Home ইসলাম রোযার ফযীলত ও নিয়ম-কানুন এবং করণীয়-বর্জনীয় বিষয়

রোযার ফযীলত ও নিয়ম-কানুন এবং করণীয়-বর্জনীয় বিষয়

by admin
0 comment

রোযার ফযীলত ও নিয়ম-কানুন এবং করণীয়-বর্জনীয় বিষয়
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমযান। ইসলাম যে পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠতি তার একটি হল রোযা বা সিয়াম পালন। এ রোযা বা সিয়াম জান্নাত লাভের একটি মাধ্যম; যেমন হাদীসে এসেছে যে, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রমযান মাসে, আল্লাহতায়ালার কর্তব্য হল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো’। (সহীহ আল বুখারী)
অজ¯্র-অফুরন্ত কল্যাণের এক মহাভা-ার রমযান মাস। রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহান সওগাত নিয়ে প্রতি বছর এ মাস আমাদের মাঝে হাজির হয়। রমযান মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক নিয়ামত বিশেষ। সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া, জীবনমান উন্নত করা, আত্মগঠন ও উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠন এবং নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর সমাজ গঠন করা এ মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব। এ মাস পরিশুদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ লাভের মাস। একজন মানুষকে গুনাহ মুক্ত করে মুত্তাকী তথা খোদাভীরু-পরহেযগার ও আল্লাহর ওলী বানানোর জন্যই আগমন এই রমযান মাসের। কুরআন কারীমের অনেক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলতরে কথা বর্ণিত আছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব ও শা’বান তথা রমযানের দুই মাস আগে থেকে রমযান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধরি জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করতেন। “আল্লাহুম্মা বারেক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবা’ন ওয়া বাল্লেগ লানা রামাদান।” (অর্থ:হে আল্লাহ আমাকে রজব ও শাবান মাসের বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌছিয়ে দিন।) কুরআন কারীমসহ অন্যান্য আসমানী কিতাব আল্লাহতায়ালা এই রমযান মাসে নাযিল করে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
১.রমযান সেই মাস যে মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন যা মানবজাতির জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং হেদায়াত ও ফুরকান (হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী) বিষয়ক সুস্পষ্ট প্রমাণাদীস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসকে পায় সে যেন এতে রোযা রাখে। (বাকারা : ১৮৪)
২.আর তিনি দিবা রাত্রিকে পরস্পরের অনুগামী করেছেন। যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্য। (ফুরকান : ৬২)।
৩.হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (বাকারা : ১৮৩)।
রমযান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো রা-মিম-দোয়াদ বা রাময। আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম, কঠোর সূর্যতাপ, দহন, জ্বলন, তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া। সাওম বা রোযা সবার জন্যেই অবশ্য পালনীয় একটি ইসলামী বিধান। তবে এই বিধানটি কেবল আমাদের জন্যেই নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী রসূল বা রাসূলগণের উম্মাতদের জন্যেও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। অশোধিত তেলকে যেমন পরিশোধন করেই জ্বালাতে হয়, ব্যবহার করতে হয়, তেমনি মানুষের মন ও আত্মাকেও যথার্থভাবে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করার জন্যে বছরে একবার তাকে পরিশোধন করে নিতে হয়। নইলে অশোধিত তেলের মতো ময়লাযুক্ত আত্মা কিংবা মনে খোদায়ী নূর জ্বলবে না। পবিত্র রমযান মাস হলো অন্তরাত্মাকে পরিশোধন করার শ্রেষ্ঠ সময়। ব্যক্তিগত বিচিত্র ভুলের কারণে শয়তানীর যতো আচ্ছাদন পড়েছে মানুষের অন্তরের আয়নায়, যতো মরিচা ধরেছে তাতে অন্যায় আচরণ আর অনৈতিকতার চর্চার কারণে, সেগুলোকে ধুয়ে মুছে পূত-পবিত্র করে মনের ঘরে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালানোর সর্বোত্তম সময় রমযানের রোযা। ইসলামী পঞ্জিকা মোতাবকে প্রতি বছর পবিত্র রমযান আসে, রমযান যায়। মুসলিম জাহানের প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ-সবল নর-নারী এ পবিত্র মাসে ইবাদতের নিয়তে সুবেহ সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বপ্রকার পানাহার এবং স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক মিলন হতে বিরত থেকে রোযা পালন করে থাকেন। রোযার মূল উদ্দশ্য হলো তাকওয়ারগুন অর্জন করা। তাই আমাদের উচিত অবজ্ঞা-অবহেলা আর কোন প্রকার বাহানার আশ্রয় না নিয়ে রোযা রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কেননা মানুষ মরণশীল, অতএব যে রমযান চলে যাচ্ছে তা জীবনে দ্বিতীয়বার ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। রমযান এমন একটি মাস, যে মাসের সাথে অন্য কোন মাসের তুলনা চলে না।
রমযান মাসে মুমিন বান্দার উপরে শয়তানি প্রবৃত্তির আক্রমণ কম হয়, রাত দিনে মন নরম থাকে। একজন দেখা যায় তার গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইছে, আর একজন আনুগত্যের তাওফীক প্রার্থনা করছে। তৃতীয়জনকে দেখা যায় আল্লাহর শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, চতুর্থজন ভাল কাজের ফলাফল সুন্দরভাবে পাওয়ার আশা করছে, পঞ্চম জনকে দেখা যায় তার প্রয়োজনের জন্য প্রার্থনা করছে। তিনিই মহান যিনি তাদেরকে তাওফীক দেন। অনেক লোক এমন আছে যারা এ সমস্ত কাজ থেকে দুরে অবস্থান করছে।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা শুরু হওয়ার আগে তার সাহাবীদকে কিভাবে সচেতন করতেন নি¤েœর হাদীস হতে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি।
হযরত সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, শা’বান মাসের শেষ দিন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদিগকে খুৎবা শুনালেন, যাতে তিনি বললেন ‘হে জনগণ! তোমাদের ওপর একটি মহান ও পবিত্র মাস আসছে, যার মধ্যে এমন একটি রাত্র রয়েছে যা হাজার রাত্র হতেও উত্তম।’
‘যে মাসের দিনগুলোতে আল্লাহ রোযাকে ফরয করেছেন এবং রাত্রিতে নামায (তারাবীহকে) নফল করেছেন (উম্মতের জন্য সুন্নত)।’
‘যে ব্যক্তি ঐ মাসে কোন একটি সদভ্যাস (বা সৎকাজ) করে তা ছওয়াবের দিক দিয়ে অন্য মাসের একটি ফরয কার্যের সমতুল্য হয়ে থাকে।’ আর একটি ফরয আদায় করলে, তা অন্য মাসের ৭০টি ফরয আদায়ের সমতুল্য ছওয়াবের হয়ে থাকে। ‘এটা হল ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্য অবলম্বনের প্রতিদান হচ্ছে বেহেশত। এটা পরোপকার ও সহানুভূতির মাস এবং এটা এমন একটি মাস যাতে ঈমানদারগণের রিযিক বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে।’
রমযান মাস মুসলিম মিল্লাতের জন্য বড় নেয়ামাত ও ফযীলতের মাস। এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাযিল করেন পবিত্র আল কুরআন। শুধু আল কুরআন নাযিল দ্বারাই এ মাসের ফযীলত ক্ষ্যান্ত করা হয়নি। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-এ মাসে এমন একটি রাত্র আছে যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে অধিক। যেমন-সুরা আল ক্বদর-এ বর্ণিত হয়েছে ক্বদরের রাত সহ¯্র মাসের চেয়ে উত্তম। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-যে ব্যক্তি ঈমান ও সদিচ্ছাসহ রোযা পালন করলো ঐ ব্যক্তির পূর্বের কৃত সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
রমযান হল পূণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মৌসুম। দীর্ঘ এক মাসের রোযা, তারাবী, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করে এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থেকে অর্জন করে হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি। মাসজুড়ে তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরী হয় বছরের বাকি দিনগুলো পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত থাকার যোগ্যতা। বান্দার এই অনুশীলনকে যথার্থ ও তার সংযমকে স্বার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযথভাবে এ মাসের বন্দেগীগুলো আগ্রহের সঙ্গে সঠিকভাবে আদায় করা।
রমযান মাসের রোযা মুসলমানের উপর ফরয। আমরা যেন আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারি। এই রোযা শুধু আমাদের উপর ফরয নয় আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয ছিল। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য থাকে অনেক অফার। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম এই রমযানের রোযা। তাই সকল মুমিন, মুসলমান এই মাসটির অপেক্ষায় থাকে। হযরত সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবানের শেষ তারিখে আমাদেরকে নসীহত করেছেন যে, তোমাদের মাথার উপর এমন একটি মর্যাদাশীল মুবারক মাস ছায়া স্বরূপ আসছে, যার মধ্যে শবেক্বদর নামে একটি রাত্রি আছে, যা হাজার মাস হতেও উত্তম। আল্লাহতায়ালা সে মাসের রোযা তোমাদের উপর ফরয করেছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবী পড়াকে তোমাদের জন্য পুন্যেরে কাজ করেছে। যে ব্যক্তি এমাসে কোন নফল কাজ আদায় করল, সে যেন রমযানের বাহিরে একটি ফরয আদায় করল। আর যে এমাসে একটি ফরয আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল।
রমযান মাসের সর্বোত্তম আমল যে রোযা তা বলার অপক্ষো রাখে না। কারণ রোযার ব্যাপারেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন স্বয়ং আমি এর প্রতিদান দিব।

রমযান মাসের অবিস্মরণীয় ঘটনাবলী।
১. নবুওয়াতের প্রথম বছর রমযান মাসে হেরা গুহায় পবিত্র কুরআন শরীফ অবতীর্ন হয়।
২. নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছর রমযান মাসে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
৩. নবুওয়াতের দশম বছর রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইন্তেকাল করেন।
৪. দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমযানুল মোবারকে ইসলামের প্রথম জিহাদ ঐতিহাসিক ‘গাযওয়ায়ে বদর’ সংঘটিত হয়।
৫. পঞ্চম হিজরীর রমযানুল মাসে খন্দকের যুদ্ধ হয়।
৬. অষ্টম হিজরীর ১০ রমযান জুম’আর দিনে মক্কা বিজয় হয়।
৭. অষ্টম হিজরীর ১৬ রমযানে কিয়ামত পর্যন্ত সুদকে হারাম করা হয়।
৮. নবম হিজরীর রমযান মাসে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৯. আটান্ন হিজরীর মাহে রমযানে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইন্তেকাল করেন।

রমযানের মাসের বৈশিষ্ট্য
রমযান মাসের বৈশিষ্ট্য অনেক। নি¤েœ কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো Ñ
১. আল্লাহতায়ালা প্রত্যহ জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন, অনতিবিলম্বে আমার নেক বান্দারা দুনিয়াবী বিপদ-মুসিবত এড়িয়ে তোমার মাঝে এসে পৌঁছবে ।
২. রমযান মাসে শয়তানকে শিকলে বেঁধে রাখা হয় ।
৩. রমযান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে রাখা হয় ।
৪. রমযান মাসে একটি বরকতময় রাত আছে যা হাজার মাস অপক্ষো শ্রেষ্ঠ। আর তা হলো-লাইলাতুল ক্বদর ।
৫. রমযানের শেষ রাতে সমস্ত রোযাদারদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় ।
৬. রমযানের প্রতি রাতে জাহান্নাম থেকে অনেক লোককে মুক্তি দেয়া হয় ।
৭. রমযানে বান্দার নেকী দশ হতে সাতশতগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হয় ।
৮. রমযান মাসে প্রিয় রাসূল রাহমাতাল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাহি ওয়সাল্লামকে সাইয়্যেদুল মুরসালীন, খাতামুন নাবীয়ীন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। এমাসে প্রিয় রাসূল নবুওয়াত প্রাপ্তি হন এবং তার কাছে ওহী আসতে শুরু হয়।
৯. রমযান মাসে একটি ক্বদরের রাত্র রয়েছে। ক্বদরের রাত হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ।
১০. রমযানে মানুষের হেদায়েতের জন্য আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে।
১১. রমযান মাস হলো সত্য প্রতিষ্ঠার এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে জেহাদের ।

