে, পাছে না আবার লোকেরা তাদের সম্পর্কে জেনে যায়। জেনে গেলে তো বিপদ! তাদেরকে হয় পাথর-নিক্ষেপে হত্যা করবে অথবা ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নতুন ধর্মে।
তাই, খাবার কিনতে যাওয়া সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে একজন বললো, ‘সে যেন খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করে এবং তোমাদের ব্যাপারে লোকালয়ের কেউ যেন টের পেয়ে না যায়।’
খেয়াল করুন— এখানে যুবকদলের জ্ঞান কিন্তু এতোটুকুই যে— তারা একটা স্বাভাবিক ঘুম থেকে জেগেছে এবং খাবার কিনতে গেলে তাদের ধরা পড়ে যাওয়ার একটা ভয় আছে। সেই জ্ঞান অনুযায়ীই তারা একটা পরিকল্পনা সাজালো। পরিকল্পনাটা হলো— খুব সাবধানতার সাথে, বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে লোকালয়ে খাবার কিনতে যেতে হবে যাতে লোকালয়ের মানুষের নজরও এড়ানো যায় এবং খাবারও কেনা যায়। এতে করে দুইটা উপকার:
১. নির্বিঘ্নে খাবার কেনা হবে।
২. তাদের কেউ চিনতে পারবে না।
শুধু তাই নয়, দুইটা সংকটও এড়ানো যাবে:
১. মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা।
২. ঈমানের হেফাযত।
তাদের জ্ঞান যতোটুকু, ততোটুকু অনুযায়ী তারা তাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো। কিন্তু, আল্লাহর জ্ঞান তো তাদের মতো সীমাবদ্ধ নয়। তারা যে সুদীর্ঘকাল ঘুমিয়ে কাটালো, সেটা তো আল্লাহর জ্ঞান আর পরিকল্পনারই অংশ। যুবকদল তাদের জ্ঞান অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজালো ঠিক, কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন।
যুবকদল জানতো না যে, তারা যে সময়ের মানুষ, সে সময়টা অতীত হয়েছে। সেই অত্যাচারী রাজা, সেই বিভ্রান্ত সম্প্রদায় আর বর্তমান নেই। তারা না জানতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তো জানেন। তাই আল্লাহর পরিকল্পনা তাদের পরিকল্পনার চাইতে ভিন্ন ছিলো।
কী ছিলো আল্লাহর পরিকল্পনা? কুরআন বলছে,
‘এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত দিবস নিয়ে কোন সন্দেহ নেই’- সুরা আল-কাহাফ ২১
যুবকদলের পরিকল্পনা ছিলো তারা মানুষের নজর এড়িয়ে থাকবে, তাদের পরিচয় গোপন রাখবে এবং সে মোতাবেকই তারা তাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা তাদের মতো ছিলো না। তিনি বরং তাদেরকে মানুষের নজরে আনতে চাইলেন এবং প্রকাশ করে দিতে চাইলেন তাদের গোপনীয়তা। আর আল্লাহ যা চান তা-ই হয়। যুবকদলের পরিচয় সবার মাঝে প্রকাশ পেয়ে গেলো।
অত্যাচারী রাজা আর সম্প্রদায়ের ভয়ে যুবকদল নিজেদের ঈমান বাঁচাতে লুকিয়ে থাকতে চাইলো, কিন্তু সেই রাজা আর সম্প্রদায় যে গত হয়েছে, সেই জ্ঞান তাদের কাছে নেই। তাই তাদের পরিকল্পনা হলো একরকম।
অত্যাচারী রাজা এবং ওই সম্প্রদায় যে গত হয়েছে, এবং যুবকদলের সামনে যে আর কোন সংকটকাল নেই, সেই জ্ঞান তো আল্লাহর কাছেই আছে। তাই আল্লাহর পরিকল্পনা হলো তাদের চাইতে ভিন্নতর।
এই যে যুবকদলের পরিকল্পনার সাথে আল্লাহর পরিকল্পনা মিললো না, এখান থেকে আমাদের শিখবার কী আছে?
এখান থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হলো— আমাদেরকে আমাদের চেষ্টাটুকু সর্বদা করে যেতে হবে। যে জ্ঞান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাদের দান করেছেন তা দ্বারা জীবনের পরিকল্পনা আমাদের সাজাতে হবে। কিন্তু, যেহেতু আমাদের জ্ঞান পরিপূর্ণ নয় এবং সৃষ্টির সকল রহস্য আমরা জানি না, আমরা ভবিষ্যত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই, সেহেতু আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে— আমাদের চিন্তার বাইরেও চিন্তা, আমাদের পরিকল্পনার বাইরেও পরিকল্পনা থাকতে পারে। আমাদের জীবন নিয়ে কেবল আমরাই পরিকল্পনা করি না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালাও আমাদের জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করেন। আমাদের পরিকল্পনাগুলো যেহেতু আমাদের সীমিত জ্ঞান আর সীমিত চিন্তা থেকে হয়, তাই সেগুলো সর্বদা যে ভালো আর পরিপূর্ণ হবে, তা নয়। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যে পরিকল্পনা আমাদের নিয়ে করেন, তা নিঃসন্দেহে পরিপূর্ণ এবং কল্যাণকর।
তাই, আমাদের কোন পরিকল্পনাকে ব্যর্থ হতে দেখলে আমরা কখনোই হতাশ হবো না। আসহাবে কাহাফের যুবকদল চেয়েছিলো গোপন থাকতে, কিন্তু আল্লাহ তাদের প্রকাশ করে দিলেন। স্পষ্টতই তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো। এতে কি তারা হতাশ হয়ে পড়েছিলো? একদমই না।
তারা জানতো— তাদের পরিকল্পনা নয়, আল্লাহর পরিকল্পনাই পরিপূর্ণ। তাদের কাজ কেবল চেষ্টা করে যাওয়া আর তারা তাই করেছে। বাকিটা তো আল্লাহ যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই হলো আর সেটাই ছিলো তাদের জন্য কল্যাণকর।
আমরাও জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করবো। চেষ্টা করবো। কিন্তু, এটা ভাববো না যে— আমার চাওয়া মতোই সবকিছু হতে হবে। আমার সীমিত জ্ঞান দিয়ে আমি যা চাচ্ছি, সেটা আমার জন্য কল্যাণের না-ও হতে পারে। আমার জন্য কোনটা কল্যাণের, সেই জ্ঞান কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার কাছেই আছে। তাই, আমি আমার পক্ষ থেকে চেষ্টাটুকু করে, বাকিটার জন্যে আল্লাহর ওপরে তাওয়াক্কুল করবো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যে ফলাফলই আমার জন্য বাছাই করবেন, আমি মেনে নেবো যে— ওটাই আমার জন্য কল্যাণের যদিও আমার সীমিত জ্ঞান আর চিন্তা তা বুঝতে অপারগ।
আমার কাহাফ ভাবনা-০৮

You may also like