রমযান মাসের ফযীলত
আমরা জানি পৃথিবীর সব দেশের মানুষই বার মাসে বছর হিসাব করে, কিন্তু এই বার মাসের মধ্যে একটি মাসের গুরুত্ব এতবেশী কেন? কোন কারণে এই মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়। মূলত এই মাসের সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব ফযীলত, রহমত, বরকত, নাজাত ও মাগফিরাত একমাত্র কুরআন এর সম্মানের কারণে হয়েছে। কুরআন যদি এই মাসে নাযিল না হতো তাহলে এই রমযান মাসের এত ফযীলত হতো না। যার কারণে প্রত্যেক এবাদতের গুণ এত বৃদ্ধি পেলো, তাকে আজ আমরা বুঝার চেষ্টা করি না। তার সাথে আমরা ভাল ব্যবহার করি না। তাকে দিয়ে নিজ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এক কথায় কিছুই পরিচালনা করি না। অথচ আমরা রমযান মাসের প্রতিটি দিনই রোযা রাখি। আসলে কুরআনকে সঠিক নিয়মে বুঝার জন্যই এ মাস কে নির্দিষ্ট করা হয়েছে-
কুরআনের আলোকে
মহান আল্লাহতায়ালা বলেন; রমযান মাস যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (বাকারা : ১৮৫)
রমযানের রোযা পালন ফরয, মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, ফলে আশা করা যায় যে তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।” অর্থাৎ তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে। (বাকারা : ১৮৩)
উপরোক্ত আয়াত শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয় বরং এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে, মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোযার বিশেষ সর্ম্পক রয়েছে এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার একটি স্বাভাবকি অধিকার রয়েছে।
রোযার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওযর বা রোগ ছাড়া রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দিবে সে যদি সারা জীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না।
প্রকৃত পক্ষে রমযান এসেছে বান্দাকে তাকওয়া শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সারা বছর মানুষ শয়তানের কু-আচরণের কারণে কিছু না কিছু গুনাহ করে থাকে। রোযার এক মাসে সাধনা করলে ঐ সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এই তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর উপর ঈমান, তার গুণাবলীর দয়া অনুগ্রহের গভীরে অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তার অন্যগুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়। এতে ইচ্ছা ও সংকল্পে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মাহাত্ম্য অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ্ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তব নিদর্শন।
হাদীসের আলোকে
১.রমযান সিয়াম সাধনার মাস
রমযানের অন্যতম দায়িত্ব হলো রোযা পালন। এ মাসে যে কুরআন অবর্তীণ হয়েছে, তা সমগ্র মানব জাতির সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু এ কুরআন থেকে সঠিক পথের দিশা পেতে হলে কিছু যোগ্যতা ও গুণাবলীর প্রয়োজন। যেমন- কুরআনে বলা হয়েছে, এটা সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা সেই মুত্তাকীদরে জন্য পথ প্রদর্শক যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। যারা ঈমান আনে তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তী রাসূলদের প্রতি অবর্তীণ কিতাবের প্রতি, আর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে আখিরাতের প্রতি। (বাকারা : ২-৪) তাকওয়ার সাথে উল্লেখিত গুণাবলী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয় থাকে। এজন্য মুসলমানদেরকে কুরআন থেকে হেদায়েত লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ কুরআন নাযিলের এ মাসে রোযাকে ফরয করে তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণরে ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং রমযানের সকল নিয়মাবলী যথাযথভাবে পালন করে কাঙ্খিত গুণাবলী নিজের মধ্যে তৈরী করে কুরআন থেকে হেদায়েত লাভের যোগ্য করে গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ রোযা শুধু আমাদের উপর নয় বরং অতীতের সকল রাসূলুল্লাহ ও উম্মতের উপর ফরয ছিল। আল্লামা ইবনে কাছীর বলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত প্রতি মাসে তিনটি রোযা ফরয ছিল। নূহ আলাইহিস সালাম থেকে এ অবধি সকল উম্মতের জন্য রমযান মাসে রোযা ফরয করা হয়েছে।
২.রমযান হলো আসমানী কিতাব নাযিলের মাস
সিনাই পর্বতে তাওরাত আনতে গিয়ে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত ছিলেন। সায়ির পর্বতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর যখন ইঞ্জিল নাযিল হয়, তার আগে তিনিও চল্লিশ দিন পর্যন্ত সাওম অবস্থায় কাটান। তেমনি পবিত্র কুরআন নাযিলের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরার নির্জন গুহায় পুরো একমাস বিশেষভাবে ইবাদতে লিপ্ত থাকেন। অবশেষে সেখানেই সূরা আলাকের শুরুর আয়াতগুলো নাযিল হয়। রাহমাতুল্লিল আলামীনের এ ঘটনাটিও সংঘটিত হয়েছে রমযান মাসে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “রমযান মাস, এতে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী।” (বাকারা : ১৮৫) রমযান মাসে সপ্তম আকাশে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাযিল হয়েছে। সেখান হতে আবার রমযান মাসে অল্প অল্প করে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি নাযিল হতে শুরু করে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। এটি শুধু কুরআন নাযিলের মাসই নয়, বরং সকল আসমানী কিতাব এ মাসেই অবর্তীণ হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাছীর বলেন, এটা সেই মাস যে মাসে রাসূলুগণের উপর আল্লাহর কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম বলেন, সৃষ্টি জগতের সকল কল্যাণ শরীয়াত হতে গৃহীত ও অর্জিত। শরীয়াতের মূল উৎস হলো আসমানী গ্রন্থ। এ মাসে আল-কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব অবর্তীণ করে পৃথিবী বাসীর প্রতি কল্যাণের যে শুভ সূচনা আল্লাহ করেছিলেন তা এখনো অব্যাহত আছে। কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব নাযিলের জন্যই রমযান কল্যাণের আধারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং রমযানকে যথাযথভাবে, গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে এবং তার চেয়েও বহুগুণ বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। আল-কুরআনকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে এবং এখান থেকে, শুধু মাত্র সংগ্রহ করতে হবে জীবন চলার পাথেয়। তাহলেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ সম্ভব হবে। কুরআন যে জীবনাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা উপস্থাপন করে তা প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপালনের জন্য এক দল আল্লাহভীরু, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকের প্রয়োজন, যারা একমাত্র আল্লাহর ভয়ে ও আখিরাতের জবাবদিহির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় সকল প্রকার অন্যায় অনাচার লোভ-লালসা, অনুরাগ বা বিরাগরে থেকে সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সমাজ ও জনগণরে কল্যাণই হবে যাদের ব্রত। রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে : হে ঈমানদারগণ, তোমাদের প্রতি রোযাকে ফরয করে দেয়া হলো যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (বাকারা-১৮৩) মুত্তাকী বলা হয় তাদেরকে যারা আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর সকল কথা, কাজ ও চিন্তাকে সর্ম্পূণভাবে বর্জন করে চলে। এজন্য কুরআন নাযিলের এ মাসে রোযা ফরয করে দিয়ে মুত্তাকী বানানোর প্রশিক্ষণরে ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলইে তাকওয়া অর্জন হবে না। বরং তাকওয়া অর্জন করতে হলে এর পাশপাশি সকল অন্যায় কথা, কাজ, চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ, লেনদেন প্রভৃতি একেবারেই বর্জন করতে হবে এবং এ অন্যায় বর্জন সময়ে কি নয় বরং স্থায়ী স্বভাবে পরিণত করতে হবে।
১.আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন কুরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি তা পাঠ করতে থাক এবং উপরে চড়তে (উঠতে) থাক। তুমি তাকে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক, যেরূপ তুমি দুনিয়োতে পাঠ করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ বসবাসরে স্থান (জান্নাত) ঐটিই যেখানে তোমার কুরআনের আয়াত শেষ হবে। (কিতাবুস সালাত : ১৪৬৪)
২.আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং কুরআনে অভিজ্ঞও-সে ব্যক্তি অতি সম্মানিত ফেরেশতাদের অর্ন্তভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠের সময়ে আটকে যায় এবং কষ্ট করে পড়ে, তার জন্য দু’টি বিনিময় অবধারতি। (কিতাবুস সালাত :১৪৫৪)
৩.আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাধ্যানুযায়ী আমল কর। কেননা আল্লাহতায়ালা তোমাদের কোন আমলকে বন্ধ করেন না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেরাই তা বন্ধ কর। কেননা আল্লাহতায়ালার নিকট ঐ আমলই অধিক পছন্দনীয় যা নিয়মিত আদায় করা হয় থাকে, যদিও পরিমাণে তা কম হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন আমল শুরু করতেন, তখন তা নিয়মিতভাবে আদায় করতেন। (কিতাবুস সালাত-১৩৬৮)
প্রতি বছর রমযান মাসে জিবরাইল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমযানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম দুই বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। তাই আমাদের উচিৎ এ মাসে পুরো কুরআন পড়ার পরকিল্পনা গ্রহন করা। কুরআনের শিক্ষা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়নের পদক্ষপে নেয়া।
৩.কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা
রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামরে সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সিরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা, বোঝা এবং আমল করা। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,“জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরে সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন।” (সহীহ আল বুখারী : ৩০৪৮) কুরআন মুখস্ত করন এবং জিকিরে সময় ব্যয় করা উচিত। আমাদের উচিত এ মাসে নামাজে এবং অন্যান্য ইবাদতে আরো অনেক বেশী আন্তরকিতা ও নিষ্ঠার প্রতিফলন ঘটানো। সাথে সাথে অভ্যস্ত হতে হবে আত্মবিচারে। “রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান এবং নিষ্ঠা ও আত্মবিচার (ইহ্তিসাব) সহকারে রমযানের রোযা পালন করেন আল্লাহ তাঁর পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। তাই প্রত্যেকটি ইবাদতইে আমাদের নিষ্ঠার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করুন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, (অর্থ) রমযান মাস, এমাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদরে জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (বাকারা : ১৮৫) হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। (সহীহ আল বুখারী : ১৯০২)
৪.কুরআন তেলাওয়াত করার ফযীলত
কুরআনের আলোকে
১. ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন তেলাওয়াত কর। (মুযাম্মিল:৪)
২. এবং আমি এই কুরআনকে পৃথক পৃথক করে নাযিল করেছি যেন আপনি উহা মানুষের সম্মুখে থেমে থেমে পড়তে পারেন, আর আমি উহাকে নাযিল করার সময়ও (অবস্থামত) ক্রমে ক্রমে নাযিল করেছি। (যেন উহা সহজ ও সুষ্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়) (বনী ইসরাঈল:১০৬)
৩. আমি উহাকে এক বিশেষ দারায় আলাদা অংশে সজ্জিত করেছি। (ফুরকান:৩২)
৪. উহারা কি দাবী করে যে কুরআন (আপনার) বানানো? আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও তাহলে একটি সূরা অন্তত: তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর, সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও। (ইউনুস:৩৮)
৫. নিশ্চয়ই কুরআন আমিই নাজিল করেছি। আর অবশ্যই উহার হেফাজতের দায়িত্ব আমারই। (হিজার:৯)
৬. হে রাসূল দ্রুত কুরআন আয়ত্ত করার নিমিত্তে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কুরআন সংরক্ষণ করা এবং উহা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিবরাইলের জবানে) উহা পাঠ করি, তখন আপনি উহা অনুসরণ করুণ। অত:পর উহা ব্যাখ্যাদানও আমার জিম্মাদারী।
হাদীসের আলোকে
১. হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে আবু যর, তুমি যদি আল্লাহর কিতাব থেকে একটা আয়াত শেখ, তবে সেটা তোমার জন্য একশো রাকাত (নফল) নামায পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি তুমি ইসলামী জ্ঞানের একটা অধ্যায়ও মানুষকে শেখাও, তবে তা তোমার জন্য এক হাজার রাকাত নামায পড়ার চয়েও উত্তম, চাই তদনুসারে আমল করা হোক বা না হোক। (ইবনে মাযাহ)
২. রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথা বলতে চায়, তবে সে যেন বেশী বেশী করে কুরআন তেলাওয়াত করে।
৩. হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: এই অন্তরসমূহের মরিচা ধরে, যেভাবে লোহায় মরিচা ধরে যখন উহাতে পানি লাগে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো: হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহার পরিশোধক কী? (উহার থেকে বাচাঁর উপায় কী?) তিনি বললেন: বেশী বেশী মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা। (সুনানে বায়হাকী)
৪. হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তিন ব্যক্তি কিয়ামাতের প্রাক্কালীন মহা আতংকে আতংকিত হবে না এবং তাদের কোন হিসাব দিতে হবে না, বরঞ্চ তারা সমস্ত সৃষ্টি জগতের হিসাব গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত একটা মস্কের পাহাড়ে থাকবে। (১) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাড়লো এবং জনগনের সম্মতি নিয়ে কুরআনের বিধান অনুযায়ী তাদের নেতৃত্ব করলো, (২) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষকে নামাযের দিকে ডাকে এবং (৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও বান্দার হক সুষ্ঠুভাবে পালন করে। (তাবরানী)
৫. হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যায়নে নিয়োজিত থাকায় আমার নিকট কিছু চাওয়ার সময় পায় না তাকে আমি ঐ ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নি’য়ামত দান করবো যে আমার কাছে চায়। কুরআন অধ্যয়নকারীর অন্তরের ইচ্ছাগুলো চাওয়া ছাড়াই পূরণ করে দেই। সমগ্র সৃষ্টির ওপর আল্লাহর যেমন শ্রেষ্ঠত্ব তেমনি দুনিয়ার অন্যসব বাণীর ওপর আল্লাহর কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব।” (জামে আত-তিরমিযী)
৭. যে ব্যক্তি কুরআন পাক অধ্যায়ন করবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে কেয়ামতের দিন তার পিতা-মাতাকে এমন মুকুট পরিধান করানো হবে যার জ্যোতি সূর্যের (আলো) জ্যোতির চেয়েও উজ্জল হবে।
৮. যে ব্যক্তি কুরআন পাক অধ্যায়ন করবে (অর্থ ও ব্যাখাসহ জ্ঞান করবে) অর্থাৎ তদনুযায়ী জীবন গঠন করবে-উহার হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম জানবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন এবং তার পরিবার পরিজনদের ভেতর থেকে এমন দশজনকে (জান্নাতের জন্য) সুপারিশ করার ক্ষমতা দান করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছিল।
৯. হযরত ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন: রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে: যে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছি-তাই তার ব্যাপারে আমাকে সুপারিশ করার অনুমোতি দিন। আর কুরআন বলবে: হে আমার রব! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমাকে তার ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দিন। তখন তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (সুনানে বায়হাকী)
১০.হযরত ওবাদাহ ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের এক অংশে বলা হয়েছে,“পবিত্র কুরআন কবরে তার সাথীর কাছে এসে বলবে, আমি রাত্রি জাগরণ ও দিনের পিপাসার্ত রেখেছি তোমাকে যৌন চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত রেখেছি এবং তোমার কান ও চোখকে সংযত রেখেছি। সুতরাং তুমি এখন আমাকে তোমার সত্যিকার বন্ধু হিসেবে পাবে। তার পর কুরআন উপরে উঠবে এবং বিছানা ও চাদর কামনা করবে, তখন তাকে বেহেশতের বিছানা, বাতি ও ইয়াসমিন ফুল দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। তার পর কেবলার দিকে কুরআনকে ধাক্কা দিয়ে আল্লাহ যতটুকু চান ততটুকু কবরকে সম্প্রসারণ করবেন।
১১.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু আতœীয়-স্বজন রয়েছে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা? তিনি বলেন: যারা কুরআনের ধারক-বাহক, তারাই আল্লাহর আতœীয় ও আপন জন। (আন-নাসাঈ, ইবনে মাযাহ ও হাকেম)
১২.হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন: কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান লেখক ফিরেশতাগণের সঙ্গী (মর্যাদার দিক দিয়ে তারা সম্মানিত ফিরেশতাগনের সমতুল্য) আর যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে মুকে আটকে যায়, বার বার ঠেকে যায় এবং উচ্চারণ করা বড়ই কঠিন বোধ করে তার জন্য দ্বিগুন সওয়াব। শুধু তিলাওয়াত করার জন্য একগুন আর কষ্ট করার জন্য আর একগুণ। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১৩.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যারা কোন জায়গায় একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকে তারা আল্লাহর মেহমান হয়ে যায়। ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে যতক্ষন পর্যন্ত তারা উঠে না যায় বা অন্য কাজে লিপ্ত না হয়। ততক্ষন যাবত ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে।
১৪.হযরত উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মসজিদে নববীতে আমরা বিভিন্ন মজলিসে বিভক্ত হয়ে দ্বীনের আলোচনা করতাম, কেউ যিকের, কেউ দোয়া, কেউ কুরআন তেলাওয়াত, কেউ কুরআন সর্ম্পকে আলোচনায় মশগুল থাকতাম। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযরা থেকে এসে কোরআনের মজলিসে বসে যেতেন। তিনি বলতেন আমাকে এই মজলিসে বসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১৫. সূরা ইখলাস পাঠের ফযীলত
১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “কুলহু ওয়াল্লাহু আহাদ” সর্ম্পকে বলেছেন: এ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াশের সমান। (সহীহ মুসলিম)
২. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তিকে যার যার সূরা কুলহু আল্লাহু আহাদ পড়তে শুনে সকাল হলে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গিয়ে তা বর্ণনা করলো। লোকটি যেন কুলহু আল্লাহু আহাদ এর মর্যাদাকে খাটো করছিল। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি এ সূরাটি অবশ্যই কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। (সহীহ আল বুখারী)
৩. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ব্যক্তি একটি সেনাদলের অধিনায়ক করে যোদ্ধাভিযানে পাঠালেন। নামাযে সে যখন সঙ্গীদের ইমামতি করতো তখন “কুলহু আল্লাহু আহাদ” দিয়ে শেষ করতো। অভিযান শেষে ফিরে এসে লোকজন ঐ বিষয়টি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বললে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে কেন এরূপ করে তা জিজ্ঞেস করো। সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বললো, ঐ সূরাতে আল্লাহতায়ালার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে তাই তা পাঠ করতে আমি ভালোবাসি। এ কথা শুনে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তাকে জানিয়ে দাও যে আল্লাহও তাকে ভালোবাসে। (সহীহ আল বুখারী)
৪. হযরত আবু আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল আমি “কুলহু ওয়াল্লাহু আহাদ” সূরাটি ভালবাসি জবাবে তিনি বললেন: তোমার এই সূরাটির প্রতি ভাল বাসা তোমাকে অবশ্য বেহেশতে প্রবেশ করাবে। (জামে আত-তিরমিযী)
৫. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুইশত বার “সূরা এখলাস” পাঠ করে, তার শুধু ঋণের দায় ছাড়া ৫ বছরের অন্যান্য গুনাহ্ মাফ হয় যায়। (জামে আত-তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদ)
৬. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঘুমাবার সময়ে বিছানায় ডান পার্শে শুয়ে একশত বার “কুল হুয়াল্লাহু আহাদ” পাঠ করে কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি ডান পার্শ¦ দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। (জামে আত-তিরমিযী)
১৬.আয়তুল কুরসী পড়ার ফযীলত
১. হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬ামকে বলতে শুনেছি তিনি এই কাঠের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর আয়তুল কুরসি পড়বে তার বেহেশতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ব্যতীত আর কোন বাধা নেই। আর যে ব্যক্তি শয়ন কালে এই আয়াতুল কুরসি পড়বে আল্লাহতায়ালা তার ঘর, তার প্রতিবেশীর ঘর এবং আশে পাশের আরও কিছু সংখ্যক ঘরকে নিরাপদে রাখবেন। (মেশকাত শরীফ)
২.সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ঘটনার উল্লেখ আছে যে, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মসজিদে নববীতে সাদকায়ে ফিতর হিসেবে জমাকৃত খাদ্যশস্যের তত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। এই সময়ে এক ব্যক্তি পর পর দুই রাত সেখানে খাদ্যশস্যের স্তুুপের কাছে এসে মুঠি ভরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। প্রতিবারই হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে হাতেনাতে পাকড়াও করলেন। কিন্তু নিজের চরম দরিদ্রদশার কথা বলে এবং পুনারাবৃত্তি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে মুক্তিলাভ করলো। তৃতীয় রাতে সে আবার আসলো। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে পাকড়াও করে বললেন: এবার আমি তোমাকে রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির না করে ছাড়ছি না। সে অনুনয় করে বললো, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে এমন কথা শিখিয়ে দিচ্ছি, যা তোমার জন্য খুবই কল্যাণকর হবে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কল্যাণকর কথার অনুরক্ত ছিলেন। তাই তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। সে বললো, রাতে যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে। তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করে দেয়া হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সকালে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ঘটনা শুনালে তিনি বললেন: সে নিজে মিথ্যাবাদী, কিন্তু তার এ কথাটা সত্য। তোমার সাথে যার কথা হয়েছে সে কে তা কি জানো? সে শয়তান।
“আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম, লা তা’খযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাউমু, লাহু-মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি, মানযাল্লাযী ইয়াস ফা’উ ইনদাহু ইল্লা বি‘ইযনিহি, ইয়া‘লামু মা বাইনা আইদীহিম ওয়ামা খালাফাহুম, ওয়ালা ইউহীতূনা বিশাইইম মিন ইলমিহি ইল্লা বিমা শা’-আ। ওয়াসিয়া কুরসিয়্যুহুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা, ওয়ালা ইয়া’উদুহু হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলীয়্যুল ‘আযীম”।
ক্স যে ব্যক্তি প্রভাতে ও শয়নকালে আয়তুল করছি পাঠ করবে, আল্লাহ পাক স্বয়ং দিবারাত্রির জন্য তার রক্ষক হবেন।
ক্স আয়তুল কুরছি পাঠে জ্বীন, দেত্ত, ভুত ও শয়তানের আছর হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
ক্স আয়তুল কুরছি পাঠের আমলে সকল প্রকার বিপদ আপদ ও দুংখ কষ্ট, দুর হয়। মনের বাসনা পূর্ণ হয়, রুজি রোজগার বৃদ্ধি পায়।
ক্স কোন কাজে রওয়ানার সময় বা বিদেশে যাওয়ার সময় তা পাঠ করে রওয়ানা দিলে নিরাপদে পৌঁছা যায় এবং সফরের উদ্দেশ্যে সফল হয়।
ক্স প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর আয়তুল কুরছি পাঠ করলে রূহ আরামের সাথে কবজ হয় এবং সহজে বেহশতে প্রবেশ করা সম্ভব হবে।
১৭.সূরা হাশরের শেষাংশ পড়ার ফযীলত
১. সূরা হাশরের শেষাংশ প্রত্যেহ সকালে পাঠ করলে ৭০ হাজার ফেরেশতা সন্ধা পর্যন্ত ও সন্ধায় পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত পাঠকারীর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন ও তার রক্ষণাবেক্ষন করেন। ফলে সকল প্রকার ফায়দা হাসিল হয়। যদি এ সময়ের মধ্যে সে মারা যায়। তবে শহীদি মর্তবা পাবে। এটি একটি উৎকৃষ্ট আমল। তিন বার আউযু বিল্লাহিচ্ছামিউল আলিম হিমিনাশ শায়তানির রাজীম ও একবার বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করে উক্ত আয়াতটি পড়তে হয়ে।
“হুওয়াল্লা হুললাযী লা-ইলাহা ইল্লাহু আ’-লিমুল গাইবি ওয়াশশাহাদাতি হুওয়ার রাহমানুর রাহীম।
হুওয়াল্লা হুললাযী লা-ইলাহা ইল্লাহু আলমালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল মু‘মিনুল মুহাইমিনুল আযীযুল জ্বাব্বারুল মুতাক্বাব্বিরু; সুবহানাল্লাহি-আম্মা ইউশরিকুন।
হুয়াল্লা হুল মা-লিকুল বা-রিউল মুসাব্বিরু লাহুল আসমা-উল হুছনা; ইয়্যুসাব্বিহু লাহূ মা-ফিস্সামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্বি, ওয়া হুওয়াল আযীযুল হাকীম”।
১৮.সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াতের ফযীলত
১.সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। আবু মাসউদ আনসারী বলেছেন, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ঘুমানোর সময় যে ব্যক্তি সূরা বাকারার শেষ তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করবে সেটি তার জন্য সব ব্যাপারেই যথেষ্ট হবে। কেউ কেউ এর অর্থ বুঝাচ্ছেন এই যে, এ আয়াতগুলির তিলাওয়াত করলে রাত জেগে ইবাদতের জন্যও যথেষ্ট হবে। কিন্তু এ অর্থটি একেবারেই ঠিক নয়। এ যথেষ্ট হওয়ার সঠিক অর্থ হলো, তা মানুষকে সব রকমের অকল্যাণ ও বিপদ থেকে নিরাপদ রাখবে।
২.হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি মনে করি না, সূরা বাকারার শেষ তিনটি আয়াত না পড়ে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি ঘুমাতে পারে।
সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত
লিল্লাহি মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্ধী; ওয়াইন তুবদূ মা ফি আনফুসিকুম আও তুখফুহু ইউহাসিবকুম বিহিল্লাহ; ফাইয়াগফিরু লিমাইয়াশাউ ওয়াইউ’আযযিবু মাইইয়াশাউ; ওয়াল্লাহু আল্লা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। – ২৮৪
আমানার রাসূলু বিমা উনযিলা ইলাইহি মির বাব্বিহী ওয়াল মু’মিনুন; কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়ামালাইকাতিহি ওয়াকুতুবিহী ওয়া রসূলিহি; লানুফাররিকু বাইনা আহাদিম-মির রসূলিহি; ওয়া ক্বালু সামি’না ওয়াআত’¡না, গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাছীর। – ২৮৫
লাইয়্যুকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা; লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত; রাব্বানা লা তুআখিযনা ইন্নাসীনা আও আখতা’না; রাব্বানা ওয়ালা তাহমিল আলাইনা ইছরান কামাহামালতাহু আলাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিনা; রাব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা মা লা ত্বক্বাতালানা বিহি, ওয়াফু আন্না, ওয়াগফিরলানা, ওয়ার হামনা, আনতা মাওলানা ফানছুরনা আলাল ক্বাওমিল কাফিরীন। – ২৮৬
১৯.সূরা ইয়াসীন পড়ার পযীলত
১.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: প্রত্যেক জিনিষের একটা কলব আছে। সূরা ইয়াসীন কুরআনের কলব। যে উহা একবার পড়বে আল্লাহ তার জন্য দশবার কুরআন পড়ার সওয়াব নির্ধারণ করবেন। (জামে আত-তিরমিযী)
২.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দিনের শুরুতে “সূরা ইয়াসীন” পাঠ করবে তার সমস্ত অভাব পূরন করে দেয়া হবে। (মিশকাত)
২০.সূরা মূলক পড়ার ফযীলত
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কুরআনের ত্রিশ আয়াতে একটি সুরা (সূরা মূলক) আছে, যা এক ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। ফলে তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। সূরাটি হচ্ছে তাবারা কাল্লাজি বেইয়াদিহীল মুলক। (আবু দাউদ,তিরমিযী,আন-নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ)
২১. সূরা ইয়া যুলযিলাত পড়ার ফযীলত
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সূরা ইয়া যুলযিলাত কুরআনের অর্ধেকের সমান, কুল হুয়াল্লাহু আহাদ এক-তৃতীয়াশের সমান এবং কুল ইয়া আইউহাল কাফিরুন এক-চুর্তাথাংশের সমান। (জামে আত-তিরমিযী)
২২. সূরা দুখান পড়ার পযীলত
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সূরা দুখান” পাঠ করে এবং প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে, ১২ হাজার ফেরেশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। (জামে আত-তিরমিযী)
২ .রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুম’আ-বার রাত্রে “সূরা দুখান” পাঠ করে তার গোনাহ্সমুহ মাফ হয়। (জামে আত-তিরমিযী)
২৩. সূরা কাহাফ পড়ার ফযীলত
১.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি “সূরা কাহাফ”এর প্রথম তিন আয়াত নিয়মিত তিলাওয়াত করে সে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদ থাকবে। (জামে আত-তিরমিযী)
২.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুম’আর দিন “সূরা কাহাফ” তিলাওয়াত করে তার জন্য দুই জুম’আর মধ্যর্বতী দিনগুলিতে নূরের ব্যবস্থা করা হয়। (সুনানে বায়হাকী ও মিশকাত)
২৪. সূরা আল-ইমরান পড়ার পযীলত
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে “সূরা আল-ইমরান” এর শেষে রুকু পাঠ করে, তার জন্য সারা রাত্রি নামায দাঁড়িয়ে থাকার সমতুল্য সওয়াব লিখিত হয়। (মিশকাত)
২৫. সূরা ওয়াকিয়া পড়ার ফযীলত
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেকে রাত্রে “সূরা ওয়াকিয়া” তিলাওয়াত করবে সে কখনও ভূখা থাকবে না। (সুনানে বায়হাকী ও মিশকাত)
২৬. সূরা বাকারা পড়ার ফযীলত
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঘরের ভিতরে যিকরি-তিলাওয়াত না করে তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানাইয়া ফেলিও না। যে ঘরে “সূরা বাকারা” তিলাওয়াত করা হয় সেই ঘর হতে শয়তান পলায়ন করে। (সহীহ মুসলিম)
২৭. সূরা ফাতিহা পড়ার পযীলত
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সূরা ফাতিহাতে প্রতিটি রোগের ঔষধ বিদ্যমান। (দারিমী ও মিশকাত)
২. ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,“জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন। ” (সহীহ আল বুখারী : ৩০৪৮)
রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে রাসূলুল্লাহাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামের সাথে কুরআন পাট করতেন। তার সিরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা কুরআনকে বুঝা, এবং তা আমল করা।
৫.রমযান মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয়
এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। আর এ কাজগুলো রমযানের প্রতিরাতেই সংঘটিত হয় এবং শেষ রমযান পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন রমযান মাস আসে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। (সহীহ আল বুখারী ১৮০০ ও সহীহ মুসলিম)
২. জান্নাত-জাহান্নাম আল্লাহর সৃষ্ট দু’টি বস্তু যার দরজাগুলো প্রকৃত অর্থেই খোলা কিংবা বন্ধ করা হয়।
(শরেহ ইবনে বাত্তাল : ৪/২০ ও আল-মুফহিম : ৩/১৩৬)
৩. ফযীলতপূর্ণ সময় এবং তাতে যেসব আমল করা হয়, তার সব কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ। যার ভিত্তিতে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়।
৪. যে ব্যক্তি রমযানের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করবে এবং এতে আল্লাহর হুকুম যথাযথ পালন করবে, সে রমযানের এসব ফযীলত লাভে ধন্য হবে। কাফের, যারা এ মাসে রোযা রাখে না এবং এ মাসের কোন মর্যাদা স্বীকার করে না, তাদের জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয় না, তাদের জন্য জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় না। তাদের শয়তানসমূহ বন্দি করা হয় না এবং তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ারও উপযুক্ত নয়। (ফতোয়া শাইখুল ইসলাম : ৫/১৩১-৪৭৪) এর ভিত্তিতে বলা যায়, রমযান কিংবা অন্য মাসে যদি তাদের কেউ মারা যায় তবে সে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হবে।
৬.রমযান মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদরের ন্যায় বরকতময় রজনী
এ মাসে লাইলাতুল ক্বদর নামে একটি রাত্র রয়েছে যার ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রিতে ফিরিশতা ও রূহ জিবরাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী নিয়ে অবতরণ করে। ফজর উদয় হওয়া অবধি এ রাত্রিতে শান্তিবর্ষিত হতে থাকে। (ক্বদর : ৩-৫) আল্লাহ বলেন আমরা এটিকে নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে। আমরা তো সতর্ককারী। সেই রাতে ফায়সালা করা হয় প্রত্যেকটি বিজ্ঞানময় বিষয় আমাদের আদেশক্রমে। (দুখান : ৩-৫) রমযান মূলত ছওয়াব অর্জনের এক মৌসুম বিশেষ। প্রকৃতপক্ষে ইহা আল্লহতায়ালার পক্ষ হতে তাঁর বান্দাদের উপর অর্পিত মহান এক দান ও বিধান। যা বান্দা ও মাওলার মাঝে মহব্বত-ভালোবাসার নিদর্শন ও সেতুবন্ধন। আল্লাহর খালেছ বান্দা-বান্দীরা তা পালন করে এক অতুলনীয় স্বাদ গ্রহণ করেন। নিজের আমল ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা এ মাসে যে যত বেশী অর্জন করতে পারবে সে তত বেশী কল্যাণের অধিকারী হবে। এ মাসে রোযা পালন, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কাজ বেশী করে করতেন। তা হলো কুরআন তেলাওয়াত ও বেশী বেশী করে দান করা। আমরাও যদি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি এ দুটি কাজ বেশী করে করি তাহলে বেশী কল্যাণ লাভ করতে পারব। লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাস থেকে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের বরকত থেকে মাহরুম হল, সে অনেক কল্যাণ থেকে মাহরুম হল।
৭.রমযানের শেষ দশকের এবাদত
১.রমযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন, যতটা তিনি অন্য দিনগুলোতে করতেন না।’ (সহীহ মুসলিম : ১১৭৫ ও জামে আত-তিরমিযী : ৭২৬)
২.আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘রমযানের শেষ দশক এলে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন এবং তিনি এর রাতগুলোতে নিজে জাগতেন আর পরিবারকেও জাগাতেন।’ (সহীহ আল বুখারী : ২০২৪; সহীহ মুসলিম : ১১৭৪ ও আন-নাসাঈ: ১৬২১)
৮.রমযান মাসের সুসংবাদ প্রদান এবং নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা
রমযানের সুসংবাদ প্রদান এবং রমযানকে স্বাগত জানানো বৈধ। কারণ, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সাহাবাদের সুসংবাদ প্রদান এবং নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য রমযানের এ বৈশিষ্ট্য্যগুলো বর্ণনা করতেন। তদ্রুপভাবে প্রত্যেকে কল্যাণকর আমলের ব্যাপারে এরূপ করা বৈধ।
৯. রমযান মাসে রোযাদারকে ইফতার করানো
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোযাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটতি না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (জামে আত-তিরমিযী : ৮০৭)
১০.আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান ও সদকা করা
আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সব সময় যাতে সার্মথ্যবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রমযান মাসে এ ইবাদতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। যথাসাধ্য দান করুন দান করার অর্থ অন্যকে দেওয়া নয়, নিজের জন্য আখিরাতের সঞ্চয় করা। সুতরাং দান করি আর হিসাব করি যে, আখেরাতের জন্য কী পরিমাণ সংরক্ষণ করলাম। আর এর জন্য সর্বোত্তম সময় হল রমযান মাস।
১.ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে,“রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। আর রমযান মাসে যখন জিবরাইল আলাইহিস সালাম তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন। জিবরাইলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন।” (সহীহ আল বুখারী : ৩০৪৮)
২.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রামযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত। (সহীহ আল বুখারী:১৯০২)
৩.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবে ঃ হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে। মুজাহিদদের কে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদারদেরকে ডাকা হবে রাইয়্যান দরজা হতে। দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলি দরজা থেকে ডাকা হবে..? যদিও এর কোন প্রয়োজন নেই। জবাব দিলেন হ্যাঁ। আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অর্šÍভূক্ত হবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১১.রমযান মাস দোয়া কবুলের মাস
রমযানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা-দোয়া, যিকির ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রমযান মাস দোয়া কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়। তাই রোযাদার ব্যক্তির উচিত বেশি বেশি দোয়া করা। কারণ, রোযাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(রমজানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমযান মাসে করে থাকে)।’’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)
১২. রমযান মাস জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস
১. রমযান মাসে মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাহে রমাযানে প্রতিরাত ও দিনের বেলায় বহু মানুষকে আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের বেলায় প্রত্যেকে মুসলিমের দোয়া ও মুনাজাত কবুল করা হয়ে থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)
২. রমযানের প্রত্যেকে রাতেই আল্লাহতায়ালার কতক মুক্ত বান্দা থাকে। তারাই মুক্তি পাওয়ার বেশি হকদার, যারা রোযা রাখে ও তা হেফাজত করে, যারা রমযানে কেয়াম করে ও তার মধ্যে ইহসান রক্ষা করে, আল্লাহর মহব্বত ও তার সওয়াবের আশায় এবং তার শাস্তির ভয়ে বেশি বেশি নেক আমল করে।
৩. জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এসব বান্দাদের জন্য আল্লাহর নিকট একটি করে কবুল দোয়ার ওয়াদা রয়েছে। তারা দু’টি কল্যাণপ্রাপ্ত হল : কবুল দোয়া ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের কর্তব্য রোযা ভঙ্গকারী বা রোযার সওয়াব নষ্টকারী বস্তু থেকে দূরে অবস্থান করা এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে চোখ, কান ও জবানকে হেফাজত করা।
১৩. রমযান মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমান
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “রমযানের রোযা দশ মাসের রোযার সমতুল্য, ছয় রোযা দুই মাসের রোযার সমান, এ যেন সারা বছরের রোযা।”
২.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রমযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত। (সহীহ আল বুখারী : ১৯০২)
১৪. রামযান মাস সবর বা সহিষ্ণুতার মাস
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এ হাদীসে রামযান মাসকে সবররে মাস হিসেবে উল্লখে করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :“সবরের মাসে রোযা রাখা ও প্রত্যেকে মাসে তিন দিন রোযা রাখা অন্তরের অস্থিরতা দূর করে থাকে।” (আলবানী বলেন হাসান : ১৭০৩)
১৫. ধৈর্য, সংযম ও সমবেদনার মাস রমযান
ধৈর্য ও আত্মসংযম মানুষের সফলতা ও নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের চাবিকাঠি। রোযা সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষকে পানাহার থেকে বিরত রাখে। এর ফলে ক্ষুধা পিপাসায় চরম কষ্টের সময়েও তাকে সেগুলো বর্জন করে আত্মসংযম ও ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাস অনুশীলনের ফলে ভোগবিলাসের প্রতি তার লোভ-লালসা হ্রাস পেয়ে এবং সে আত্মসংযমে অভ্যস্ত হয়। কঠিন ক্ষুধার সময়ে যে কষ্ট অনুভব হয় তা সহ্য করার মাধ্যমে সে ধৈর্যশীল ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে সে অন্য যে কোন কঠিন পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ পায়। হাদীসে রমযানকে সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমাজে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা অনাহার অর্ধাহার থেকে ক্ষুধায় যে কষ্ট পায়, ধনী ব্যক্তিরা তা উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু রমযান মাসে রোযা পালন করতে গিয়ে দীর্ঘ সময়ে উপবাস থাকার কারণে ক্ষুধার যে কি যন্ত্রণা তা তারা উপলদ্ধি করতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের প্রতি অনুকম্পা ও সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং সমবেদনায় সিক্ত হয় তারা তখন দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। রোযার মাধ্যমে এ অনুভূতি যদি সকল ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে জাগ্রত করা যায়, তাহলে তা দারিদ্র বিমোচনে সহযোগী ভূমিকা পালন করবে। এ মাসে বেশী বেশী দান করা, রোযাদারকে ইফতার করানো ও পরিতৃপ্তি সহকারে খাদ্য খাওয়ানো এবং অধীনস্ত ব্যক্তিদের কাজের ভার লাঘব করে দিতে হাদীসে বলা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে পারস্পারিক মায়ামমতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা একটি সুন্দর সমাজের জন্য খুবই জরুরী।
১৬.আত্মশুদ্ধি ও সমাজ পরিশুদ্ধির মাস
রোযার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি সদস্য যদি সমাজের শৃংখলা বিনষ্টকারী উল্লেখিত মন্দ আচরণগুলো বর্জন করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। অশ্লীলতা থেকে কতটুকু দূরে আমরা সরতে পেরেছি? আমরা কি রমযানের দিনে এবং রাতে টেলভিশনের পর্দা থেকে আমাদের চোখ সরাতে পেরেছি? কুরআন, হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী বই পুস্তক পড়া, যা আমাদের আত্মোন্নয়নের চাবিকাঠি তা বাদ দিয়ে এখনো কি আমরা টেলেভিশন-ভিডিওতে বাংলা, ইংরজেী এবং হিন্দুস্তানী সিনেমা-নাটক দেখতে মুগ্ধ নই? আমাদের ক্যাসেট ও সিডি প্লেয়ারে এখনও কি ঐ সমস্ত গান বাজনা যা অশ্লীলতা মুক্ত নয়? প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা আসুন এই রমজানে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর আলোকে আমরা আমাদের জীবনগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখি। রমযানকে যথাযথভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে অতীতের ভুলত্রুটি পরিমার্জনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধি হওয়া যায়। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোযা পালন করে, তার অতীতের গুনাহগুলোকে মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রমযানের রাত্রি জাগরণ করে তার অতীতের গুনাহগুলোকে মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে লাইলাতুল ক্বদর জাগরণ করে তারও অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) তাছাড়া রোযা ব্যক্তির উপরে বেশ কিছু আচরণগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। যেমন-রোযাদারের জন্য মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ, গীবত বা পরনিন্দা, ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা, হিংসা-বিদ্বেষ, গালমন্দ, ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীল কথা ও কাজ প্রভৃতি নিষিদ্ধ।
১৭.রমযান কল্যাণের অফুরন্ত এক ভা-ার
বরকত ও কল্যাণের বার্তাবাহক রমযান মাস। হাদীসে বলা হয়েছে, এ মাসের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক জাহান্নাম থেকে নাজাতের। এ মাসে কেউ নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য ছওয়াব পাবে। এ মাসে ১টি ফরয আদায় করলে অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায়ের ছওয়াব পাবে। এ মাসে কোন রোযাদারকে ইফতার করালে সেটা গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ হবে এবং রোযাদারের সমপরিমাণ ছওয়াব ইফতার যিনি করান তার আমলনামায় লিখে দেয়া হবে। অথচ রোযাদারদের ছওয়াবের কোন কমতি হবে না। (মিশকাত) হাদীসে আরো এসেছে, প্রতিটি মানুষের ভাল কর্মের বদলা দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু রোযা এর ব্যতিক্রম। কারণ আল্লাহ বলেন, রোযা খাছ করে আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বদলা দেব। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
অন্য হাদীসে এসেছে রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। আর কুরআন বলবে, হে আল্লাহ আমি তাকে রাত্রির ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। এ দুটি সুপারিশই গ্রহণ করা হবে। (মিশকাত)
১৮.রমযান মাস জেহাদের মাস
এই মাসের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা হলো বদর যুদ্ধ। ফুরকান শব্দ দিয়ে মহান আল্লাহ পাক সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে প্রমানার্থে বদর যুদ্ধের ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা যখন সত্যকে গ্রাস করতে উম্মাদ হয়ে উঠে তখনই আল্লাহপাক জিহাদের অনুমতি দিয়ে সত্য পন্থীদেরকে বুক টান করে দাঁড়াতে নির্দেশ করেন। এই নির্দেশের প্রথম প্রতিফলন বদর যুদ্ধে। তাই রমযানকে সত্য প্রতিষ্ঠার এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে জেহাদের মাসও বলা হয়।
বিশ্বের অনেক দেশে আজও বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে হৃদয়ে লালন করে প্রতি বছর রমযানের ১৭ তারিখে ‘জিহাদ দিবস’ পালন করে থাকেন। বদরের ময়দানে আবু জেহেলদের পরাজয় গোটা জাহিলিয়াতের শরীরে দিয়ে ছিলো প্রচন্ড আঘাত। তাই আজও বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা সত্যের পক্ষে, মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বদর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিতে শ্লোগান দেন বদরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেক বার।
১৯.রহমত, রবকত ও নাজাতের মাস
রমযান হলো রহমত, বরকত, মাগফেরাত, হেদায়ত ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টিকারী কুরআন, এবং জেহাদের মাস। এই মাস ত্যাগের, আধ্যাতœ সাধনার, এবং ইবাদতের। এই মাসের একটি নফল ইবাদ অন্য মাসের ফরয ইবাদতের সমতুল্য পূণ্যের। এই মাস শিক্ষা গ্রহনের ও চরিত্র সংশোধনের মাস। এ মোবারক মাস পেয়েও যদি আমরা কিছু অর্জনে ব্যর্থ হই, তবে সেটা অবশ্যই আমাদের দুর্ভাগ্য।
রহমত
এ মাসের নফল কাজগুলোর জন্য ফরজের সমান বরকতের ওয়াদা করা হয়েছে এ মাসে; আর প্রতিটি ফরজের জন্য এর সত্তর (৭০) গুন সওয়াব। কতটুকু নফল ইবাদাত করার পরকিল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি? ফরযগুলোকে যথার্থ আন্তরকিতা সহকারে আদায়ের কতটুকু উদ্যোগ আমাদের রয়েছে? রমজানে শয়তানকে আবদ্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু আমরা কি নিজেদেরকে শয়তানী প্ররোচনা থেকে মুক্ত করতে পেরেছি? এই রমযানেও কি আমরা শয়তানী কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হইনা?
বরকত
এ মাসের অন্যতম বরকত হল ভাল কাজের প্রতিদান অনেক বেড়ে যায়। যেমন, রাত্রে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের রাত্রে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন: যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমযানের রাত্রে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে আল্লাহতায়ালা তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
নাজাত
রোযা শুধু পানাহার কিংবা সহবাস ত্যাগের নাম নয়। রোযা হলো মানসিক, ব্যক্তিগত সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক দৈনন্দিন কাজ-কর্মে সৃষ্ট পাপাচার এবং সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান-মদের ব্যবসা মিথ্যাচার ইত্যাদি ত্যাগের মাস। যতটুকু নিজেদের আয়ত্বে ততটুকু অবশ্যই সাথে সাথে ত্যাগ করে তাওবাহ করতে হবে। শপথ নিতে হবে আগামীতে না করার। কাকুতি করে সত্য পথে চলার সাহায্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। অবশ্য যা নিজের আয়ত্বের বাইরে, তার জন্য আল্লাহ ক্ষমাশীল, তবে চেষ্টা করতে হবে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পাপাচার বন্ধের। যদি সাধ্যমতো চেষ্টা ও না করা হয় তবে দায়ী থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-যে রোযাদার রোযা রেখে মিথ্যা কথা এবং অন্যায় পাপাচার থেকে বিরত থাকে না তবে এমন রোযাদারের আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ আল বোখারী)
রোযা এমন একটি মাস যার প্রথম হলো রহমত, মধ্যমাংশ হলো মাগফিরাত এবং শেষাংশহলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ মাসে যে কেউ তার গোলামের কাজকে সহজ করে দেবে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।” (জামে আত-তিরমিযী ও সুনানে বায়হাকী)
২০.রমযান মাসে শয়তানকে শৃখল বন্ধ করা হয়
১. রমযান মাসে আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানি প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি বান্দার রোযা হেফাজত করেন এবং শয়তানদের বন্দি করে রাখেন, যাতে সে এ পবিত্র মাসে বান্দার এবাদত নষ্ট না করতে পারে। (জখিরাতুল উকবা : ২০/২৫৫)
২. এ হাদীস দ্বারা শয়তানের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে। তারা শরীর বিশিষ্ট্য যা শেকলে বাঁধা যায়। তাদের মধ্যে কতক রয়েছে অবাধ্য, যাদেরকে রমযান মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (জখিরাতুল উকবা : ২০/২৫৫)
৩. যেমন এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। আর এ কাজগুলো রমযানের প্রতিরাতেই সংঘটিত হয় এবং শেষ রমযান পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে।
৪. যে ব্যক্তি রমযানের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করবে এবং এতে আল্লাহর হুকুম যথাযথ পালন করবে, সে রমযানের এসব ফযীলত লাভে ধন্য হবে। কাফের, যারা এ মাসে রোযা রাখে না এবং এ মাসের কোন মর্যাদা স্বীকার করে না, তাদের জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয় না, তাদের জন্য জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় না। তাদের শয়তানসমূহ বন্দি করা হয় না এবং তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ারও উপযুক্ত নয়। (ফতোয়া শাইখুল ইসলাম : ৫/১৩১-৪৭৪)
৫. মুসলমান হয়ে যে ব্যক্তি কাফেরদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখল, যেমন- রমযানের অবমূল্যায়ন করল, রমজানে পানাহার করল, রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এমন কাজ করল অথবা এমন কাজ করল যার দ্বারা রোযার সওয়াব কমে যায়, যেমন- গীবত, চোগলখুরীতে লিপ্ত হল, মিথ্যা সাক্ষ্য দিল বা তার মজলিসে উপস্থতি হল, তার ব্যাপারেও আশঙ্কা করা যায় যে সে রমযানের ফযীলত থেকে মাহরুম হবে, তার জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হবে না, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হবে না এবং তার জন্য শয়তানদেরও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে না
৬. সুরায়ে সাদের ৫০ নাম্বার আয়াতে জান্নাতের প্রশংসায় বলা হয়েছে, ‘জান্নাত চিরস্থায়ী বাসস্থান, তাদের জন্য তার দরজাগুলো উম্মুক্ত’। এর দ্বারা জান্নাতের দরজাগুলো সর্বদা উম্মুক্ত তা বুঝায় না। দ্বিতীয়ত এ সংবাদ হচ্ছে কিয়ামতের দিন সর্ম্পকে । তদ্রুপ সুরায়ে জুমারের ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের কাছে আসবে, তখন জাহান্নামের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করে দেয়া হবে’।
২১. রমযান মাসে ওমরাহ আদায় করা
রমযান মাসে ওমরাহ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ বিষয়ে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
ক. এ মাসে একটি ওমরাহ করলে একটি হজ্জ আদায়ের ছাওয়াব হয় এবং তা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ্জ আদায়ের মর্যাদা রাখে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযান মাসে ওমরাহ করা আমার সাথে হজ্জ আদায় করার সমতুল্য’। (সহীহ আল বুখারী : ১৮৬৩; ও সহীহ মুসলিম : ১২৫৬)
খ. উম্মে মা‘কাল রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযান মাসে ওমরাহ করা একটি হজ্জের সমান’। (জামে আত-তিরমিযী : ৮৬১)
২২. রমযান মাস রাত্রি জাগরণের মাস
তাহাজ্জুদের সুযোগকে কাজে লাগান এবং তা অভ্যাসে পরিণত করুন। রমযান মাসে যেহেতু সেহেরীর জন্য ওঠা হয়। তাই একটু আগে উঠে দুই চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এজন্য এই বিষয়ে মনোযাগী হওয়া উচিত। পাশাপাশি ফিকরি করা উচিত যে, এটাকে যেন আগামীর জন্য অভ্যাসে পরিণত করতে পারি। পরিবারের লোকদেরকেও উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্ট্রা করুন।।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেত শুনেছি ‘ফরয নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ)।’ (সহীহ মুসলিম : ১১৬৩; মুসনাদে আহমদ : ৮৫৩৪ ও জামে আত-তিরমিযী : ৪৩৮)
২. রাসূলুল্ল¬াহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রমযানের প্রথম রাত্রি যখন আসে, তখনই আসমানের সবগুলো দরজা খুলে দেয়া হয় এবং রমযানের শেষ রাত্র (থাকা) পর্যন্ত উহা খোলা থাকে এবং রমযানের রাত্রিতে কোন মুমিন বান্দা খাঁটিভাবে কিছু নামায পড়লে উহার প্রত্যেক রাকা’আতের বদলে তাকে আড়াইগুন সওয়াব দেওয়া হবে এবং তার জন্য বেহেশতে লাল ইয়াকুত পাথর দ্বারা এমন একটি অট্টালিকা নির্মিত হবে, যার ৬০টি দরজা এবং প্রত্যেক দরজার সামনের ইয়াকুত দ্বারা সুসজ্জিত একটি স্বর্নের কক্ষ থাকবে।
৩. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেছেন: রমযানের দিনের বা রাতে মুমিন বান্দা যে সকল নামায পড়ে, তার প্রত্যেক রাকা’আতের বরকতে বেহেশতের মধ্যে তার জন্য বিরাট একটি বৃক্ষ জম্মে যার ছায়ায় সোয়া পাঁচশত বছর পর্যন্ত ভ্রমন করা যাবে।
৪. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: রমযানের প্রথম রাতে বেহেশতের সকল দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং রমযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। যদি কোন মোমেন পুরুষ বা মহিলা এই রাতে নামায পড়ে তবে প্রত্যেক সেজদাহর পরিবর্তে এক হাজার সাতশত পূণ্য দান করা হয়। আর তার জন্য লাল ইয়াকুত দ্বারা বেহেশতে প্রাসাদ তৈরী করা হবে। প্রত্যেক প্রাসাদের স্বর্ণের তৈরী সত্তর হাজার দরজা থাকবে। দরজাগুলো ইয়াকুত দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে।
৫. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেছেন: যখন কোন বান্দাহ রমযানের প্রথম রোযা রাখে-আল্লাহ রমযানের শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত গুনা ক্ষমা করে দেন। প্রত্যেকটি রোযার পরির্বতে সত্তর হাজার দরজা বিশিষ্ট একটি প্রাসাদ তার জন্য তৈরী করা হয়। সকাল হতে সন্ধা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। রাতে-দিনে যত সিজদাহ করে উহার প্রত্যেক সিজদার পরির্বতে এমন একটি গাছ দান করা হবে, যার ছায়ায় কোন অশ্বরোহী শত বছর অর্শ¦ পরিচালনা করলেও সেই ছায়ার প্রান্ত সীমায় পৌঁছতে পারবে না।
২৩. সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামযান মাসে অন্য মাসের চেয়েও বেশি বেশি ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (রহ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল রমযান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশি বেশি করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রমযানে আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন, কেননা এ সময়ে তিনি সাদাকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, নামায, যিকরি ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত অধিক পরিমাণে করতেন। তিনি রমযানে এমন বিশেষ ইবাদাতসমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না। (যাদুল মাআ‘দ ১/৩২১)

রমযান মাসের সুযোগ কাজে লাগানো
রমযান মাস আল্লাহতায়ালার দিকে ফিরে আসার এবং নিজের হিসাব নিকাশের, আর আল্লাহর সামনে নিজের গোনাহের ক্ষমা চাওয়ার সুযাগ করে দেয়? সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য সত্যিকারভাবে ইসলামী জীবন যাপন করার সুযাগ এনে দেওয়ার মাস?
এ মাস কে দাওয়াত দানকারীগণ তাদের দায়িত্ব¡ পালনের বিষয়ে দৃষ্টি-ভঙ্গি পাল্টিয়ে নুতন করে চিন্তা-ভাবনা করার সুযাগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এ কথা চিন্তা করে যে, তারা সর্বোত্তম দাওয়াতের দায়িত্ব¡ পালনকারী এবং তারা অতি উত্তম উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন। তারা নিজের সত্তার চিন্তা এবং তার জন্য ঘোরাফেরা করা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু আল্লাহর নিকট যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী মনে করে কাজ করবে।
এ মাসটি প্রত্যেকে মুসলমান তার মুসলমান ভাইকে সাহায্য করার মাস হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। হোক না সে অত্যাচারী অথবা অত্যচারিত। অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিরোধ করে তাকে সাহায্যে করবে। অত্যাচারিতকে সাহায্য করবে তার সহযোগীতার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে মুসলমান সমাজে সর্বত্র ভাল পরিবেশ তৈরী হবে।
এ মাসটি ধনী এবং আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপনকারীদরে জন্যও বিরাট সুযাগ। তাদের কাজ-কর্ম এবং অনুভূতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা যেন দরীদ্রদের প্রয়োজন ও ব্যথা অনুভব করতে পারে। নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। আল্লাহ যে পথে ব্যয় করতে সম্পদ দিয়েছেন সে পথে তারা সম্পদ ব্যয় করতে পারে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত আছে তাদের বাঁচাতে তারা যেন এগিয়ে আসতে পারে। তারা যদি তাদের ক্ষুধার্তদেরকে না খাওয়ায়, বস্ত্রহীনদেরকে বস্ত্র না দেয় আর দূর্বলদেরকে সাহায্য না করে মনে করতে হবে তাদের ঈমান বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে।
রমযান আমাদের নিজেদের জন্য এমন একটি পদ্ধতি অবলম্বনের সুযাগ এনে দেয় যার মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারায় অভ্যস্ত হতে পারি। সকলের হাত, পা, চোখ, কান, জিহবা, মুসলমান হয়ে যাবে। যখনই এ সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ নড়া-চড়া করবে তার সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী করবে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহতায়ালা বলেন: আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, আমি তাকে ভালবাসি। যখন আমি তাকে ভালবাসি সে আমার কান হয়ে যায় যা দিয়ে সে শোনে। আমার চক্ষু হয়ে যায় যা দিয়ে সে দেখে। সে আমার হাত হয়ে যায় যা দিয়ে সে ধরে। সে আমার পা হয়ে যায় যা দিয়ে সে চলে। (সহীহ আল বুখারী)।
এ সমস্ত কিছু রমযানের পাঠশালায় অর্জন করা সম্ভব। যে রমযান আমাদেরকে দৃঢ়তা অবলম্বন ও সত্য গ্রহণের শিক্ষা দেয়। যার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তির সমস্ত দেয়াল ভেঙ্গে যায়। খারাপের ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যায়। সে দৃঢ়তা এবং সুক্ষ্ম নিয়ম কি? যার মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীর মুমিনদেরকে দেখা যায় যে, তারা নির্দিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত হচ্ছে আবার নির্দিষ্ট সময় পানাহার করছে। অত:পর নিজের নফসকে কুপ্রবৃত্তির মধ্যে পতিত হওয়া অথবা পথভ্রষ্টতার বাতাসে ভেসে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারছে। সে তো কুপ্রবৃত্তি এবং কামনার উদ্রেককারীকে না বলে দেবে। আর এই না বলা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী হয় তাহলে খুব ভাল হয়। সে অশ্লীল কাজ করবে না। ঝগড়া করবে না। উচু স্বরে কথা বলবে না। কোন মূর্খ যদি তার অনুভূতিকে আহত করে ও তার ভিতরের খারাপ জিনিসকে জাগিয়ে তোলে তবুও সে বলবে, আমি সিয়াম পালনকারী।
আর মানুষতো নিজের অভ্যাসের গোলাম। যতই সে চেষ্টা করে ফিরে আসতে পারে না নফসের গোলামী থেকে। কেননা অভ্যাসের বিরাট প্রভাব রয়েছে অন্তর ও নফসের উপর। আমাদের অনেকের পানাহার, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে অনেক রকম অভ্যাস রয়েছে তার থেকে সে বিরত হতে পারে না। সিয়াম এই সমস্ত অভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিরাট উপকারী। মুসলমান ইচ্ছা করলে এর মাধ্যমে অনেক অভ্যাস থেকে নাজাত পেতে পারে কোন কষ্ট এবং ক্ষতি ছাড়াই। অত:পর যে সমস্ত অভ্যাস তার ক্ষতি করে সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে- যেমন, রাত্রি জেগে অনুষ্ঠান উপভোগ করা, গোনাহ হয় এমন অনুষ্ঠানে যাওয়া, কারো সাথে অনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদির অভ্যাস করা। অর্থাৎ এ জাতীয় যত ধরণের নেশা জাতীয় অভ্যাস আছে তা পরিত্যাগ করা। মূলত এ সমস্ত কিছু হয় দুর্বল মানসিকতার কারণে, অথবা এগুলোর নিকট আত্মসর্মপনরে কারণে। সুস্থ, ভদ্র ও বিবেকবানরা কখনও এমন কাজ করতে পারে না। যদি সিয়াম পালন করতে চান তবে হিংসা, গোনাহ এবং অন্যায় থেকে বিরত থেকে সিয়াম পালন করুন। সিয়াম অবস্থায় জিহবাকে অহেতুক কথা থেকে, দৃষ্টিকে হারাম থেকে বিরত রাখুন। অনেক সিয়াম পালনকারী আছেন তার সিয়াম উপবাস এবং পিপাসিত থাকা ছাড়া আর কোন উপকারে আসে না। সে ঐ ব্যক্তি যে আহার বাদ দিল, কিন্তু গীবতের মাধ্যমে নিজের ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া থেকে বিরত হতে পারল না। পান করা থেকে বিরত থাকল কিন্তু মিথ্যা, ধোকা, মানুষের উপর অত্যাচার থেকে বিরত হল না।
রমযান মাসের ৪টি দোয়া বেশি বেশি করে করা
হাদীস শরীফে রমযান মাসে ৪টি দোয়া বেশী বেশী করার প্রতি উৎসাহতি করা হয়েছে যেমন-
১। বেশি বেশি কালিমা তাইয়্যিবা পড়া,
২। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া,
৩। বেশি বেশি বেহেশত কামনা করা,
৪। বেশি বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া।
কালিমা তাইয়্যিবা পড়া
হাদীস শরীফে আছে কালিমা তাইয়্যিবাকে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির বলা হয়েছে। হযরত উবাদাহ বিন ছামতে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ এর স্বাক্ষ্য দিবে, আল্লাহতায়াল তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন। (আল মুর্জামুল কাবীর-৫০৭৪)
বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া
মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমাদের প্রিয় রাসূল হযরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতি দিন একশত বার ইস্তেগফার পড়তেন। তাই সব সময় বেশি বেশি বিশেষ করে রমযানে আরো বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া আবশ্যক।
বেশি বেশি বেহেশত কামনা করা
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে বেশি বেশি জান্নাতের জন্য দরখাস্ত করা আবশ্যক। যেমন- হে আল্লাহ আমরা আপনার কাছে জান্নাত চাই।
জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া
জাহান্নামের ভয়াবহতার প্রতি খেয়াল করে জাহান্নাম হতে মুক্তি কামনা করা। যেমন- হে আল্লাহ আমরা আপনার নিকট জাহান্নাম হতে মুক্তি চাই। (সহীহ ইবনে খুযায়মা-১৮৮৭)
আমরা উপরোক্ত চারটি আমল এভাবে করতে পারি
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, অস্তাগফরিুল্লাহ, আল্লাহুমা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা, ওয়া নাউজু বিকা মিনান্নার।

রমযান উপলক্ষে ৫টি বস্তু দান
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পবিত্র রমযান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু দেয়া হয়েছে যা পূর্ববর্তী উম্মতগণকে দেওয়া হয়নি। যথা-
১। রোযাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মৃগনাভী হতেও বেশী প্রিয়।
২। ফেরেশতারা রোযাদারদের জন্য ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে।
৩। জান্নাত রোযাদারদের জন্য প্রতিদিন সজ্জিত করা হয় এবং আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লাশে যাতনা দুরে নিক্ষেপ করে অতি তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসছে।
৪। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমযান মাসের প্রথম রজনীর যখন আগমন ঘটে তখন শয়তান ও অসৎ জিনগুলোকে বন্দি করা হয়। যার ফলে সে ওই সব পাপ করতে পারেনা যা অন্য মাসে করতে পারতো। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে আর তা খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে তা আর বন্ধ করা হয় না। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও! এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (জামে আত-তিরমিযী)
৫। রমযানের শেষ রাতে রোযাদারের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সাহাবারা আরয করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই ক্ষমা কি শবে ক্বদরে হয়ে থাকে? হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- না, বরং নিয়ম হচ্ছে শ্রমিক তার শ্রম শেষে পারিশ্রমক পায়। (মুসনাদে আহমদ : ৭৯০৪)

রমযানের তারাবীহ নামায
নিয়মতি তারাবীহ পড়া এ মাসের বিশেষ আমলের মধ্যে অন্যতম। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে ছওয়াবের আশায় রমযানেরর রাতে দ-ায়মান হয় অথাৎ তারাবীহ এর নামায পড়ে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী : ২০০৯)

রমযানের ফযীলত থেকে মাহরুম
মুসলমান হয়ে যে ব্যক্তি কাফেরদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখল, যেমন- রমযানের অবমূল্যায়ন করল, রমজানে পানাহার করল, রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এমন কাজ করল অথবা এমন কাজ করল যার দ্বারা রোযার সওয়াব কমে যায়, যেমন- গীবত, চোগলখুরীতে লিপ্ত হল, মিথ্যা সাক্ষ্য দিল বা তার মজলিসে উপস্থতি হল, তার ব্যাপারেও আশঙ্কা করা যায় যে সে রমযানের ফযীলত থেকে মাহরুম হবে, তার জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হবে না, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হবে না এবং তার জন্য শয়তানদেরও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে না। যে ব্যক্তি এ মাসকে অবহেলায় অতিবাহিত করল রোযা রাখলোনা, নামায পড়লো না, দান সাদকা করলো না, পবিত্র রমযান মাস তার জন্য অভিসম্পাত করে। যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- (ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমযান মাস পেলো অথচ এবাদত বন্দেগী করে সে আল্লাহ কাছে নিজের গুনাহকে ক্ষমা করিয়ে নিতে পারলো না)।

রমযানের নৈতিক শিক্ষার মাস
রমযান মাস আসলে স্বাভাবকিভাবে মানব সমাজে অনেক পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন মানব জাতিকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। পরর্বতী ১১টি মাস যাতে সে নিয়ম মাফিক চলতে পারে তারই একটা ট্রেনিং হিসেবে পবিত্র রমযান মাস মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রতি বছর একবার করে ঘুরে আসে। যে ব্যক্তি এ মাস কে গুরুত্ব সহকারে অতিবাহিত করবে সে পরর্বতী ১১টি মাস সকল কাজই মহান আল্লাহর রেজামন্দী মোতাবেক করতে সক্ষম হবে। যে ব্যক্তি এ মাসকে অবহলোয় অতিবাহিত করল রোযা রাখলোনা, নামায পড়লো না, দান ছাদকা করলো না, পবিত্র রমযান মাস তার জন্য অভিসম্পাত করে। যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমযান মাস পেলো অথচ এবাদত বন্দেগী করে সে আল্লাহ কাছে নিজের গুনাহকে ক্ষমা করিয়ে নিতে পারেলা না। তাই প্রত্যেকে মানুষের উচিত পবিত্র মাহে রমযানকে যথাযথভাবে এবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। এবাদত এর পরিমাণ বৃদ্ধি করা, পবিত্র আল কুরআন অধ্যয়ন করা, নফল এবাদত বেশি পরিমাণে আদায় করা। সকল পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হাত, মুখ, চোখ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা যেন কোন প্রকার গুনাহ সংঘটিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা। কেননা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- অনেক রোযাদার আছে যাদের রোযা উপবাস ছাড়া কিছুই হয়না। কতিপয় লোক আছে যারা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে তাদের এ নামায রাত জাগ্রত ছাড়া কোন উপকারে আসে না। এর কারণ হচ্ছে যারা রোযাও রাখে আর অন্যান্য পাপ কর্ম ছাড়তে পারে না তাদের এ রোযা ঐ ব্যক্তির কোন উপকার করতে পারে না। তাই রোযা রাখতে হবে হক আদায়সহ। অর্থাৎ সকল অপর্কম পরিত্যাগ করতে হবে এবং পরর্বতী সময়ে যেন এর ফলাফল বিদ্যমান থাকে তার সার্বিক ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে যদি রোযার মাসকে হক আদায় করে রোযা রাখা যায় তাহলে ঐ ব্যক্তি তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর তাকওয়া একবার যদি কারো মাঝে এসেই যায় তার হইকাল ও পরকাল উভয় জগতে সফলতা লাভ করতে পারবে। তাকওয়া অর্জন করতে বেশি এবাদত করা দরকার। যে ব্যক্তি এ মাস কে গুরুত্ব সহকারে অতিবাহিত করবে সে পরর্বতী ১১টি মাস সকল কাজই মহান আল্লাহর রেজামন্দী মোতাবেক করতে সক্ষম হবে।

রোযা বা সিয়াম
রমযান মাসে রোযা রাখা সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ ‘ফামান শাহিদা মিনকুমুশ্ শাহা ফাল্ ইয়াসুম্হু’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি রোযার মাসটি পাবে, তারই কর্তব্য হচ্ছে রোযা রাখা। [বাক্বারা : ১৮৫] রমযান মাসে রোযা রাখা ফরয। রোযা শুধু পানাহার কিংবা সহবাস ত্যাগের নাম নয়। রোযা হলো মানসিক, ব্যক্তিগত সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক দৈনন্দিন কাজ-কর্মে সৃষ্ট পাপাচার এবং সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান-মদের ব্যবসা মিথ্যাচার ইত্যাদি ত্যাগের নাম। যতটুকু নিজেদের আয়ত্বে ততটুকু অবশ্যই সাথে সাথে ত্যাগ করে তাওবাহ করতে হবে। শপথ নিতে হবে আগামীতে না করার। কাকুতি করে সত্য পথে চলার সাহায্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। অবশ্য যা নিজের আয়ত্বের বাইরে, তার জন্য আল্লাহ ক্ষমাশীল, তবে চেষ্টা করতে হবে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পাপাচার বন্ধের। যদি সাধ্যমতো চেষ্টাও না করা হয় তবে দায়ী থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-যে রোযাদার রোযা রেখে মিথ্যা কথা এবং অন্যায় পাপাচার থেকে বিরত থাকে না তবে এমন রোযাদারের আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ আল বোখারী) শুধু আল্লাহর ভয়েই বান্দা পানাহার থেকে বিরত থাকে। নইলে পৃথিবীর কোন শক্তি এমন আছে যা তাকে গোপনে এক ঢোক পানি পান করা থেকে বিরত রাখতে পারে? রোযাদার পিপাসায় কাতর হয়, ওযুর জন্য মুখে পানি নেয়, কিন্তু এক কাতরা পানি হলকের নিচে নামতে দেয় না। কার ভয়ে, কার মুহাব্বতে? একমাত্র আল্লাহতায়ালার ভয়ে, আল্লাহতায়ালার মুহাব্বতে। কেউ দেখলো না, কিন্তু’ আল্লাহ তো দেখছেন। কেউ জানছে না, কিন্তু’ আল্লাহ জানছেন। আহা! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এই অনুভূতি লাভ করতে পারতাম! এজন্যই তো রোযার প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। তাঁর শান অনুযায়ী। যে কোনো দায়িত্ব¡ ও করণীয় সঠিকভাবে শুদ্ধভাবে করায় নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধ মেন চলা জরুরি। নিয়ম-পদ্ধতি ও শর্ত না মেনে যথাযথভাবে কোনো কিছুই সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। হযরত সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, শা’বান মাসের শেষ দিন রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদিগকে খুৎবা শোনালেন, যাতে তিনি বললেন ‘হে জনগণ! তোমাদের ওপর একটি মহান ও পবিত্র মাস আসছে, যার মধ্যে এমন একটি রাত্র রয়েছে যা হাজার রাত্র হতেও উত্তম।’ ‘যে মাসের দিনগুলোতে আল্লাহ রোযাকে ফরয করেছেন এবং রাত্রিতে নামায (তারাবীহকে) নফল করেছেন (উম্মতের জন্য সুন্নত)।’ আমাদের রমযানের রোযা এবং নামাযগুলো- যেন আনুষ্ঠানকিতায় পর্যবসিত না হয়, যেন না হয় কোন প্রাগত অভ্যাসের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমাদের নামায এবং রোযা যেন হয় আল্লাহ প্রেমের সচেতন বহিঃপ্রকাশ। আমাদের রোযা যেন হয় সে রোযা যে সম্পর্কে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন,“বনি আদমের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য, শুধু রোযা ছাড়া। রোযা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দবি।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।

রোযার উদ্দেশ্য
রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে : হে ঈমানদারগণ, তোমাদের প্রতি রোযাকে ফরয করে দেয়া হলো যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (বাকারা : ১৮৩) মুত্তাকী বলা হয় তাদেরকে যারা আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর সকল কথা, কাজ ও চিন্তাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে চলে। এজন্য কুরআন নাযিলের এ মাসে রোযা ফরয করে দিয়ে মুত্তাকী বানানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলইে তাকওয়া অর্জন হবে না। বরং তাকওয়া অর্জন করতে হলে এর পাশাপাশি সকল অন্যায় কথা, কাজ, ভাব-চিন্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন প্রভৃতি একেবারেই বর্জন করতে হবে এবং এ অন্যায় বর্জন সময়ে কি নয় বরং স্থায়ী স্বভাবে পরিণত করতে হবে। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি অন্যায় কথা ও কাজ বর্জন করে না তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ আল বুখারী) ইসলাম ধর্মে সিয়াম সাধনার বিধান রাখা হয়েছে আল্লাহভীতি সৃষ্টি ও তাকওয়া চর্চার উদ্দেশে। কুরআন কারীমে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন। আর তাকওয়া হলো মনের ওই অবস্থা যার প্রেরণায় পাপের প্রতি মানুষের প্রচ- বিরাগ ও পুণ্যরে প্রতি প্রবল অনুরাগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পশুসূলভ প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সাধারণত দুর্বল ও কমজোর হয়ে পড়ে, তাই রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে স্বতর্স্ফূতভাবে তাকওয়ার হালত বা আল্লাহ ভীতির অবস্থা তৈরী হয়ে যায়। এ ছাড়া রমযানুল মুবারকে তারাবীহ সালাতের সৌজন্যে আল-কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত বেড়ে যায়। সাওম পালনের উদ্দেশে যে অভুক্ত থাকার প্রভাবে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতার মানসিকতা প্রবল হয়। সাওম ও নিছক উপবাসের মধ্যে ব্যবধান তৈরীর মানসে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ে পুরুষদের এবং মুস্তাহাব ওয়াক্তে উত্তমরূপে সালাত আদায়ে মহিলাদের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। যিকরি-ফিকরি, আল্লাহর ইয়াদ ও তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা ও ইস্তিগফার, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ এবং কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে যদি মরণ, কবর জীবন ও পরকালরে অবশ্যম্ভাবী অবস্থাদির কথাও স্মরণ করা হয় তবে তো সোনায় সোহাগা। সারা বছর মানুষ শয়তানের কু-আচরণের কারণে কিছু না কিছু গুনাহ করে থাকে। রোযার এক মাসে সাধনা করলে ঐ সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এই তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর উপর ঈমান, তার গুণাবলীর দয়া অনুগ্রহের গভীরে অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তার অন্যগুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়।
তাকওয়া শব্দের অর্থ হলো পরিত্যাগ করা, আত্মরক্ষা করা ও খোদাভীতি। পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয়, মহান আল্লাহর ভয় অন্তরে সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে সকল অপর্কম থেকে বিরত রাখা এবং সকল কর্তব্যসমূহ পালন করা। আল্লাহতায়ালা তাকওয়া অর্জনরে জন্য বহুবার মানুষকে তাগিদ প্রদান করেছেন পবিত্র আল কুরআনের মাধ্যমে। যেথায় বলা হয়েছে-
১. হে ইমানাদারগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (ইমরান-১০২)
২. নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সে যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু।
৩ .হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে আগামী দিনের জন্য কি প্রস্তুত করেছে, আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত। (হাশর : ১৮)
৪. হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের অর্ন্তভুক্ত হও (তওবা : ১১৯)।
৫. অন্য আয়াতে রয়েছে-নিশ্চয়ই আল্লাহ যারা মুত্তাকী এবং যারা সৎকর্মপরায়নশীল তাদের সাথে রয়েছেন। (নাহল : ১২৮)
৬. তোমরা সৎ ও তাকওয়ার ব্যাপারে সহযোগীতা কর তোমরা পাপ ও সীমালংঘনের কর্মে সহযোগীতা করনা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা (মায়েদা: ২)।
৭. হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার। (বাকারা : ১৮৯)
৮. হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং আপনি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। (আহযাব : ১)
এছাড়াও অসংখ্য আয়াত রয়েছে যা দ্বারা আল্লাহতায়ালা মানব জাতি এমন কি রাসূলুল্লাহকেও তাকওয়া অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যা দ্বারা তাকওয়া অর্জনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বুঝা যায়। কেন না তাকওয়া অর্জন ছাড়া একজন মানুষ মুমিনই হতে পারে না। তাকওয়া দ্বারা মানুষের গোটাজীবন পরিচালিত হয়। তাই যার মাঝে তাকওয়া নেই সে তার গোটা জীবন কুফরী অবস্থায় অতিবাহিত করে। পক্ষান্তরে যার মাঝে তাকওয়া রয়েছে তার গোটাজীবন পরিচলিত হয় মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত আদর্শ মোতাবেক। তাই মানুষকে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্বপ্রথম তাকওয়া অর্জন করতে হবে। কেননা তাকওয়া দ্বারাই প্রতিটি মানুষ স্ব-মহিমায় অবস্থান করতে পারে। তাকওয়া দ্বারা শুধু পরকালে লাভ রয়েছে এটাই শেষ কথা নয়। পার্থিব সুখ-শান্তি বজায় রাখতে হলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া অর্জন করার গুরুত্ব ও তাৎর্পয কতটা ব্যাপক তা সূক্ষ্মভাবে আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন পূর্ববর্তী যত রসূল ও রাসুল এ ধারায় আগমন করেছেন তাঁরা সকলইে তাঁর স্বীয় জাতিকে সর্বপ্রথম যে দাওয়াত পেশ করেছিলেন তার মধ্যে আল্লাহকে উপাস্যরূপে গ্রহণ এবং তাকওয়া অর্জনই ছিল মূল বিষয়।
১.হযরত হুদ আলাইহিস সালাম এর সম্পর্কে বলা হয়েছে-স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন হুদ তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন তোমরা কি তাকওয়াশীল হবে না? (শুয়ারা : ১২৪)।
২.অন্য আয়াতে হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন সালেহ আলাইহিস সালাম তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূলুল্লাহ। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (শুয়ারা : ১৪২)।
৩.তেমনি অন্য আয়াতে হযরত লুৎ আলাইহিস সালাম এর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- (লুদকে তার সম্প্রদায় মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যে রাসূল হিসেবে এসেছিল। যখন সে তাঁর সম্প্রদায়কে তোমরা কি মুত্তাকী হবে না? আমি তোমাদের নিকট বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (শুয়ারা : ১৬১)।
৪.অন্যত্র হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন শোয়াইব আলাইহিস সালাম তোমরা কি মুত্তাকী হবে না? আমি তোমাদের নিকট বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (শুয়ারা : ১৭৭)। আমাদের জীবনতো রমযানের কারনে ভরে উঠা উচিত মুত্তাকীদরে গুনাবলীতে। কত রমযান হয়তো আমরা পার করে দিয়েছি। কিন্তু তাকওয়া কি সত্যিই আমরা অর্জন করেছি? বছরের প্রতিটি মাসইতো আমরা হেলা-ফেলায় কাটিয়ে দিই। তাই আসুননা এই রমযানের মাসকে তার পরিপূর্ণ গুরুত্ব সহকারে পালন করি, যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। আমাদের রমযানেরদিনগুলো যদি বছরের অন্যদিনগুলো থেকে ভিন্নতর না হয় তবে আমরা সুস্পষ্ট ক্ষতিতে নিমজ্জতি হব। একটা হাদীসের অংশ বিশেষের মানে হলো যে রমযান মাস পেলো এবং তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারেলোনা সে ধ্বংস হোক।” আমাদেরকে তো এ মাসের প্রতিটি মুহুর্তের সদ্ব্যবহার করতে হবে যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি, যা আমাদেরকে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন করতে সাহায্যে করবে।

রোযা রাখার ফযীলত
কুরআনের আলোকে-
রমযানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফযীলত হলো সমস্ত মাস রোযা রাখা ফরয। প্রতিটি রোযায় মহান আল্লাহ পাক অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের তালিকাভুক্ত করেন।
১. মহান আল্লাহ বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী রাসূলদের উম্মতগণের উপর। আশা করা যায়। তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে। (বাকারা : ১৮৩)
২. রমজান মাস, ইহাতেই কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে, তা গোটা মানব জাতির জন্য জীবন যাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলিতে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিস্কাররূপে তুলে ধরে। (বাকার : ১৮৫)
৩. রোযার সময় রাত্রিবেলা স্ত্রীদের সাথে সঙ্গম করা তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তারা তোমাদের পক্ষে পোষাকস্বরূপ আর তোমারও তাদের জন্য পোষাকস্বরূপ। (বাকারা : ১৮৭)
৪. আর রাত্রি বেলা খানা-পিনা কর যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের সম্মুখে রাত্রির হতে প্রভাতের শেষ আভা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তখন এসব কাজ পরিত্যাগ করে তোমরা রোযা পূর্ণ করে লও। (বাকারা : ১৮৭)
৫. আজ হতে যে ব্যক্তিই এ মাসের সম্মুখীন হবে তার পক্ষে পূর্ণ মাসের রোযা রাখা একান্ত কর্তব্য। আর যদি কেহ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ কার্যে ব্যস্ত থাকে তবে সে অন্যান্য দিনে এ রোযা পূর্ণ করে লয়। (বাকারা : ১৮৫)
হাদীসের আলোকে-
১. রোযা ও কুরআনের শাফা‘আত
১. রোযা রোযাদারদের জন্য সুপারিশ করবে: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে : আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে : আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দু’জনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ-৬৫৮৯; তাবারানী ও মাজমাউযে যাওয়াইদ ৩/৪১৯।)
২. হযরত আবদুল¬াহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রোযা ও কুরআন রোযাদার বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। রোযা বলবে : হে আল্লাহ! আমিই এই লোকটিকে রোযার দিনগুলোতে পানাহার ও যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা হতে বিরত রেখেছি। অতএব তুমি এর জন্য আমার শাফা‘আত কবুল কর। আর কুরআন বলবে : হে আল্লাহ! আমিই তাকে রাত্রিকালে নিদ্রামগ্ন হতে বাধাদান করেছি। কাজেই তার জন্য আমার শাফা‘আত গ্রহণ কর। রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন অত:পর এই দুইটি জিনিসের শাফা‘আত কবুল করা হবে। (সুনানে বায়হাকী ও শুযাবল ঈমান)
৩. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “কিয়ামতের দিন রোযা বা সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বা সিয়াম বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ ’’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৬)
রোযা: যে লোক সত্যই রোযা পালন করবে, তার জন্য স্বয়ং রোযাই কিয়ামতের দিন শাফা‘আত করবে। জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন জানাবে। বস্তুত রোযা আল্লাহরই ফরয করা কর্মানুষ্ঠান। দুনিয়ায় ইহার কোন দৈহিক অস্তিত্ব পরিলক্ষিত না হলেও কিয়ামতের দিন ইহা শশরীরে দাঁড়াবে এবং কাহারও পক্ষে তাঁর কোন আবেদন নিবেদন যে আল্লাহর নিকট গ্রাহ্য হবে, তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না।
কুরআন: অনুরূপভাবে যে লোক রাত্রিগুলোতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করবে বা অন্যের তিলাওয়াত মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং এই কুরআন তিলাওয়াতের জন্যই যে লোক রাত্রির মধু নিদ্রা পরিহার করবে, কুরআন শরীফ নিজেই তার পরকালীন মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট বলিষ্ঠ সুপারিশ পেশ করবে। কুরআনশরীফ আল্ল¬াহর নিজের কালাম। ইহা যার মুক্তির জন্য আল্ল¬াহর দরবারে সুপারিশ রাখবে, তা যে তাঁর নিকট সাদরে গৃহীত হবে, তা নি:সন্দেহেই বলা যায়। বস্তত যে বান্দা কিয়ামতের দিন এই দুইটি মহান জিনিসের সুপারিশ ও শাফা‘আত লাভ করবে, সেই লোক যে কত বড় সৌভাগ্যবান, তা বর্তমান সময়ে অনুধাবন করতে না পারলেও কিয়মাতের দিন অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠবে।
অতএব এই সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য এই দুনিয়ায় যেমন রোযা থাকা আবশ্যক, তেমনি রাত্রিকালে কুরআন তিলাওয়াত করাও বাঞ্ছনীয়।
২.রোযা বা সিয়াম জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল
রোযা ঢাল; এ ঢাল যেন অক্ষুন্ন থাকে। কীভাবে এই ঢালকে বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করা যায় তা রোযাদারকে জানতে হবে।
১.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ঢাল স্বরূপ। (সহীহ মুসলিম : ১১৫১ ও ইবনে মাজাহ : ১৬৩৯)
২. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রোযা ঢাল স্বরূপ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ। রোযার বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। অন্যান্য নেক কাজের বিনিময় গুনা মাফ করা হবে। কিন্তু রোযার বিনিময়ে শুধু গুনা মাফ নয়, বরং জান্নাতে প্রবেশের উপায় হিসাবে ব্যবহা করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ)
৩.অন্য হাদীসে আছে, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের মতো রোযা জাহান্নাম থেকে ঢাল। রোযা যেহেতু জাহান্নাম থেকে ঢাল সুতরাং তা আমাকে অক্ষুন্ন রাখেত হবে এবং কী করলে তা ভেঙ্গে যায় তাও জানতে হবে। এক হাদীসে এসেছে, রোযা ঢাল যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়। (মুসনাদে আহমদ : ১৬৯০)
৪. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হচ্ছে ঢাল। যখন তোমাদের কেউ রোযা থাকে সে যেন অশ্লীল কথার্বাতা না বলে এবং মুর্খের ন্যায় কাজ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে যেন বলে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার। (সহীহ আল বুখারী : ১৯০৪ ও সহীহ মুসলিম : ১১৫১)
৫.অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহ আল বুখারী : ১৯০৩)
৬.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তিতে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরী করেন। (সহীহ আল বুখারী : ১৮৯৪)
৭.ইমাম আহমাদ রহ. তার কিতাবে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সিয়াম প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাঁচার জন্য ঢাল এর মাধ্যমে বান্দা আগুন থেকে মুক্তি পায়।
৮.ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: হে যুবকেরা! যে সার্মথ রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা দৃষ্টিকে সংরক্ষণ করে এবং যৌনাঙ্গরে হিফাজত করে। যে বিবাহের সামর্থ রাখে না সেযেন সিয়াম পালন করে। কেননা এটি তার জন্য সুরক্ষা। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।
৯.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোযা ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ কোনদিন রোযা রাখলে তার মুখ থেকে যেন খারাপ কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে বা বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় সে যেন বলে আমি রোযাদার। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৩.রোযা বা সিয়াম জান্নাত লাভের পথ
১. ইবনে হিব্বানে বর্ণিত আছে আবু উমামা জিজ্ঞেস করলেন আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি রোযা রাখ। রোযা তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশা নিয়ে রমযানের সিয়াম অর্থাৎ রোযা পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গোণাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে আত-তিরমিযী, আন-নাসাঈ, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমদ)
৩. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না.. রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ আল বুখারী : ১৭৯৭)
৪. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর কোন তুলনা নেই। জান্নাতে একটি দরজা আছে সেখান দিয়ে শুধু সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সাহল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: জান্নাতের একটি দরজা আছে। তাকে বলা হয় রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল মাত্র রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে রোযাদারগণ কোথায়? তখন রোযাদারগণ দাঁড়িয়ে যাবে, তাদেরকে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হবে। রোযাদারগণ প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তারপর এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (সহীহ আল বুখারী: ১৮৯৬ ও সহীহ মুসলিম)
৫. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : জান্নাতের মোট আটটি দরজা আছে, তার মধ্যে একটি দরজার নাম হচ্ছে রাইয়্যান, সে দরজা দিয়ে রোযাদার ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা। (সহীহ আল বুখারী : ৩২৫৭)
৬. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবে : হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে। মুজাহিদদের কে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদারদেরকে ডাকা হবে রাইয়্যান দরজা হতে। দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলি দরজা থেকে ডাকা হবে..? যদিও এর কোন প্রয়োজন নেই। জবাব দিলেন হ্যাঁ। আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অর্šÍভূক্ত হবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৪.রোযা রাখা গোনহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ
ভাল কাজ অন্যায়কে মুছে দেয়।
১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্বের সগীরা গুনাহসমূহ মাফ করা হবে এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে রমযানের রাত্রি ইবাদতে কাটাবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে ক্কদরের রাত্রি কাটাবে তার গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম:১৯১০)
২. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রমযান হচ্ছে এমন একটি মাস মাতৃগর্ব হতে শিশু যে রূপ নিষ্পাপ হয়ে ভূমিষ্ট হয়, রমযানের ৩০টি রোযা পালন করলে বান্দা ঠিক সেরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায়।
৩.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি রমযানের খাঁটিভাবে রোযা রাখে, তার বিগত রমযানের তারিখ হতে এ তারিখ পযর্ন্ত সমস্ত সগীরাহ গোনাহ মাফ করে দেয়া হয় এবং আল্লাহতায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়। তারা তার জন্য ফজরের নামাজের পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে।
৫.সিয়াম ইহকাল এবং পরকালের সৌভাগ্যের কারণ
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“রোযাদারের জন্য দুটো খুিশর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভূ আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ আল বুখারী : ১৮০৫)
২. ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “জিবরাইল আলাইহিস সালাম রামযানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন।” (সহীহ আল বুখারী : ৩০৪৮) রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামরে সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সিরাত অনুসরণ করে প্রত্যেকে মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা, বোঝা এবং আমল করা।
৬.রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যার হাতে মুহাম্মাদরে প্রাণ তার শপথ! রোযাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধীময়।’’ (সহীহ আল বুখারী : ১৮৯৪)

৭.রোযাদারদের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না
বিশেষ সময় ও মওসুমে দোয়া বেশি কবুল হয়। অনুরূপভাবে বিশেষ স্থান এবং বিশেষ ব্যক্তির দোয়াও কবুল হয়। পবিত্র রমযানে দোয়া অধিক কবুল হয়। এ ছাড়াও বিশেষ স্থান, যেমন মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা, জমজম কূপ, সাফা, মারওয়া পাহাড়, মিনা, মোযদালেফা ও আরাফাতে এবং মিনার তিন জামরাহর নিকট দোয়া কবুল হয়। বিশেষ ব্যক্তি ও অবস্থা যেমন, রোযাদার ইফতার করা পর্যন্ত, ইফতারের সময়, ক্বাবা শরীফ দেখার সময়, ভোর রাতে, তাহাজ্জুদের সময় এবং শুক্রবারে দোয়া বেশি কবুল হয়।
রমযান ফযীলতের মাস। এ মাসে যাবতীয় ভোগ লালসা থেকে বিরত থেকে আল্লাহ বিধান পালনের কারণে রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। তিনি দোয়া করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেন। তাই রমযানে আল্লাহর নিকট অধিক পরিমাণে দোয়া করা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-রোযাদারের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না, অর্থাৎ কবুল করা হয়।
তাই রমযানে অধিক পরিমাণে দোয়া করা আবশ্যক। ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজের জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। দোয়া করতে অবহেলা করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে গাফেল থাকা। অথচ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাতের শেষাংশে আল্লাহ প্রথম আসমানে আগমন করেন এবং জিজ্ঞেস করেন, কোন প্রার্থনাকারী আছে কি যাকে আমি দান করবো? কোন দোয়াকারী আছে কি যার দোয়া আমি কবুল করবো? এবং গুনাহের জন্য কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমি যার পাপরাশি ক্ষমা করবো? এ অপূর্ব সুযোগ একজন ঈমানদার হাতছাড়া করতে পারে না?
ক. হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না (১) রোযাদারের দোয়া ইফতার করা পর্যন্ত, (২) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের দোয়া, (৩) মজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার উজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই কদরে সাহায্যে করব। (মুসনাদে আহমাদ : ৯৭৪৩; জামে আত-তিরমিযী : ৩৫৯৮; ইবনে হিব্বান : ৩৪২৮ ও ইবনে মাজাহ : ১৭৫২)
খ. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(রমজানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমযান মাসে করে থাকে)।’’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)
গ.আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস থেকে বর্ণিত। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-ইফতারের সময় রোযাদারের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। তাই ইফতারের সময় সকলেরই উচিত অধিক পরিমাণে দোয়া করা। (ইবনে মাজাহ :১৭৫৩ )
ঘ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু ইফতারের সময় নি¤েœাক্ত দোয়া পড়তেন ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার ঐ রহমতের ওছিলায় প্রার্থনা করছি, যা সকল বসতে পরিব্যাপ্ত, আমাকে ক্ষমা করে দিন। (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩, ১৬৪৩ ও আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ : ৪৮১)
ঙ. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে ক্বদরে পড়ার জন্য একটি দোয়া শিখিয়েছেন। শেষে দশকের রাতে এই দোয়া বেশি বেশি পড়া উচিত। ইফতারের পূর্বেও তা পড়া যায়।
১.“আল্ল¬াহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি”। অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমাকে পছঁন্দ কর। অতএব আমাকে ক্ষমা করো।
২.“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আ‘ফুউন কারিমুন তুহ্বিবুল আ’ফওয়া ফাফু আ’ন্না। অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়, ক্ষমাকে তুমি পঁছন্দ কর, কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও
চ.প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এটা প্রতি রাতে।
ছ.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় নানা রকমের দোয়া করেছেন। মুয়াজ বিন যাহরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-আল্লাহুম্মা লাকা সমতু ওয়ালা রেজকিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়াআর হামার রাহেমীন।
জ.আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-পিপাসা দূর হয়ে গেছে, অন্ত্রনালী পানি ভিজেছে এবং ইনশাআল্লাহ পারিশ্রমিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (আবু দাউদ কিতাবুস সিয়াম,আন-নাসাঈ ও হাকেম)
ঝ.আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ বিন মোয়াজের ঘরে ইফতার করেন। ইফতারের সময় তিনি বললেন-তোমাদের নিকট রোযাদারগণ ইফতার করেছে, নেক বান্দাগণ তোমাদের খাবার গ্রহণ করেছে এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য রহমত ও বরকতের দোয়া করেছে। (ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ও আবু দাউদ)
ঞ.আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-হে আল্লাহ! আমি তোমাদের রহমত কামনা করি যা সকল বস্তুর ও বিস্তৃত। তুমি আমার পাপরাশি ক্ষমা কর (ইবনে মাজাহ ও হাকেম)
৮.রোযাদার ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে দুরে
১. হযরত সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তাকে দোযখ থেকে সত্তর বছর দূরে রাখবে। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে আত-তিরমিযী, আন-নাসাঈ, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমেদ)
২. হযরত আবু উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬ামকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে তার ও জাহান্নামের মধ্যে আল্লাহ একটি পরিখা সৃষ্টি করবেন যা আসমান ও যমীনের দূরত্বের সমান । (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও জামে আত-তিরমিযী)
৯.রোযার প্রতি রাতে কতক ব্যক্তিকে মুক্ত করা হয়
১. রমযানের প্রত্যেকে রাতেই আল্লাহতায়ালার কতক মুক্ত বান্দা থাকে। তারাই মুক্তি পাওয়ার বেশি হকদার, যারা রোযা রাখে ও তা হেফাজত করে, যারা রমজানে কেয়াম করে ও তার মধ্যে ইহসান রক্ষা করে, আল্লাহর মহব্বত ও তার সওয়াবের আশায় এবং তার শাস্তির ভয়ে বেশি বেশি নেক আমল করে।
২. জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এসব বান্দাদের জন্য আল্লাহর নিকট একটি করে কবুল দোয়ার ওয়াদা রয়েছে। তারা দু’টি কল্যাণপ্রাপ্ত হল : কবুল দোয়া ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি।
১০.বেশী বেশী করে দোয়া ও ইস্তেগফার করুন
রমযানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। রোযাদার ব্যক্তির উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা বেশি বেশি দোয়া, যিকির ও ইস্তেগফার করা। কেননা রোযাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। ইফতার তাড়াতাড়ি করা এবং তখন দোয়া করা উত্তম। ইফতারের সময় হওয়ার কিছু পূর্বেই দস্তখানে বসা উচিত। কত সুন্দর দৃশ্য! সামনে কত রং বেরংয়ের খাবার, কিন্তু’ বান্দা সেদিকে হাত বাড়াচ্ছে না শুধু রবের অনুমতির অপক্ষোয়। আহা! দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতিও যদি রবের অনুমতি ছাড়া হাত না বাড়াতাম! ইফতারের পূর্ব মুর্হূতে বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তিগফার করা উচিত।
এক হাদীসে এসেছে, ‘রোযাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রমযানে রোযাদারকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে শেষে রাত দোয়া ও ইস্তেগফারের সবচেয়ে উপযাগী সময়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন আল্লাহতায়ালা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (সহীহ আল বুখারী : ১১৪৫ ও সহীহ মুসলিম : ৭৫৮)
১১.চোখ কান ও জবানকে হেফাজত করা
জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের কর্তব্য রোযা ভঙ্গকারী বা রোযার সওয়াব নষ্টকারী বস্তু থেকে দূরে অবস্থান করা এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে চোখ, কান ও জবানকে হেফাজত করা। আর মানুষতো নিজের অভ্যাসের গোলাম। যতই সে চেষ্টা করে ফিরে আসতে পারে না নফসের গোলামী থেকে। কেননা অভ্যাসের বিরাট প্রভাব রয়েছে অন্তর ও নফসের উপর। আমাদের অনেকের পানাহার, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে অনেক রকম অভ্যাস রয়েছে তার থেকে সে বিরত হতে পারে না। সিয়াম এই সমস্ত অভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিরাট উপকারী। মুসলমান ইচ্ছা করলে এর মাধ্যমে অনেক অভ্যাস থেকে নাজাত পেতে পারে কোন কষ্ট এবং ক্ষতি ছাড়াই। অত:পর যে সমস্ত অভ্যাস তার ক্ষতি করে সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। যেমন, রাত্রি জেগে অনুষ্ঠান উপভোগ করা, গোনাহ হয় এমন অনুষ্ঠানে যাওয়া, কারো সাথে অনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদির অভ্যাস করা। অর্থাৎ এ জাতীয় যত ধরণের নেশা জাতীয় অভ্যাস আছে তা পরিত্যাগ করা। মূলত এ সমস্ত কিছু হয় দুর্বল মানসিকতার কারণে, অথবা এগুলোর নিকট আত্মসর্মপনরে কারণে। সুস্থ, ভদ্র ও বিবেকবানরা কখনও এমন কাজ করতে পারে না। যদি সিয়াম পালন করতে চাও তবে হিংসা, গোনাহ এবং অন্যায় থেকে বিরত থেকে সিয়াম পালন কর। সিয়াম অবস্থায় জিহবাকে অহেতুক কথা থেকে, দৃষ্টিকে হারাম থেকে বিরত রাখ। অনেক সিয়াম পালনকারী আছেন তার সিয়াম উপবাস এবং পিপাসিত থাকা ছাড়া আর কোন উপকারে আসে না। সে ঐ ব্যক্তি যে আহার বাদ দিল, কিন্তু গীবতের মাধ্যমে নিজের ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া থেকে বিরত হতে পারল না। পান করা থেকে বিরত থাকল কিন্তু মিথ্যা, ধোকা, মানুষের উপর অত্যাচার থেকে বিরত হল না।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আমল পরিত্যাগ করতে পারলো না, তবে এমন ব্যক্তির পানাহার পরিত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন। (সহীহ আল বুখারী)
১২.রোযা হচ্ছে হুরদের দেনমোহর
কোন বান্দাহ রমযানের রোযা রাখলে জান্নাতের মনিমুক্তা দ্বারা তৈরী তাবুতে হুরদের সাথে তাদের বিয়ে হবে। রোযা হচ্ছে হুরদের দেনমোহর।
১৩.জান্নাতে রোযাদারের জন্য সুবৃহৎ অট্টালিকা তৈরী
১. রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখে, দয়াময় আল্লাহপাক তাকে রোজ হাশরে একটি সুরম্য বৃহৎ জমরুদ পাথরের অট্টালিকা তৈরী করে দেবেন এবং এর এক হাজারখানা দরজা থাকবে এবং প্রত্যেক দরজায় একটি করে সুবৃহৎ বৃক্ষ থাকবে, যার ছায়াতে দীর্ঘ একশত বছর পযর্ন্ত ভ্রমন করলেও তা শেষ হবে না।
২. আবু মাসউদ গেফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হযরত মোহাম্মদ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: কোন ব্যক্তি যদি রমযান মাসে একটি রোযাও করে তবে তার পরির্বতে আল্লাহতায়ালা তার সাথে একজন হুরের বিবাহ দিবেন। এই হুর ঐ সমস্ত হুরের মধ্যে থাকবে যাদিগকে মোতির তাবুহে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ সমস্ত হুরগন সত্তর প্রকারে পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত থাকবে। উহার একটির রং অন্যটি হতে ভিন্ন হবে। উহাতে সত্তর প্রকার সুগন্ধি থাকবে। মাওয়ারিদ দ্বারা সেই পোশাকের প্রান্ত করা হবে। ইয়াকুত এর তৈরী সত্তরটি সিংহাসন থাকবে, প্রত্যেক সিংহাসনে বিভিন্ন প্রকারের সত্তরটি বিছানা থাকবে। প্রত্যেক হুরের জন্য সত্তর হাজার খেদমতগার থাকবে এবং তার স্বামীর জন্যেও সত্তর হাজার খেদমতগার থাকবে। প্রত্যেক খেদমতগার খাদ্যে পরিপূর্ণ এক একটি স্বর্ন পাত্র লইয়ে তাদের আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়ায়ে থাকবে। উক্ত পাত্রে রক্ষিত খাদ্যের প্রত্যেকটি গ্ল¬াসে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ থাকবে। রমযান মাসে রোযাকারী এই পূণ্যে পূণ্যবান হবে। ইহা ব্যতীত অন্যান্য কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পুরষ্কৃত করা হবে।

১৪. রোযাকে অস্বীকার করা/ রোযা না রাখা ফাসিক
কুরআন ও হাদীস থেকে রোযা ফরয হওয়া প্রমানিত যে ব্যক্তি আল্লাহ নির্দেশিত এ রোযার বিধানকে অস্বীকার করবে এবং শরীয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া রোযা রাখবে না, সে ফাসিক ও কবিরা গুনাহগার হবে (জঘন্য পাপী হিসেবে আল্লাহ কাছে ধিকৃত হবে)।
১. হযরত আবু হোরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাছে রমযান মাস সমুপস্থিত। ইহা এক বরকতময় মাস। আল্লাহতায়ালা এ মাসের রোযা তোমাদের ওপর ফরয করেছেন”।
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রমযান মাসের রোযা রাখাকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ বলা হয়েছে। রোযার অতীব আবশ্যকতা তথা এ ফরয বিধানকে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরয়ী ওজর (যৌক্তিক অপারগতা) বা রোগ ব্যতীত রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দেবে সে যদি পরর্বতীতে সারাজীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। (মুসনাদে আহমদ, জামে আত-তিরমিযী ও আবু দাউদ)
১৫.বিনা কারনে রোযা ভঙ্গ করা
১. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা কারনে বিনা অসুখে রমযান মাসের কোন একটি রোযা ভঙ্গ করে সে সারা জীবন রোযা রাখলেও তার এই রোযার কাযা আদায় হবে না। (সহীহ আল বুখারী)
২. রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরয়ী ওজর (যৌক্তিক অপারগতা) বা রোগ ব্যতীত রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দেবে সে যদি পরর্বতীতে সারাজীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। (মুসনাদে আহমদ, জামে আত-তিরমিযী ও আবু দাউদ)
১৬.রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন
পূর্ণ এক মাস বান্দা রোযা রাখল। প্রতিদিন ঘোষণা হচ্ছিল, ‘কে আছ ক্ষমার্প্রাথী, আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি ক্ষমা করে দিব।’ মাস শেষে। বান্দা তার মালিকের হুকুম পালন করেছে। এবার তাঁর পক্ষ থেকে আসছে ক্ষমার ঘোষণা।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: বনী আদমের প্রতিটি আমলের সওয়াব দশ থেকে সাতশতগুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন: তবে রোযাতো আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। সে আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে। রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ, একটি আনন্দ ইফতার করার সময়, আর একটি আনন্দ হবে তার প্রতিপালকের দীদার বা সাক্ষাৎ লাভের সময়। আর রোযাদারের মুখের (পেট খালি থাকার কারণে) গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম। রোযা ঢাল স্বরুপ সুতরাং কারো রোযা পালনের দিন সে যেন অশ¬ীল কাজ না করে, হই-চই না করে। যদি কেউ গালাগালি করে বা তার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে, তবে সে যেন বলে: আমি তো রোযাদার। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম: ১১৫১)
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে আল্লাহতায়ালা তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ আল বুখারী : ১৯০১; জামে আত-তিরমিযী : ৬৮৩ ও ইবনে মাজাহ : ১৩২৬)
৩. হাদীসে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দেবো।’’ (সহীহ আল বুখারী : ১৮০৫)

রোযার বিস্তারিত নিময়ম-কানুন
সঠিকভাবে রোযা রাখার জন্য, রোযাকে আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় ও পছন্দনীয় করতে শরীয়তের দিকনির্দেশনা জানা, বুঝা ও সেমতে আমল করা অতীব জরুরি। নিয়ম-পদ্ধতি না মেনে, কায়দা-কানুন না বুঝে ইচ্ছেমতো খেয়াল খুশিকে প্রাধান্য দিয়ে রোযা রাখায় কোনো ফায়দা নেই। স্বেচ্ছাচারিতায় ও নিয়মকানুন লঙ্ঘনের দ্বারা রোযার ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবার পূর্ণ আশঙ্কা থেকে যায়। তাই, রোযা যার ওপর ফরয বা অবশ্য কর্তব্য তাকে রোযার মাসআলা-মাসায়েল (নিয়ম-পদ্ধতি) জেনে নেয়াও ফরয হিসেবে গণ্য। অর্থাৎ রোযাদারকে রোযার সমস্ত র্শত করণীয় জানতে হবে। এখানে গাফিলতি বা উদাসীন হয়ে থাকা মানে নিজের অজান্তেই রোযাকে অন্তঃসারশূন্য শুধুই উপবাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনা। রোযার মাহাত্ম অর্জনে, আত্মার প্রশান্তি মেটাতে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাতে তাই যথাশুদ্ধভাবে রোযা রাখায় সচেষ্ট হতে হবে সর্বস্তরের রোযাদারকে। সর্তক থাকতে হবে, সামান্য উদাসীনতায় রোযা যেন নষ্ট না হয়, ছুটে না যায় যেন একটি রোযাওÑতীক্ষè দৃষ্টি থাকা চাই এদিকে।
রোযা কি?
ইসলামের প্রধান স্তম্ভ পাঁচটি। যার একটি রমযান মাসের রোযা। বাংলা অভিধানে রোযা অর্থ-উপবাস। ইসলামী পরিভাষায় এ অর্থ যথার্থ নয়। আমরা বাংলা অভিধানে উপবাসের অর্থ দেখতে পাই-অনশন, অনাহার ইত্যাদি। শুধু উপবাস, অনাহার, অনশনকে রোযা বলা যাবে না। রোযা শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে উর্দু-ফারসী থেকে। আরবী ভাষার ‘ছাওম’ শব্দ থেকে রোযা শব্দের উৎপত্তি। ছাওম’এর বহুবচন ‘ছিয়াম’। ‘ছাওম’ বা ‘ছিয়াম’এর আভিধানিক অর্থ হলো-বিরত থাকা, বিরত রাখা। ইসলামী পরিভাষায় ছাওম বা ছিয়াম অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সুবেহ সাদেকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার-সহবাস থেকে বিরত থাকা। (বাকারা : ১৮৭ ও সহীহ মুসলিম : ১/৩৪৯)
চাঁদ দেখে রোযা রাখা ও চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গা
১. রমযানের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোযা রাখা ফরয। (বাকারা : ১৮৩ ও ১৮৫; সহীহ মুসলিম : ১/৩৪৭) চাঁদ দেখা প্রসঙ্গ চন্দ্র মাস ২৯ কিংবা ৩০ দিনে হয়ে থাকে। ইংরজেী মাসের মতো চন্দ্র মাস ২৮ কিংবা ৩১ দিনে হয় না। যদি শাবান মাসের ২৯ তারিখে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায় তবে পরদিন থেকে রোযা রাখতে হবে। তেমনি রমযান মাসের ২৯ তারিখে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গেলে পর দিন ঈদ করতে হবে। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা না গেলে মাস ত্রিশা হিসেবে গণ্য হবে। ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যাক কিংবা না, তবু পরের দিন এক তারিখ হিসেবে গণ্য হবে। ২৯ তারিখের জাওয়াল পূর্ব কিংবা জাওয়াল পরর্বতীতে চাঁদ দেখা গেলে তা পরর্বতী দিন অর্থাৎ ৩০ তারিখের চাঁদ হিসেবে গণ্য হবে। ১. হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘তোমরা রোযা রাখ চাঁদ দেখলে। যদি মেঘের কারণে তা তোমাদের সামনে গোপন থাকে তবে শাবান ত্রিশ দিনে পূর্ণ করবে। (মোত্তাফাকুন আলাইহে)। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন কিংবা ধুলাচ্ছন্ন হয় তবে চাঁদ দেখার ব্যাপারে এমন এক ব্যক্তির স্বাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য যে আকলে, বালেগ, আদেল এবং মুসলমান। চাই সে আজাদ, গোলাম, নারী, পুরুষ যাই হোক। এই বিধান হলো রমযানের চাঁদের ক্ষেত্রে। ২. হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন হযরত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক বেদুইন এসে বললো আমি চাঁদ অর্থাৎ রমযানের চাঁদ দেখেছি। হুজুর তাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি এই সাক্ষ্য দাও যে আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই? সে বললো হ্যাঁ। পুনরায় হুজুর জানতে চাইলেন তুমি কি সাক্ষ্য দাও: যে মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল? সে বললো হ্যাঁ। হুজুর বললেন হে বেলাল! লোকদের মধ্যে ঘোষণা করে দাও তারা যেন (কাল) রোযা রাখে। (আবু দাউদ, তিরমিজী ও ইবনে মাজা)। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, একজন দ্বীনদারের সাক্ষ্য প্রমাণ করে দেবে রোযার চাঁদকে। কিন্তু ঈদের চাঁদ দেখার বিধান হলো দু’জন আকেল, বালেগ, আদেল পুরুষের স্বাক্ষী হওয়া। যদি একজন দ্বীনদার পুরুষ এবং দু’জন দ্বীনদার নারী স্বাক্ষ্য দেন, তবে শর্ত আদায় হয়ে যাবে। অন্যথায় ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না। যদি একজন দ্বীনদার পুরুষ কিংবা পুরুষ ব্যতীত চারজন দ্বীনদার নারী ঈদের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেন, তবে তা গ্রহণ যোগ্য হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগিরী, প্রথম খ-/বেহেশতী জেওর, তৃতীয় খ-)। যে লোক ইসলামী বিধান মান্য করে চলে না, অনবরত শরীয়তের খেলাফ কাজ করে, নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, মিথ্যা বলে, ঘুষ-সুদের সাথে জড়িত অর্থাৎ ইসলাম বিরোধী কাজের সাথে সম্পর্কিত, তার স্বাক্ষী ইসলামে গ্রহণযাগ্য নয়। ওরা শত কসম বা শতজনে বললেও বিশ্বাসযোগ্য হবে না। (প্রাগুক্ত) আকাশ পরিস্কার থাকার পরও যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে দু’তিন জনের স্বাক্ষী গ্রহণযাগ্য নয়। তবে প্রচুর লোক স্বাক্ষী দিলে যদি মনে হয়Ñএত লোক মিথ্যা বলতে পারেনা, তবে চাঁদ প্রমাণিত হয়ে যাবে। রোযা এবং ঈদ উভয় ক্ষেত্রের এ বিধান প্রযোজ্য। (প্রাগুক্ত) অনেক সময় দেশব্যাপী প্রচার হয়ে যায় যে, গতকাল চাঁদ দেখা গেছে। অথচ খুঁজে এমন একজনও পাওয়া যায় না; যিনি স্বচোখে চাঁদ দেখেছেন। শরীয়তে এমন গুজবের কোন মূল্য নেই। রমযানের চাঁদ যদি এমন কেউ দেখে যার সাক্ষ্য শরীয়তে গ্রহণযাগ্য নয়, তবে তার কথায় রোযা রাখা বা ঈদ করা যাবে না। কিন্তু যে দেখলো, সে রোযা রাখতে হবে। যদি এমতাবস্থায় অন্যদের ৩০টি এবং তার ৩১টি হয়ে যায়, তবু তার জন্য রোযাভাঙ্গা জায়েজ নয়। আবার অন্যদিকে কেউ যদি একা ঈদের চাঁদ দেখলে, তবু তার জন্য রোযাভাঙ্গা জায়েজ নয়। সবার সাথে তাকে ঈদ করতে হবে। (প্রাগুক্ত) যদি ৩০ রমযানের দিনে চাঁদ দেখা যায়, তবু রোযা ভাঙ্গা যাবে না। এটাকে সামনের রাতের চাঁদ মনে করে সূর্যাস্তের পর নিয়ম মতো ইফতার করতে হবে। যদি কেউ এমতাবস্থায় রোযাভাঙ্গে তবে অবশ্যই তার কাযা কাফফারা ওয়াজিব হবে। (বেহেশতী জেওর) ৩০ তারিখে চাঁদ দেখার পর অনেককে বলতে শোনা যায়, যেহেতু চাঁদ দেখতে বড় তাই এটা আজকের নয়, বরং গত কালকের। একটা রোযা খাওয়া হয়ে গেছে। হাদীসে এ ধরণের সন্দেহমূলক কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাবেয়ি আবুল বাখ্তারী (রহ.) বলেন ‘একবার আমরা ওমরাহ করতে বের হলাম। যখন আমরা (তায়েফ ও মক্কার মধ্যস্থলে) বেতœ নাখ্লা নামক স্থানে অবর্তীণ হলাম তখন সকলে মিলে চাঁদ দেখতে লাগলাম। লোকদের মধ্যে কেউ একজন বললো এটা তিন দিনের চাঁদ, কেউ বললো দু’দিনের। পরে আমার হযরত ইবনে আব্বাসের সাথে দেখা হলে বললাম আমরা রমযানের চাঁদ দেখেছি। লোকদের মধ্যে কেউ বলে এটা তিন দিনের, কেউ বলে দু’দিনের। তিনি বললেন, তোমরা কোন রাতে দেখেছো? আমরা বললাম অমুক রাতে। তিনি বললেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারিখ ধরতেন রাতকে। সুতরাং তা সেই রাতের চাঁদ, যে রাতে তোমরা দেখেছো। (সহীহ মুসলিম)

রোযার নিয়ত
রোযার নিয়ত না করে যদি কেউ সমস্ত দিন পানাহার এবং সহবাস থেকে বিরত থাকে তবে রোযা আদায় হবে না। রমযান মাসে প্রতিদিনের রোযার নিয়্যত পৃথকভাবে করতে হবে। রাত থেকে নিয়্যত করলে যদিও আদায় হয়ে যায় তবে উত্তম সেহরীর সময়ে নিয়্যত করা। রমজানে যদি প্রভাতে কিংবা দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত কারো রোযার নিয়্যত না হয় এবং এই সময় হঠাৎ মনে হয় ফরয রোযা ছেড়ে দেওয়া অন্যায়, তাই আমি রোযা ভাঙ্গবো না, আর ইতোমধ্যে সে কিছু পানাহার কিংবা সহবাস না করে, তবে ফরয রোযা আদায় হয়ে যাবে। রমযান মাসের রোযা ছাড়া এমন নিয়্যত গ্রহণযাগ্য নয়। অবশ্য আমাদের উলামায়ে কেরামদের মতে রমযান মাসের শুরুতেও যদি কেউ সমস্ত রোযার নিয়্যত করে নেয় তবু আদায় হয়ে যাবে।
রোযা রাখার প্রথম বা পূর্বশর্ত হচ্ছে নিয়ত। সহীহ নিয়ত ছাড়া রোযা কবুল হয় না। ইসলামে সৎকাজে নিয়ত করাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিয়তকে গুরুত্ব দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি কাজে দেহ ও আত্মার সমন্বয় সাধন করে কাজটিকে সর্বাধিক বাঞ্ছিত মানে উর্ত্তীণ করা। তাই রোযা রাখার পূর্বে অন্তরের অন্তস্থল থেকে নিয়ত করা অবশ্যই করনীয়। মানব জীবনে নিয়তের গুরুত্ব অনেক। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যেকটি আমল (র্কম) নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল বা সকল কাজের ফলাফল নিয়্যত অনুযায়ী পাবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) নিয়ত উচ্চারণ ঃ নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রামাদ্বনাল মুবারাকি ফারদ্বাল্লাকা ইয়া আল্লাহ ফাতাক্বাববাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সামীয়ু’ল আ’লীম। অর্থ-হে আল্লাহ! আমি ফরয রোযা তোমার জন্য রাখার নিয়ত করলাম। তুমি আমার নিয়ত কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি মহাশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।

নিয়্যতের আবশ্যকতা
নিয়্যতের আবশ্যকতা এবং নিয়ম রোযার জন্য পানাহার-সহবাস পরিত্যাগ যেমন-ফরয তেমনি নিয়্যতও ফরয। তবে নিয়্যতের জন্য মুখে উচ্চারণ কিংবা আরবী বাক্য উচ্চারণ জরুরী নয়। মনে মনে শুধু আল্লাহর নামে রোযা রাখার সংকল্প করলেই নিয়্যতের শর্ত আদায় হয়ে যাবে। (বেহেশতী জেওর)। তবে কেউ যদি সহীহ উচ্চারণে আরবী পারেন তবে তার জন্য আরবী বাক্য উচ্চারণ উত্তম।
১. রোযার নিয়ত করা জরুরি। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, সকল আমলই নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। (সহীহ আল বুখারী : ১/২)
২. সুবেহ সাদিকের পূর্বেই রোযার নিয়্যত করে নেওয়া উচিত। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/১৬৬)

রোযার প্রকাভেদ
রোযা পাঁচ প্রকার।
১. ফরয রোযা: যা আবার চার প্রকার-ক) রমযান মাসের রোযা। খ) কোন কারণ বশত: রমযানের রোযাভঙ্গ হয়ে গেলে তার কাযা আদায়ে রোযা। গ) শরীয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতিত রমযানের রোযা ছেড়ে দিলে কাফ্ফারা হিসেবে ৬০টি রোযা রাখা। ঙ) রোযার মান্নত করলে তা আদায় করা।
২. ওয়াজিব রোযা: নফল রোযা রেখে ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব।
৩. সুন্নত রোযা: মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখি রোযা রাখা।
৪. মোস্তাহাব রোযা: প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সাপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোযা রাখা মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এক সাথে হোক কিংবা পৃথক পৃথক হোক শাওয়ালের ছয়টি রোযা মাকরূহ। (ফতোয়ায়ে আলমগীর, প্রথম খ-)। একদিন পর পর বারো মাস রোযা রাখাকেও অনেকে মোস্তাহাব বলেছেন। একদিন পরপর বারো মাস রোযা রাখতনে হযরত দাউদ (আ.), তাই এই রোজকে বলা হয় ‘ছাওমে দাউদ’। মোস্তাহাব হলো এই ইবাদত যা করলে পূণ্য এবং না করলে পাপ নেই। তবে মোস্তাহাব রোযার ফযীলত হযরত রাসূলুল্লাহ করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বীকৃত।
৫. নফল রোযা: মোস্তাহাব আর নফল খুব কাছাকাছির ইবাদত। সহজজ অর্থে নফল হলো যা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন ইবাদত পূন্যের নিয়্যতে করা। রোযার ক্ষেত্রে তাই। তবে নফল রোযা রেখে ভঙ্গ করলে কাযা ওয়াজিব হয়ে যায়। এই পাঁচ প্রকারের নিয়্যত করতে হবে পৃথক পৃথক। রমযান মাসে ফরয রোযা ছাড়া অন্য কোন নিয়্যত করলে তা গ্রহণযাগ্য হয় না। কেউ যদি রমযান মাসে ওয়াজিব, নফল, মুস্তাহাবের নিয়্যত করে তবু তা ফরয হিসেবে আদায় হবে। রমযানের রোযার জন্য দুপুর পর্যন্ত নিয়্যত করার বিধান থাকলেও বাকীগুলোতে সেহরীর সময়ইে নিয়্যত করে নিতে হয়। অবশ্য নফল রোযাও দিন ধার্য্য করে রোযার নিয়্যত যদি দুপুরের মধ্যে করা হয় তবে নিয়্যতের শর্ত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কাযা রোযা বা দিন ধার্য্য না করে মান্নত রোযার জন্য রাত থেকে নিয়্যত করা জরুরী।
যে সব কারণে রোযা রাখা হারাম
যে সব কারণে রোযা রাখা হারাম দুই ঈদের দিন এবং কোরবানীর ঈদের পরের তিন দিন মোট এই পাঁচ দিনে রোযা রাখা হারাম। মহিলাদের হায়েয (মাসিক রক্তক্ষয়) নেফাযের (সন্তান গর্ভপাত কালীন রক্তক্ষয়) সময় রোযা রাখা হারাম। মহিলাদের মাসিক রক্তক্ষয় (হায়েয) এবং সন্তান প্রসবের রক্তক্ষয় (নেফায)-এর সময় রোযা রাখা হারাম।
যাদের উপর রোযা রাখা ফরয
প্রত্যেকে প্রাপ্তবয়স্ক (বালেক) সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী মুসলমান নর-নারীর উপর মাহে রমজানে রোযা রাখা ফরয। যথা সময়ে আদায় করতে না পারলে কাযা আদায় করা ফরয।
১. বালেগ হওয়া। সুতরাং নাবালেগের উপর রোযা ফরয নয় ।
২. মুসলমান হওয়া। সুতরাং কাফিরের উপর রোযা ফরয নয় ।
৩. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। সুতরাং পাগলের উপর রোযা ফরয নয়।
৪. দারুল ইসলামের অধিবাসী হওয়া অথবা দারুল হরবে থাকলেও রোযা ফরয হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞাত থাকা।
৫. মুকীম হওয়া। সুতরাং মুসাফিরের জন্য রোযা রাখা ফরয নয় ।
৬. সুস্থ থাকা। সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরয নয় ।
৭. মহিলারা হায়েয নেফাস থেকে মুক্ত থাকা। সুতরাং হায়েব নেফাস অবস্থায় রোযা রাখা ফরয নয়।
তবে যারা প্রচন্ড অসুস্থ অর্থাৎ রোযা রাখলে কষ্টকর হয় তাদের উপর কিছুটা শিথীল করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা পরর্বতীতে ছেড়ে দেয়া রোযাগুলি আদায় করে নিবেন। আর কেহ যদি একেবারে বৃদ্ধ হয়ে যায় যে, তারপক্ষে রোযা রাখা সম্ভব নয় তার উপর অর্পিত রোযার পরিবর্তে নির্দিষ্ট নিয়মে কাফফারা আদায় করলেও চলবে এবং রহমতের মাস রমযানে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে বেশী বেশী দোয়া করতে হবে, ।
১. নুমান ইবন বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দোয়াও একটি ইবাদাত। তোমাদের রব বলেন ঃ তোমরা আমার নিকট দোয়া কর। আমি তা কবুল করব। (কিতাবুস সালাত হাদীস নং-১৪৭৯)
২. আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐরূপ দোয়া অতি সত্ত্বর কবুল হয়, যদি কেউ অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দোয়া করে। (কিতাবুস সালাত হাদীস নং-১৫৩৫)
৩. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়- (ক) পিতা-মাতার দোয়া (সন্তানের জন্য), (খ) মুসাফিরের দোয়া এবং (গ) মযলুম (নির্যাতিত) ব্যক্তির দোয়া। (কিতাবুস সালাত হাদীস নং-১৫৩৬)
৪. সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের রব চিরঞ্জীব ও মহান দাতা। যখন কোন বান্দাহ হাত উঠিয়ে তাঁর নিকট দোয়া করে, তখন তিনি তার খালি হাত ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। (কিতাবুস সালাত হাদীস নং-১৪৮৮)
৫. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের দোয়া কবুল হয় থাকে, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি তার জন্য তাড়াহুড়া করে এবং এরূপ বলতে থাকে যে, আমি দোয়া করলাম অথচ তা কবুল হয় নাই। (কিতাবুস সালাত হাদীস নং-১৪৮৪)
যাদের উপর রোযা ফরয না
দশ প্রকার মানুষের জন্য রোযা ফরয না
১. কাফের বা অমুসলিম। কারণ তারা ইবাদত করার যোগ্যতা রাখে না। ইবাদত করলেও ইসলামের অবর্তমানে তা সহীহ হবে না, কবুলও হবে না। যদি কোন কাফের রমযানে ইসলাম গ্রহণ করে তবে পিছনের সিয়ামের কাজা আদায় করতে হবে না।
২. অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার সিয়াম পালন ফরয নয়।
৩. পাগল। পাগল বলতে বুঝায় যার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যার কারণে ভাল-মন্দের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। এর জন্য সিয়াম পালন ফরয নয়। পাগল যখনই সুস্থ হয় যাবে তখনই সে সিয়াম পালন শুরু করে দেবে। যদি এমন হয় যে দিনের কিছু অংশ সে সুস্থ থাকে কিছু অংশ অসুস্থ তাহলে সুস্থ হওয়া মাত্রই সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। সিয়াম পূর্ণ করবে। পাগলামি শুরু হলেই তার সিয়াম ভঙ্গ হবে না, যদি না সে সিয়াম ভঙ্গের কোন কাজ করে।
৪. অশীতিপির বৃদ্ধ যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। এ ব্যক্তি যার বয়সের কারণে ভাল-মন্দ পার্থক্য করার অনুভূতি চলে গেছে সে শিশুর মতই। শিশু যেমন শরীয়তের নির্দেশমুক্ত তেমনি সেও। তবে অনুভূতি ফিরে আসলে সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে কখনো অনুভূতি আসে আবার কখনো চলে যায় তবে অনুভূতি থাকাকালীন সময়ে তার উপর সালাত, সিয়াম ফরয হবে।
৫. যে ব্যক্তি সিয়াম পালনের সার্মথ্য রাখে না। এমন সার্মথ্যহীন অক্ষম ব্যক্তি যার সিয়াম পালনের সার্মথ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। যেমন অত্যধিক বৃদ্ধ অথবা এমন রোগী যার রোগ মুক্তির সম্ভাবনা নেই আল্লাহর কাছে আমরা এ ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই। এ ধরনের লোকদের সিয়াম পালন জরুরী নয়। কারণ সে এ কাজের সার্মথ্য রাখে না।
৬ . মুসাফির। মুসাফিরের জন্য সিয়াম পালন না করা জায়জে আছে। তবে সফরকে যেন সিয়াম পালন না করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা না হয়।
৭. যে রোগী সুস্থ হওয়ার আশা রাখে।
৮. যে নারীর মাসিক চলেছে। ঋতুকালীন সময়ে নারীর জন্য সওম পালন জায়েজ নয় বরং নিষেধ।
৯. গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী নারী। যদি গর্ভবতী বা দুগ্ধ দানকারী নারী সিয়ামের কারণে তার নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে সে সিয়াম ভঙ্গ করতে পারবে। পরে নিরাপদ সময়ে সে সিয়ামের কাজা আদায় করে নিবে।
১০. যে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে সিয়াম ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হয়। যেমন কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি; পানিতে পড়ে যাওয়া মানুষকে অথবা আগুনে নিপতিত ব্যক্তিকে কিংবা বাড়িঘর ধ্বসে তার মাঝে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে যেয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল।
ইয়াওমুশ শক
ইয়াওমুশ শক’এর রোযা ‘ইয়াওমুশ শক’ বলা হয় সন্দেহের দিনকে। শাবানের ২৯ তারিখের চাঁদ যদি সন্দেহজনক হয় তবে পর দিন রোযা রাখেত নিষেধ করা হয়েছে। তেমনি রমযানের ২৯ তারিখের চাঁদ যদি সন্দেহজনক হয় তবে পর দিন রোযা ভেঙ্গে ঈদ করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে সন্দেহজনক দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে কিছু কথা আছে। কেউ যদি সন্দেহের দিনে রোযারাখে তবে এর বিধান হলো-
১. এই রোযা নফলের নিয়তে রাখেত হবে। যদি এই অবস্থায় সত্যই রমযান শুরু হয়ে যায়, তবে তা ফরয হিসেবে আদায় হয়ে যাবে। নতুবা তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।
২. সন্দেহের দিনে রমযানের নিয়্যতে রোযা রাখা মাকরূহ তাহরিমি। যদি এমতাবস্থায় রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে। নতুবা তা তাহরিমির সাথে নফল হিসেবে গণ্য হবে। কারাহাতে তাহরিমি হলোÑঅপছন্দনীয় হারাম। এমতাবস্থায় যদি কেউ রোযা ভেঙ্গে ফেলে তবে কাযা-কাফ্ফারা কিছুই ওয়াজিব হবে না।
৩. প্রকৃত পক্ষে সন্দেহের দিনে ওয়াজিবের নিয়তে রোযা রাখা মাকরূহ তাহরিমি। যদি এমনি অবস্থায় রমযান শুরু হয়ে যায় তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যদি রমযান শুরু না হয়, তবে উলামায়ের মধ্যে তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। কেউ বলেছেন, যে ওয়াজিবের নিয়্যতে রাখা হয়েছে, তা আদায় হয়ে যাবে। কেউ বলেছেন, আদায়তো হবেই না বরং মাকরূহে তাহরিমি হিসেবে গণ্য হবে।
৪. সন্দেহজনক অবস্থায় যদি কেউ এমন নিয়ত করে যে, রমযান হলে রোযা রাখবো নতুবা ভেঙ্গে দেবো, তবে তার রোযা হবে না। কারণ প্রকৃত পক্ষে সে রোযার নিয়্যত-ই করেন।
৫. কেউ যদি এমন নিয়্যত করে যে, রমযান হলে ফরয রোযা, নতুবা অমুক ওয়াজিব কিংবা অমুক কাযা, তবে তা মাকরূহে তাহরিমি। যদি রমযান হয়ে যায় তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে। রমযান না হলে ওয়াজিব কিংবা কাযা কিছুই আদায় হবে না। তবে নফল হিসেবে গণ্য হবে।
৬. যদি নিয়্যত হয় রমযান হলে ফরয রোযা, নতুনা নফল, তবে তা মাকরূহ হবে। অবশ্য রমযান হলে ফরয আদায় হয়ে যাবে। সন্দেহের দিনের রোযা সম্পর্কে হাদীসে হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা রোযা রাখবেনা। তেমনি চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা ভাঙ্গবে না। যদি মেঘেরে কারণে তা তোমাদের প্রতি গোপন থাকে তবে শাবান পূর্ণ (৩০ দিন) করবে। (মোত্তাফাকুন আলাইহে) হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘রমযানের একদিন বা দু’দিন পূর্বে তোমরা রোযারাখিও না, যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট দিনে রোযারাখে সে ব্যতীত। (মোত্তাফাকুন আলাইহে)। হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন‘ যখন শাবান মাস অর্ধেক হয়ে যায় তোমরা আর (নফল) রোযা রাখিওনা। (আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আম্মার বিন ইয়াছির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন ‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিনে রোযা রাখে সে আবুল কাসেমের নাফরমানী করেছে। (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও আন-নাসাঈ) এখানে ‘আবুল কাসেম’ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বুঝানো হয়েছে। হযরত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক নাম আবুল কাসেম। মোট কথা ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফী (রহ.) প্রমূখদের মতামতের সারকথা হলোÑসন্দেহের দিনে সাধারণ মুসলমানদের জন্য রোযা রাখা মাকরূহ, যাদের নিয়মতি রোযা রাখার অভ্যাস কিংবা যে আলেম এব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন, তাদের জন্য সন্দেহের দিনে রোযা রাখা মাকরূহ নয় বরং মোস্তাহাব। যদি সন্দেহের দিনে রোযা অবস্থায় রমযান এসে যায় তবে তাতে ফরয আদায় হয়ে যাবে। সাধারণ লোকেরা দ্বি-প্রহর পর্যন্ত অপেক্ষা করে রোযা ভেঙ্গে দেওয়া উচিৎ। যদি রমযান হয়ে যায়, তবে তাতে পাপ হবেনা এবং কাফফারাও দিতে হবে না। তবে কাযা আদায় করতে হবে। কিন্তু সন্দেহের দিনে অনুমানের ওপর রোযা রাখা পাপ। (ফতোয়ায়ে আলমগীর)। সাহাবী হযরত আম্মার বীন ইয়াছির রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মতে সেন্দের দিনে রোযা রাখা রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাফরমানী।
রোযা রেখে যা করা মাকরূহ
মাকরূহ কাজে রোযাভঙ্গ না হলেও দুর্বল হয়। তাই রোযাদারের এসব ব্যাপারে সচতেন থাকা প্রয়োজন।
১। মিথ্যা কথা বলা।
২। গীবত বা চোগলখোরী করা।
৩। গালাগালি ও ঝগড়া ফাসাদ করা।
৪। সিনেমা দেখা বা অন্য কোন কবিরাহ গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
৫। সারাদিন নাপাক অবস্থায় থাকা।
৬। রোযার কারনে অস্থিরতা বা কাতরতা প্রকাশ করা।
৭। কয়লা, মাজন, টুথ পাউডার, টুথ পেষ্ট বা গুল দিয়ে দাঁত মাজা।
৮। অর্নথক কোন জিনিস মুখের ভিতর দিয়ে রাখা।
৯। অহেতুক কোন জিনিস চিবানো বা চেখে দেখা।
১০। কুলি করার সময়ে গড় গড়া করা।
১১। নাকের ভিতর পানি টেনে নেয়া (কিন্তু সে পানি গলায় পৌছে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে)
১২। ইচ্ছকৃতভাবে মুখে থু থু জমা করে গিলে ফেলা ।
১৩। ইচ্ছকৃতভাবে অল্প বমি করা
১৪. বিনা কারণে চিবিয়ে লবণ বা কোন বস্তুর ঘ্রাণ গ্রহণ করা, যেমন টুথপেষ্ট ।
১৫. গোসল ফরয অবস্থায় সরাসরি গোসল না করে থাকা ।
১৬. শরীরের কোথাও শিঙ্গা ব্যবহার করা বা রক্তপাত করানো ।
১৭. পরনিন্দা করা ।
১৮. ঝগড়া করা ।
১৯. রোযাদার নারী ঠোটে রঙ্গিন জাতীয় কোন বস্তু লাগালে যা মুখের ভেতর চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে
২০. রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো বা দাঁতে ঔষধ ব্যবহার করা, তবে একান্ত প্রয়োজনে তা জায়েয ।
২১.ইস্তেঞ্জা, অজু, গোসল এই নিয়তে বেশি পনি ব্যবহার যে শরীর ঠান্ডা হবে।
২২.অজু ব্যতীত নাকে পানি দেওয়া বা কুলি করা।
২৩.মহরম মাসে শুধু দশ তারিখে রোযা রাখা মাকরূহ। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন শুধু দশ তারিখে রোযা রাখতে। কারণ ইহুদিরা মহরমের দশ তারিখে রোযা রেখে থাকে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑতোমরা ৯ তারিখেও রোযা রাখ। যদি কেউ ৯ তারিখে রোযা রাখতে ভুলে যান তবে তিনি ১০ তারিখের সাথে ১১ তারিখ রোযা রেখে ইহুদিদের সাথে ব্যবধান করতে পারেন। শুধু মহরমের দশ তারিখে রোযা রাখলে মাকরূহ হয়ে যাবে।
২৪. শুক্রবারে রোযা রাখা মাকরূহ। হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, তোমরা কেউ শুধু শুক্রবারে রোযা রাখবে না, তার পূর্বে এবং পরে রোযা রাখা ব্যতীত। (মোত্তাফাকুন আলাইহে)। অন্য একটি হাদীসে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, রাত সমূহরে মধ্যে শুধু জুম্মার রাতকে নামাজের জন্য ধার্য্য করবে না এবং দিনসমূহরে মধ্যে শুধু জুম্মার দিনকে রোযার জন্য ধার্য্য করবে না, যদি তা তোমাদের রোযা রাখার তারিখে না পড়ে। (সহীহ মুসলিম)।
২৫. ইয়াওমুশ শকের দিনে রোযা রাখা মাকরূহ।
২৬. কোন কিছু জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে স্বাদ নিয়ে থুথু ফেলে দিলে রোযা নষ্ট হয়না বটে কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া এমন করা মাকরূহ।
২৭. যদি কোন মহিলার স্বামী এমন জালেম হয় যে খাদ্যে লবন কম-বেশি হলে জুলুম করে তবে তার জন্য জিহবা দিয়ে স্বাদ দেখা জায়েজ আছে।
২৮. রোযা অবস্থায় শিশু সন্তানকে কিছু চিবিয়ে দেওয়া মাকরূহ। যদি শিশুর জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষার কোন বিকল্প পথ না থাকে তবে জায়েজ আছে। তবে সাথে সাথে কুলি করে মুখ পরিস্কার করে নিতে হবে।
২৯. রোযা রেখে শুকনো মিসওয়াক ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে দাঁত মাজা মাকরুহ, যদি সে গুলোর কিছু অংশ ভেতরে চলে যায় তবে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে কাঁচা নিমের ডালের মিসওয়াক থেকে যে তিক্ততার স্বাদ মুখে লাগে তাতে রোযা নষ্ট বা মাকরূহ কিছুই হয় না।
রোযাদারের যা করা মাকরুহ নয়
১. গোঁফে ও দাঁড়িতে তেল লাগানো।
২. সুরমা লাগানো।
৩. শীতলতা লাভের উদ্দেশে যে গোসল করা।
৪. শীতলতা লাভের উদ্দেশে যে ভেজা কাপড় গায়ে জড়ানো।
৫. রোযা রেখে দিনের শেষভাগে মিসওয়াক করা সুন্নত, যেমন প্রথমভাগে করা সুন্নত ।
যে সকল কাজে রোযাভঙ্গ হয় এবং হয় না
রোযাভঙ্গকারী বস্তু দুই প্রকার (১) যা দ্বারা কাযা ওয়াজিব হলেও কাফফারা হয় না। (২) যা দ্বারা কাযা কাফফারা দু’টাই ওয়াজিব হয়।
যে সব কারনে রোযা নষ্ট হয়ে যায়
১.রোযা স্মরণ থাকা অবস্থায় পানাহার করা কিংবা স্ত্রী সহবাস করা। এতে কাযা ও কাফফারা (একাধারে দুই মাস রোযা রাখা) ওয়াজিব হয়।
২.খাদ্য বা খাদ্য হিসেবে গণ্য এমন কোন বস্তু গিলে ফেললে।
৩.দাঁত দিয়ে রক্ত বের হয়ে তা থুথুর সাথে মিশার পর যদি রক্তের স্বাদ থাকে এবং তা গিলে ফেলা হয় তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা আদায় করতে হবে। যদি থুথুতে রক্তের স্বাদ না থাকে তবে রোযা নষ্ট হবে না।
৪.বিড়ি সিগারেট পান করলে।
৫. রাত্র মনে করে সুবেহ সাদেকের পর সেহেরী খাওয়া।
৬.আগরবাতি ইচ্ছা করে গলা বা নাকের মধ্যে প্রবেশ করালে ।
৭. বুঝে হোক বা না বুঝে সূর্য ডুবার আগে ইফতার করলে। এগুলোতে শুধু কাযা (যে কয়টা ভাংবে সে কয়টা পরিবর্তিতে রাখতে হবে) ওয়াজিব হয়। কাফফারা নয় । কিন্তু রোযা ভেঙ্গে যাওয়ার পর দিনের অবষ্টি সময়ে রোযাদারের ন্যায় পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
৮. ভুলবশত: পানাহার করে তাতে রোযা নষ্ট হয়েছে বিবেচনা করে পানাহার করলে।
৯. রাত্রি আছে মনে করে কিছু খেলে এবং সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে বেলা থাকা অবস্থায় ইফতার করলে।
১০.সেহরীর পর যাদের পান খাওয়ার অভ্যাস আছে তারা উত্তমরূপে কুলি করে মুখ পরিস্কার করা জরুরী। তা না করলে নির্দিষ্ট সময়ের পর মুখে পান বা পান চিবানোতে যে লাল হয়েছে তা থেকে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উত্তমরূপে কুলির পরও যদি মুখে কিংবা থুথুর সাথে লাল রঙ দেখা যায় তবে রোযা নষ্ট হবে না। কেউ যদি পান চিবুতে চিবুতে সেহরীর পর ঘুমিয়ে যান এবং সকাল পর্যন্ত পান মুখে থেকে যায়, তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা আদায় করতে হবে। তবে এমতাবস্থায় পানাহার জায়েজ নয়। (বেহশতী জেওর)
১১.রোযা অবস্থায় অসুস্থ্য ব্যক্তির ঔষুধ পানাহার নিষেধ। রোগীর অবস্থা মারাত্মক হলে রোযা ভেঙ্গে ঔষুধ খাওয়া যাবে, তবে রোযার কাযা আদায় করতে হবে। কাফ্ফারা লাগবে না।
১২.কুলি কিংবা ডুব দিয়ে গোসলের সময় যদি অসর্তকতা বশত: রোযা স্মরণ থাকার পরও হলকুমের ভিতর পানি চলে যায়, তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা আদায় করতে হবে। তবে দিনের বেলা পানাহার করা যাবে না।
১৩.যদি কারো বমি হয়ে যায়, অথবা ইচ্ছে করে মুখ ভরে বমি করে, অথবা তা থেকে কম বমি করে এবং তা অনিচ্ছায় ভিতরে ফিরে গেলো, অথবা বমিকারী ইচ্ছে করে ভেতরে ফিরিয়ে দিলো, অথবা বের করে ফেলে দিলো, তবে রোযাভঙ্গ হয়ে যাবে।
১৪.মাওলানা আশরাফ আলী (রাহ.) বলেন বমি বেশি পরিমান হলকুমের ভেতর চলে যায় তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা আদায় করতে হবে। (বেহশতী জেওর)
১৫.যদি লোহা জাতীয় কোন কিছু (যা খাদ্য, পানি, বা ঔষুধ নয়) খেয়ে ফেলে তবু রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা আদায় করতে হবে। তবে ভাঙ্গলে কাফফারা দিতে হবে। আর যদি তা খাদ্য কিংবা ঔষুধ রূপে পানাহারের নিয়ম থাকে তবে কাযা কাফফারা দু’টাই আদায় করতে হবে। (ফতোয়ায়ে আলমগীর-প্রথম খ-)
১৬.রোযা রেখে দিনের বেলা স্বামী স্ত্রীর সহবাসে র্বীর্যপাত হোক কিংবা না হোক তবুও রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কাযা-কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব।
১৭.নাকে নস্য টানলে, কানে তৈল ঢাললে, পায়খানার জন্য ডুস নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না। তবে কানে পানি টপকাইলে রোযা নষ্ট হয় না। রোযা অবস্থায় কোন মহিলা যদি পেশাবের রাস্তায় ঔষুধ রাখে কিংবা তৈল টপকায় তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (ফতোয়ায়ে আলমগীর-প্রথম খ-)
১৮. মাথায় এবং পেটে ঔষুধ লাগানোর পর তার তেজ মস্তক ও পেটে ঢুকলে।
১৯.কোন মহিলা যদি নিজে কিংবা ধাত্রী বা ডাক্তার যদি প্রসূতির যৌনিতে আঙ্গল ঢুকায়, অতপর সম্পূর্ণ বা কিয়দংশ বের করে আবার ঢুকায়, তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। মোট কথা প্রথম বারে নয়, দ্বিতীয় বার ঢুকানোর কারণে রোযা নষ্ট হয়। অবশ্য প্রথম বারের সময় যদি পানি জাতীয় কিছু দ্বারা আঙ্গুল ভেজা থাকে তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কাযা করতে হবে। তবে দিনের বেলা পানাহার করা যাবে না।
২০.কোন স্বামী যদি অসতর্ক বা অজ্ঞান স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তবে উভয়ের রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে স্ত্রী শুধু কাযা আদায় করবে আর স্বামী কাযা-কাফফারা দু’টাই আদায় করতে হবে।
যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না
১. মনের ভুলে কিছু খেয়ে ফেললে। তবে বোঝামাত্র মুখের মধ্যে যা খাবার জাতীয় আছে সাথে সাথে সব ফেলে দিতে হবে। (সহীহ আল বুখারী ১/২৫৯; সহীহ মুসলিম ১/৩৬৪ ও মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ৪/১৭৩ )
২. ভুলে স্ত্রী সহবাস করলে। (সহীহ আল বুখারী ১/২৫৯; শরহে সহীহ মুসলিম, নববী ১/৩৫৪ ও মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ৪/১৭৪)
৩. দিনের বলো স্বপ্নদোষ হলে। (জামে আত-তিরমিযী ১/১৫২)
৪. চোখে সুরমা ব্যবহার করলে। (জামে আত-তিরমিযী ১/১৫৪ ও মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ৪/২০৭-২০৮)
৫. অনচ্ছিাকৃত মুখভর বমি হলে। (সহীহ আল বুখারী ১/২৬০; জামে আত-তিরমিযী ১/১৫২ ও মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ৪/২১৫)
৬. ধুলাবালি, ধোঁয়া, মশা-মাছি ইত্যাদি যা পরিহার করা সম্ভব নয় অনিচ্ছায় হলকের (কণ্ঠনালী) ভিতরে চলে গেলে। (সহীহ আল বুখারী ১/২৫৯ ও মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৪৯)
৭. জুনুবী অবস্থায় সুবেহ সাদিক হয়ে গেলে। (বাকারা : ১৮৭; সহীহ আল বুখারী : ১/২৫৮; সহীহ মুসলিম : ১/৩৫৩-৩৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : ৪/১৭৯ ও মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/২৮০)
৮ . যে সকল ঘ্রাণে ধোঁয়া নেই যেমন; আতর, গোলাপ, কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ ইত্যাদি ব্যবহারে রোযার কোন ক্ষতি হয় না।
৯. দাঁতের ফাঁকে যদি কোন খাদ্যদ্রব্য আটকে যায় এবং তা খেলাল বা জিহ্বা দিয়ে বের করে খেয়ে ফেলে আর তা এক বুট (ছোলা) পরিমাণ বড় হয়, তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। এক বুট থেকে ছোট হলে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি মুখ থেকে বের করে আবার খেয়ে ফেলা হয় তবে এক বুট থেকে ছোট হোক কিংবা বড় রোযা নষ্ট হয়ে যাবে, কাযা আদায় করতে হবে। তবে রোযাভাঙ্গা যাবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীর)
১০. থুথু যত বেশিই হোক, তা গিললে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। তবে ইচ্ছাকৃত জমিয়ে গিললে রোযা মাকরূহ হবে।
১১. রোযা অবস্থায় অসুস্থ্য ব্যক্তির ইনজকেশন নেওয়া জায়েজ আছে।
১২. বমির সাথে খাদ্য-পানি অথবা পিত্ত হয়। আর যদি শুধু কফ হয় তবে ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর মতে রোযা নষ্ট হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীর, প্রথম খ-)।
১৩. বমি বেশি কিংবা কম অনচ্ছিায় হলে রোযা নষ্ট হয় না। তবে ইচ্ছাকৃত বেশি বমি হলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়। যদি অনচ্ছিাকৃত সামান্য বমি হয়, আবার অনচ্ছিাকৃত হলকুমের ভেতরে চলে যায়, তবে রোযা নষ্ট হয় না।
১৪. হঠাৎ (অনিচ্ছাকৃত) কানে পানি ঢুকলে।।
১৫. তৈল মালিশ করলে।
১৬. স্বপ্নদোষ হলে।
যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় তবে কাফফারা ওয়াজিব হয় না
১. কানে ঔষধ বা তেল ঢাললে। তেমনিভাবে নাকে ঔষধ দিয়ে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলে। (সহীহ আল বুখারী : ১/২৫৯)
২. ইচ্ছা করে মুখভরে বমি করলে। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কেউ বমি করলে রোযা কাযা করতে হয় না। তবে ইচ্ছা করে বমি করলে তাকে কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/১৮০; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : ৪/২১৫ ও মুসতাদরাকে হাকমে : ১/৪২৭)
৩. রাত্র বাকি আছে মনে করে সময়ের পরে সেহেরী খেলে। সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কেউ (সুবেহ সাদিক হয়নি মনে করে) সুবেহ সাদিকের পর কিছু খেলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য একদিন তা কাযা করে নিবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/১৪৯
৪. সূর্য অস্ত- গিয়েছে মনে করে সময়ের আগইে ইফতার করে ফেললে। হযরত আলী ইবনে হানযালা (রাহ.) তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি রমযানে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে ছিলাম তখন তাঁর সামনে পানীয় পেশ করা হল। কিছু লোক সূর্য ডুবে গিয়েছে মনে করে ইফতার করে ফেললেন। এরপর মুআযযিন এসে বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! সূর্যতো এখনো অস্ত-যায়নি। তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘোষণা করলেন, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে করিক থেকে নিষেধ করেছেন। দুই বার কিংবা তিন বার তিনি একথা বলেছেন। এরপর বললেন, যারা ইফতার করেছে তারা যেন এই দিনের পরিবর্তে অন্য একদিন রোযা রাখে। আর যারা ইফতার করেনি তারা যেন সূর্যাস্ত পর্যন্ত-তাদের রোযা পূর্ণ করে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/১৫০)
৫) ভুলক্রমে পানাহারের পর ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।- প্রাগুক্ত।
যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা-কাফ্ফারা উভয় ওয়াজিব হয়
১. রোযা রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে ।
২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে। এতে স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।
৩. রোযা রেখে পাপ হওয়া সত্ত্বে যদি স্বামী তার স্ত্রীর পায়খানার রাস্তায় পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করায় এবং অগ্রভাগ ভেতরে প্রবেশ করে। তাহলে স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।
৪. রোযা অবস্থায় কোন বৈধ কাজ করলো, যেমন স্ত্রীকে চুম্বন করল কিংবা মাথায় তেল দিল, তা সত্ত্বওে সে মনে করলো যে, রোযা নষ্ট হয়ে গিয়েছে; আর তাই পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ইত্যাদি করলো, তাহলে কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।
৫. ইচ্ছা করে ঔষধ সেবন করলে।
যে সকল কারণে রোযা না রাখা জায়েজ
১.অসুস্থ হলে
যে সকল কারণে রোযা না রাখা জায়েজ রোগ যদি এমন হয় যে, রোযা রাখলে রোগ বৃদ্ধি পাবে, দুরারোগ্য হবে, কিংবা জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে তবে রোযা না রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু যে দিন থেকে সুস্থ্য হবে সে দিন থেকে রোযা রাখতে হবে, রমযান শেষে কাযা আদায় করতে হবে। অসুস্থ্যতার কারণে রোযা ছাড়তে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরার্মশ নিতে হবে। চিকিৎসক ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন দ্বীনদার হলে উত্তম। চিকিৎসক মুসলিম হলে নিজের বিবেকের সাথে পরার্মশ করা উচিৎ। অনেক মুসলমান পেটের শুল বেদনার অজুহাতে রোযাভঙ্গ করে থাকতে দেখা যায়। এটা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক অজুহাত হিসেবে ইতোমধ্যে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের গবষেনায় প্রমানিত হয়েছে। গবষেকরা পেটের রস পরীক্ষা করে বলেছেন ‘যাদের পাকস্থলিতে এসিডি বেশি বা কম তারা রোযার ফলে সুস্থ্য হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যারা বলেন রোযা রাখলে রক্তের ‘পটাসিয়াম’ হ্রাস পেয়ে শরীরে ক্ষতি হয়, তাদের ধারনাও যে অমুলক তা ইতোমধ্যে প্রমানিত হয়েছে। গবষেকদের মতে ‘পটাসিয়াম’ হ্রাসের প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা দেয় হৃৎপিন্ডে। তারা অত্যাধুনকি ইলকেট্রোকিড ও গ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে ১১ জন রোগীর হৃৎপিন্ড রোযার পূর্বে এবং রোযার ২৫ দিন পরে পরীক্ষা করে দেখেছেন রোযা দ্বারা হৃৎপিন্ডের ক্রিয়ার কোন ব্যতিক্রম ঘটে নাই। (ডা. গোলাম মোয়াজ্জম কর্তৃক ‘মানব শরীরের উপর রোযার প্রভাব সম্পর্কে গবষেণা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ)। রোযায় সামান্য রক্ত শর্করা হ্রাসের দরুণ অনেক মানুষ কিছুটা খিটখিটে হয়ে যায়। চিকিৎসকদের মতে এই সামান্য রক্ত-শর্করা হ্রাস মোটেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। যে কোন ক্ষুধার সময় এমন হতে পারে। (চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগের দান সংখ্যা আজাদ, ২৮শে ডিসম্বের ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ)। ইংল্যান্ডের অনেক ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে আমি জেনেছি মানুষের রোগ সৃষ্টির প্রধান কারণগুলোর একটি অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ। কম খেলে মোটেও রোগ সৃষ্টি হয় না। বর্তমান সমাজে যে নিত্য নতুন রোগের খবর পাচ্ছি আমরা তার বেকরি ভাগের জন্ম হচ্ছে খাদ্য আর যৌনতা থেকে। ডাক্তার অনেক রোগীকে ডায়েটের পরার্মশ দিয়ে থাকেন। অনেক ডাক্তার মনে করেন ইঞ্জিন রর্ক্ষাথে মাঝমধ্যে যেমন চুল্লি থেকে ছাই ও আঙ্গার সর্ম্পূণ পরিষ্কার করা আবশ্যক, তেমনি পাকস্থলী থেকে অর্জীণ খাদ্য নিষ্কাষিত করা দরকার। (ডা. সেলামন, গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিধি)। মোটকথা হলো, অসুখ হলে রোযা না ভেঙে ভালো দ্বীনদার ডাক্তারের পরার্মশ নেয়া।
২.মুসাফির হলে
মুসাফির ইচ্ছে করলে রোযা ভাঙতে পারবে। মুসাফির বলা হয় ৪৮ মাইল কিংবা তা থেকে বেশি ভ্রমণকারিকে। গন্তব্য যদি নিজের বাড়ি হয়, যেমন কেউ ঢাকায় কিংবা লন্ডনে থাকে, আর সে সেখান থেকে সিলেট আসছে এবং সিলেট তার নিয়্যত, তবে নিয়্যতের সীমানায় পৌঁছা পর্যন্ত সে মুসাফির। এখন প্রশ্ন হলো নিয়্যতের সীমা বলতে নিজ নিয়্যতের ভেতরকে বুঝাচ্ছে না গ্রাম বা শহরকে? মূলত নিয়্যতের সীমা বলতে নিজ মহল্লার মসজিদের এলাকাকে বুঝাচ্ছে। কারো গন্তব্য যদি নিজ নিয়্যতের এলাকায় না হয় তবে ১৫ দিনের কম সময় থাকার নিয়্যত হলে সে মুসাফির। আর ১৫ দিনের বেশি থাকার নিয়্যত হলে সে গন্তব্যে পৌঁছার পর মুকিম, অর্থাৎ আর মুসাফির নয়। বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নেরর সময়ে ভ্রমণ কষ্টদায়ক না হলে রোযা না ভাঙ্গা উত্তম। কারণ, রমযান মাসের ফযীলত অন্য মাসে পাওয়া যায় না। তবে মুসাফির রোযা ভাঙলে কোন পাপ হবে না। কেউ যদি মুসাফির কিংবা অসুস্থ অবস্থায় মারা যায় তবে তার রোযা কাজা বলে গণ্য হবে না। কিন্তু কেউ যদি অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় দশটি রোযা ছাড়ে আর রমযান শেষে সুস্থ কিংবা মুকিম অবস্থায় পাঁচদিন সময় পাওয়ার পর মারা যায় তবে তাকে পাঁচটি রোযার জন্য দায়ী করা হবে। মাল থাকলে ওয়ারিশদের উচিৎ ‘ফিদিয়া’ আদায় করা। ফিদিয়া বলা হয় রোযার পরিবর্তে যে সদকা দেওয়া।
৩.গর্ভবতী মহিলা
গর্ভবতী মহিলা কিংবা সদ্য প্রসূত শিশুর স্তন্যদায়ী নারী যদি রোযা রাখলে নিজের কিংবা বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার অশংকা থাকে তবে সে রমযানে রোযা না রেখে অন্য সময় কাজা আদায় করে নিতে পারবে। মেয়ে লোকের রক্তক্ষয় যদি রাতে বন্ধ হয় তবে সকাল থেকে রোযা রাখত হবে। কিন্তু যদি তা সেহরীর পর বন্ধ হয় তবে রোযার নিয়্যত করা জায়েজ হবে না। তবে দিনে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪.বালেগ
তেমনি কেউ যদি রমযানের দিনে বালেগ কিংবা মুসলমান হয় তবে তার জন্যও বাকি দিন পানাহার অনুচিৎ। অবশ্য এক্ষেত্রে পানাহারে কোন কাজা-কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না। কেউ যদি সফরে থাকার কারণে রোযার নিয়্যত না করে এবং ইফতারের পূর্বে বাড়ি ফিরে আসে অথবা ১৫ কিংবা তা থেকে বেশি থাকার সংকল্প করে ফেলে তবে তাকে সাথে সাথে রোযার নিয়্যত করে নিতে হবে।
৫. বয়স বেশী হবার কারনে অত্যন্ত দুর্বল ও দৈহিক খারাপ অবস্থা দেখা দিলে।
৬. সাপে দংশন করলে।
৭. মহিলাদের হায়েজ-নেফাছ হলে।
৮. ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মৃত্যুর আশংকা দেখা দিলে।
রোযার সুন্নত সমুহ
১.সর্বদা নেক কাজে রত থাকা।
২.শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গের রোযা অর্থাৎ হাত, পা, নাক, কান, চোখ, মুখ, জিহবা এবং অন্তরের রোযা পালন করা। অর্থাৎ সকল প্রকার খারপ কাজ থেকে নিজেকে সংযত রাখা।
৩.দান-খয়রাত করা।
৪.সেহেরী খাওয়া সুন্নত। যদি ক্ষুধা না থাকে, তাহলে অন্তত ২/৩টি খুরমা/খেজুর এবং এক ঢোক হলেও পানি পান করে সেহেরী করা সুন্নত।
৫.রমযানের রাত্রিতে তারাবীহ্ নামায আদায় করা।
৬. রমযানের সূর্বণ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত, যিকরি, ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা, উত্তেজিত না হওয়া।
৭.তারাবীহ নামাজে কুরআন শরীফ পাঠ করা বা শ্রবন করা।
৮.সঠিক সময়ে ইফতার করা।
৯.ইতিকাফ করা।
মুস্তাহাব কাজসমূহ
১. সময়মত সেহেরী খাওয়া। সেহেরীর সময়ের শেষ ভাগে খাওয়া ।
২. সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে ইফতার করা ।
৩. রাতে বড় নাপাকি হলে ফজরের পূর্বেই গোসল করে পাক হওয়া ।
৪. গীবত, পরনিন্দা ও গালি-গালাজ থেকে জিহবাকে সংযত রাখা ।
৫. যথাসম্ভব এ মাসের রাতে (বৈধ হলেও) সহবাস হতে নিজেকে বিরত রাখা।
৬. ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে উত্তেজিত না হওয়া ।
রোযা মানব শরীরে কোন ক্ষতি করে না
১৯৫৮ সালে ঢাকা কলজে ডাঃ গোলাম মোয়াজ্জাম সাহেব কর্তৃক মানব শরীরের উপর রোযার প্রভাব সম্পর্কে গবষেণা চালানো হয়। তাতে প্রমানিত হয় যে, রোযার দ্বারা মানব শরীরের কোন ক্ষতি হয় না কেবল ওজন সামান্য কমে, তাও উল্লখেযাগ্য কিছুই নয়। বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এইরুপ আধুনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রন তথা ডায়েট কন্ট্রোল অপেক্ষো বহুদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। তৎর্কতৃক ১৯৬০ সালে গবষেণায় এটাও প্রমানিত হয় যে, যারা মনে করে থাকে যে, রোযা দ্বারা, পেটের শূল বেদনা বৃদ্ধি পেয়ে তাদের এই ধারনা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারন উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই এটা বাড়ে। এই অতি কথাটা অনেক চিকৎসকই চিন্তা না করে শূল বেদনা রোগীকে রোযা রাখতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোযাদারের পটেরে রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশী বা খুব কম, রোযার পরে তাদের এই উভয়ে দোষই সেরে গেছে। এই গবষেণায় আরও প্রমানিত হয় যে, যারা মনে করেন যে, রোযার দ্বারা রক্তের পটাশিয়াম কমে যায় এবং তাদের শরীরের ক্ষতি সাধন হয়, তাদের এই ধারণাও অমূলক। কারন পটাশিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া কম দেখা দিয়ে থাকে হৃৎপিন্ডের উপর অথচ ১১ জন রোযাদারের হৃৎপিন্ড অত্যাধুনিক ইল্টেক্ট্রোগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোযার পূর্বেও রোযা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, রোযা দ্বারা এদের হৃৎপিন্ডের ক্রিয়ার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি।
প্রয়োযনীয় কিছু বিষয়
১. এ-োসকপি : রোযা অবস্থায় এ-োসকপি পরীক্ষা করানো যায়। তবে পরীক্ষা করার সময় যদি নলের ভিতর দিয়ে পানি বা কোনো ঔষধ ভিতরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যথায় নষ্ট হবে না। এ-োসকপির মতোই মলদ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তার হুকুমও অভিন্ন।
২. এনজিওগ্রাম : সাধারণ পদ্ধতির এনজিওগ্রাম-এর কারণে রোযা নষ্ট হয় না।
৩. ইনজেকশন ও ইনসুলিন : ইনজেকশন ও ইনসুলিন গ্রহণের কারণে রোযা নষ্ট হয় না। তবে যেসব ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেয় তা জটিল ওযর ছাড়া গ্রহণ করা মাকরূহ।
৪. নাইট্রোগ্লিসারিন : এরোসোল জাতীয় এ ঔষধটি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয় না।
৫. ভেনেটালিন ইনহেলার : রোযা অবস্থায় এই ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়।
রোযার দিন অবশষ্টি সময় যা করা উচিত
১. অসুস্থতা, বার্ধক্য ইত্যাদি শরীয়ত সম্মত কোনো ওযরের কারণে কেউ রমযানের রোযা রাখতে সক্ষম না হলে সে পানাহার করতে পারবে। তবে রোযাদারদের অগোচরে পানাহার করা উচিত।
২. মুসাফির যদি দিনের বেলা সফর থেকে বাড়ি ফিরে আসে তাহলে অবশষ্টি দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/২২১)
৩. তদ্রুপ দিনের বেলা কোনো মহিলার হায়েয বন্ধ হলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : ৬/২২০ ও মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : ৪/১৭০) কিছু সমসাময়কি মাসআলা উল্লেখিত মাসআলাগুলো ছাড়াও বর্তমান ফকীহগণ কুরআন, হাদীস ও আছারের আলোকে সূক্ষ্ম গবেষণা ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করে রমযান মাসে সমকালীন চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রদান করেছেন।
সেহরী
সেহরী রাতের শেষে অংশে রোযার নিয়তে খাওয়াকে সেহরী বলে। সেহরী খাওয়া সুন্নত। সেহরী খেতে হবে সুবেহ সাদেকের পূর্বে। সেহরী না খেলেও রোযা শুদ্ধ হয়। তবে সেহরীর ফযীলত অনেক। সেহরী না খেতে পারলে রোযা ভাঙা জায়েজ হবে না। সেহরীর সময়ে রোযার নিয়্যত করা উত্তম।
১.অন্য হাদীসে আছে, আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবীদরে রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া (আমরা সেহেরী খাই তারা খায় না)। (সহীহ মুসলিম : ১০৯৬)
২.শেষে ওয়াক্তে সেহরী খাওয়া সুন্নত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে ও শেষে ওয়াক্তে সেহরী খাবে। (মুসনাদে আহমদ : ৫/১৭৪)
৩.অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেহরী খাওয়া ও আযানের মাঝের সময়ের ব্যবধান ছিল পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ। (সহীহ আল বুখারী : ১৯২১ ও সহীহ মুসলিম : ১০৯৬
৪.সুবেহ সাদেকের একটু পূর্বে সেহেরী খাওয়া মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-“তোমরা সেহেরী খাও, এতে অত্যন্ত বরকত নিহীত আছে।” (সহীহ মুসলিম শরীফ : ১/৩৫০)
৫.ইমাম আহমাদ (রহ.) আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সেহেরী বরকতের খাবার। তা খাওয়া থেকে বিরত হবে না। কেহ যদি এক ঢোক পানিও পান করে তবুও সে সেহেরী খেল। কেননা আল্লাহতায়ালা এবং ফেরেশতাগণ সেহেরীতে অংশগ্রহণকারীদরে জন্য দোয়া করতে থাকেন।
সেহরী খাওয়ার ফযীলত
১.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেহেরী খাও, সেহেরীতে বরকত রয়েছে। (সহীহ আল বুখারী : ১৯২৩ ও সহীহ মুসলিম : ১০৯৫)
২. হযরত আবু যর গিফালী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মত যতদিন পর্যন্ত ইফতার ত্বরান্বিত করবে এবং সেহরী বিলম্বিত করবে, ততদিন তারা কল্যাণময় হয়ে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ)

ইফতার
সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করা উত্তম। ইফতারের ফযীলত ইফতারের ফযীলতের বর্ণনায় আমরা প্রচুর হাদিস দেখতে পাই। সমস্ত দিনে যত লোককে মহান আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেন, শুধু ইফতারের পূর্বক্ষণে এতজনকে ক্ষমা করেন। রোযাদার ইফতারের পূর্বক্ষণে ইফতারের জন্য খাদ্য সামনে নিয়ে বসে যে দোয়া করে আল্লাহ তা কবুল করে নেন।
১. হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন-আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বান্দা তাহারাই যাহারা ইফতার করতে দেরী করে না। (জামে আত-তিরমিযী) ইফতার তাড়াতাড়ি করা এবং তখন দোয়া করা উত্তম।
২. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-“মানব জাতি ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতদিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে। (সহীহ মুসলিম)
৩. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রোযাদার যতদিন পর্যন্ত ইফতার ত্বরান্বিত করবে, ততদিন দীন ইসলাম স্পষ্ট, অম্লান ও বিজয়ী হয়ে থাকবে।
৪. হাদীসে কুদসীতে উদ্ধৃত্ত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন: ইফতার ত্বরান্বিতকারী বান্দাগণই আমরা নিকট সর্বাধিক প্রিয়
৫.সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করুন হাদীস শরীফে আছে, মানুষ যতদিন সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে। (সহীহ মুসলিম : ১০৯৮, জামে আত-তিরমিযী : ৬৯৯ ও মুসনাদে আহম্দ))
ইফতারের দোয়া
১.আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলাকা তাওয়াক্কালতু ওয়াবিরাহমাতিকা আফতারতু ইয়া আরহামার-রাহেমীন। বাংলায় অর্থ: হে আল্লাহ আমি তোমার উদ্দেশে যে রোযা রেখেছি। তোমার করুণার উপর নির্ভর করছি। এখন তোমার করুনার সাথে ইফতার করছি। হে র্সবশ্রেষ্ট করুণাময়।
২.ইফতারের দোয়া ‘পিপাসা নীবারিত হল, শিরা উপশিরা সতেজ হল আর সওমের ছাওয়াব প্রাপ্তির খাতায় লিখিত হয়ে গেল। (সুনানে আবু দাউদ : ২৩৫৭ ও আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলা : ৪৭৮)
৩.হে আল্লাহ! আপনার সন্তুষ্টির উদ্দশ্যেইে রোযা রেখেছি এবং আপনার দেওয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করছি। (সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৮)
৪.হে আল্লাহ! সিয়াম পালনকারীদের সিয়াম কবুল করুন, দানকারীদের দান কবুল করুন, রাত্রে ইবাদতকারীদের ইবাদত কবুল করুন, প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা কবুল করুন, আমাদের পূর্বের এবং পরের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন, এ মাস যেন আমাদের সকলের জন্য ক্ষমার মাস হয়।

৫.ইফতারের বিভিন্ন র্পযায়ে চারটি দোয়া রয়েছে-
১. ইফতারী সামনে এলে এই দোয়া পড়া-
২. ইফতরী সামনে রেখে এই দোয়া পড়তে থাকা- হে বড় দাতা ! আমাকে ক্ষমা করুন।
৩. ইফতারের সময় এই দোয়া পড়া – ‘হে আল্লাহ ! আমি তোমার জন্য রোযা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।’ (আবু দাউদ)
৬. ইফতার শেষে এই দুআ পড়া-“পিপাসা নীবারণ হয়েছে, শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ সওয়াবও নির্ধারিত হয়েছে। (আবু দাউদ )
৭. ইমাম তিরমিযী (রহ.) রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ তা’আলা ফেরত দেন না: ন্যায়পরায়ণ শাষক, সিয়াম পালনকারী যখন ইফতার করে ও অত্যাচারিতের দোয়া।
ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়
বিশেষ সময় ও মওসুমে দোয়া বেশি কবুল হয়। অনুরূপভাবে বিশেষ স্থান এবং বিশেষ ব্যক্তির দোয়াও কবুল হয়। পবিত্র রমযানে দোয়া অধিক কবুল হয়। এ ছাড়াও বিশেষ স্থান, যেমন মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা, জমজম কূপ, সাফা, মারওয়া পাহাড়, মিনা, মোযদালেফা ও আরাফাতে এবং মিনার তিন জামরাহর নিকট দোয়া কবুল হয়। বিশেষ ব্যক্তি ও অবস্থা যেমন, রোযাদার ইফতার করা পর্যন্ত, ইফতারের সময়, ক্বাবা শরীফ দেখার সময়, ভোর রাতে, তাহাজ্জুদের সময় এবং শুক্রবারে দোয়া বেশি কবুল হয়।
রমযান ফযীলতের মাস। এ মাসে যাবতীয় ভোগ লালসা থেকে বিরত থেকে আল্লাহ বিধান পালনের কারণে রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। তিনি দোয়া করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেন। তাই রমযানে আল্লাহর নিকট অধিক পরিমাণে দোয়া করা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-রোযাদারের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না, অর্থাৎ কবুল করা হয়।
তাই রমযানে অধিক পরিমাণে দোয়া করা আবশ্যক। ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজের জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। দোয়া করতে অবহেলা করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে গাফেল থাকা। অথচ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাতের শেষাংশে আল্লাহ প্রথম আসমানে আগমন করেন এবং জিজ্ঞেস করেন, কোন প্রার্থনাকারী আছে কি যাকে আমি দান করবো? কোন দোয়াকারী আছে কি যার দোয়া আমি কবুল করবো? এবং গুনাহের জন্য কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমি যার পাপরাশি ক্ষমা করবো? এ অপূর্ব সুযোগ একজন ঈমানদার হাতছাড়া করতে পারে না?
ইফতারের সময় হওয়ার কিছু পূর্বেই দস্তখানে বসা উচিত। কত সুন্দর দৃশ্য! সামনে কত রং বেরংয়ের খাবার, কিন্তু’ বান্দা সেদিকে হাত বাড়াচ্ছে না শুধু রবের অনুমতির অপক্ষোয়। আহা! দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতিও যদি রবের অনুমতি ছাড়া হাত না বাড়াতাম! ইফতারের পূর্ব মুর্হূতে বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তিগফার করা উচিত।
১.আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস থেকে বর্ণিত। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-ইফতারের সময় রোযাদারের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। তাই ইফতারের সময় সকলেরই উচিত অধিক পরিমাণে দোয়া করা। (ইবনে মাজাহ:১৭৫৩)
২.এই হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু ইফতারের সময় নি¤েœাক্ত দোয়া পড়তেন : অর্থ :‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার ঐ রহমতের ওছিলায় প্রার্থনা করছি, যা সকল বসতে পরিব্যাপ্ত, আমাকে ক্ষমা করে দিন। (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩ ও আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ : ৪৮১)
৩.হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে ক্বদরে পড়ার জন্য একটি দোয়া শিখিয়েছেন। শেষে দশকের রাতে এই দোয়া বেশি বেশি পড়া উচিত। ইফতারের পূর্বেও তা পড়া যায়। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে ভালবাস। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
৪. হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এটা প্রতি রাতে। (ইবনে মাজাহ : ১৬৪৩)
৫.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় নানা রকমের দোয়া করেছেন। মুয়াজ বিন যাহরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-আল্লাহুম্মা লাকা সমতু ওয়ালা রেজকিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়াআর হামার রাহিমীন।
৬.আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-পিপাসা দূর হয়ে গেছে, অন্ত্রনালী পানি ভিজেছে এবং ইনশাআল্লাহ পারিশ্রমিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (আবু দাউদ কিতাবুস সিয়াম,আন-নাসাঈ,হাকেম)
৭.আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ বিন মোয়াজের ঘরে ইফতার করেন। ইফতারের সময় তিনি বললেন-তোমাদের নিকট রোযাদারগণ ইফতার করেছে, নেক বান্দাগণ তোমাদের খাবার গ্রহণ করেছে এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য রহমত ও বরকতের দোয়া করেছে। (ইবনে মাজাহ,ইবনে হিব্বান ও আবু দাউদ)
৮.আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন-হে আল্লাহ! আমি তোমাদের রহমত কামনা করি যা সকল বস্তুর ও বিস্তৃত। তুমি আমার পাপরাশি ক্ষমা কর (ইবনে মাজাহ ও হাকেম)
বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তেগফার করুন
এক হাদীসে এসেছে, ‘রোযাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রমযানে রোযাদারকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে শেষে রাত দোয়া ও ইস্তেগফারের সবচেয়ে উপযাগী সময়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন আল্লাহতায়ালা নিকটর্বতী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।(সহীহ আল বুখারী : ১১৪৫ ও সহীহ মুসলিম : ৭৫৮)
কি দিয়ে ইফতার করবেন
খেজুর দিয়ে ইফতার করা সর্বোত্তম। নতুবা অন্তত ইফতারের সূচনা পানি দিয়ে করা উচিত ।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তা বরকতের খাদ্য। যদি তা না থাকে তাহলে পানি দ্বারা। কেননা তা পবিত্র বস’। (জামে আত-তিরমিযী : ৬৯৫ ও সুনানে আবু দাউদ : ২৩৫৫)
রোযাদারকে ইফতার করানো
১. এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, ইহার বিনিময়ে তার সমস্ত গুণাহ মাফ হয়ে যায় এবং সে জাহান্নাম হতে মুক্ত হয়।’ ‘তাছাড়া সে উক্ত রোযাদার ব্যক্তির তুল্য ছওয়ারও পাবে। এতে অবশ্য উক্ত রোযাদারের ছওয়াবে একটুও কমতি করা হবে না।’
২ .রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোযাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটতি না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (জামে আত-তিরমিযী: ৮০৭ ও মুসনাদে আহমাদ)
৩. বললাম ইয়া রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের এমন কিছু সংস্থান নাই যা দ্বারা আমরা রোযাদারকে ইফতার করাতে পারি। তদুত্তরে হুযুরে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই ছওয়াব আল্লাহতায়ালা ঐ ব্যক্তিকেও প্রদান করবেন, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে এক ঢোক দুধ বা একটি খোরমা কিংবা সুমিষ্ট পানি দ্বারা ইফতার করাবে।’
৪. যে কেউ কোন কিছু দিয়ে ইফতার করাবে তা তার জন্য মাগফিরাতের কারণ হবে এবং দোযখে থেকে বাঁচার উপায় হবে; আর ঐ ব্যক্তি রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে যদিও রোযাদারের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা’।” বর্ণণাকারী বললেন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের অনেকেরই রোযাদারকে কোন কিছু দিয়ে ইফতার করানোর সাধ্য নেই।” তিনি (রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহ তাদেরকে এই পুরস্কার দেবেন যারা পানিমিশ্রিত একটু দুধ, একটি খেজুর অথবা শুধু পানি দিয়ে রোযাদারকে ইফতার করাবে। আর যে রোযাদারকে পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে আল্লাহ তাকে আমার হাউজ (হাউজে কাওসার) থেকে পানি পান করাবেন যা জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তার থেকে তৃষ্ণা দূর করে দেবে।
ইফতার করার ফযীলত
ইফতারের ফযীলত ইফতারের ফযীলতের বর্ণনায় আমরা প্রচুর হাদিস দেখতে পাই। সমস্ত দিনে যত লোককে মহান আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেন, শুধু ইফতারের পূর্বক্ষণে এতজনকে ক্ষমা করেন। রোযাদার ইফতারের পূর্বক্ষণে ইফতারের জন্য খাদ্য সামনে নিয়ে বসে যে দোয়া করে আল্লাহ তা কবুল করে নেন। ইত্যাদি।
১. হযরত সালমান ফারর্সী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন: এ মাসে কোন ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাসমুহ মোচন করা হবে এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দেয়া হবে। রোযাদার যে পরিমান সওয়াব পাবে সেও সে পরিমান সওয়াব পাবে। এ কারণে রোযাদারের সওয়াবের কোন ঘাটতি হবেনা।
২. হযরত যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানী হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে লোক একজন রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য সেই রোযাদারের মতই সওয়াব লিখা হবে। কিন্তু তাতে মূল রোযাদারের শুভ প্রতিফল হতে এক বিন্দু কম হবে না। (সহীহ আল বুখারী,সহীহ মুসলিম,মুসানাদে আহমদ,জামে আত-তিরমিযী,আন-নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
৩. হযরত সালমান ফরসী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে লোক কোন রোযাদারকে কিছু হালাল জিনিস খাওয়ায়ে ও পান করায়ে ইফতার করায় ফিরিশতাগণ রমযান মাসের সমস্ত সময় ধরে তার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ক্বদর রাত্রিতে তার জন্য রহমতের দোয়া করেন। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও তাবরানী ইবনে হাব্বান )
রমযান মাসে রোযাদারকে খাওয়ানোর ফযীলত
১. হযরত সালমান ফারর্সী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী করীম সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন: এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পেট পুরে খাওয়াবে, আল্লাহ আমার হাউজ থেকে এমন ভাবে সিক্ত করবে, জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে কখনো তার তৃঞ্চা পাবেনা। (সুনানে বায়হাকী)
২. আর যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে আমার ‘হাউজ কাওছার’ হতে এমনভাবে পর্যাপ্ত করে পান করাবেন যে, বেহশেতে না যাওয়া অবধি তার আর পিপাসা লাগবে না।
গোলামদের কাজের বোঝা হালকা করা
১. রমযান এমন একটি মাস যার প্রথম অংশে আল্ল¬াহর রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত এবং তৃতীয়াংশে দোযখ হতে মুক্তি দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে আপন গোলাম/শ্রমিকের কাজের বোঝা হালকা করে দেয় আল্ল¬াহপাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং দোযখের আগুন হতে নাজাত দান করবেন। (সুনানে বায়হাকী)

নারী বিষয়ক কিছু কথা
নারী বিষয়ক কিছু কথা রমযান নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য ইবাদতের মাস। আমাদের নারীরা রমযানে ইবাদতের সময়কে খাদ্য তৈরীর কাজে ব্যয় করে ফেলেন। রমযানকে সংযমরে মাস বলা হলেও আমাদের পরিবারগুলোতে এই সময় প্রয়োজন থেকে অতিরিক্ত খাদ্য তৈরী করে অপচয় করা হয়। অনেকের ধারণা রমযান মাসে বেশি খাওয়ার কোন হিসাব নেওয়া হয় না। এই কথাকে সত্য স্বীকার করলেও যে বলতে হবে অতিরিক্ত খাওয়ায় যদি শরীর খারাপ করে তবে নিশ্চয় ইসলাম তা অনুমোদন করবে না। আর অপচয়তো কোনভাবেই জায়েজ হবে না। হাদীসে বলা হয়েছে ‘আল মুবাজিজরুনা কানু ইখওয়ানাস শায়াতিন।’ অর্থাৎ অপচয়কারী শয়তানের ভাই। মহিলাদের উচিৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য তৈরিতে সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হওয়া। অনেক মহিলা খাদ্য তৈরী এবং পরিবেশনে এতো ব্যস্ত থাকেন যে নিজের নামায এবং ইফতারের সময় পান না। এটা সর্ম্পূণ অনুচিৎ। এদিকে পুরুষদেরও দৃষ্টিপাত প্রয়োজন। প্রত্যেকে পুরুষের উচিৎ এই সব কাজে কমপক্ষে রমযান মাসে স্ত্রী, মা, বোনদেরকে সাহায্য করা। নিজেরা বসে কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ, নামায কিংবা ইফতার পূর্ব সময়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করলেন আর নারীদের কে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলেন, তা সর্ম্পূণ অমানবিক এবং হযরত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের পরিপন্থি কাজ। হযরত রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাঁর স্ত্রীদের সাথে রান্নার কাজে সহযোগিতা করতেন।

তারাবীহ
নিয়মতি তারাবীহ পড়া এ মাসের বিশেষ আমলের মধ্যে তারাবী নামায অন্যতম। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
তারাবীহ রাকায়াত সংখ্যা
তারাবির নামায সুন্নাতে মোয়াক্কাদা, এব্যাপারে উলামায়ে কেরামদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। কত রাকাত তারাবি পড়েত হবে? তা নিয়ে কিছু মতানৈক্য আছে। এখানে কেউ বলেছেন আট রাকাত, কেউ বলেছেন বারো রাকাত, আর কেউ বলেছেন বিশ রাকাত। বেশির ভাগের মতে বিশ রাকাত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মত বিশ রাকাতের পক্ষে। এখানে প্রত্যেকের পক্ষেই হাদীসের দলিল আছে। এ নিয়ে উম্মতের ভিতর ফেতনা সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই
তারাবির নামায পড়ার ফযীলত
হাদীস
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশা নিয়ে রমযানের রাতে কিয়াম (রাত জেগে ইবাদাত করা ও তারাবীহ পড়া ইত্যাদি) পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গোণাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
২. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বললেন, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা রমযান মাসের রোযা থাকা তোমাদের প্রতি ফরয করে দিয়েছেন। আর আমি তোমাদের জন্য সুন্নাতরূপে চালু করেছি রমাযান মাসব্যাপী আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো। কাজেই যে লোক এই মাসের রোযা পালন করবে আর আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে ঈমান ও চেতনাসহকারে, সে তার গুনাহ হতে নি®কৃতি লাভ করে সেই দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। (মুসনাদে আহমদ ও আন-নাসাঈ)
৩. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদীসে এভাবে বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম তার নামায শেষ করা পর্যন্ত নামায আদায় করবে তার জন্য তা সারা রাত জেগে ইবাদত করা হিসেবে গণ্য হবে।”

ইতিকাফ
আল্লাহর সন্তুষ্টির লাভের উদ্দেশে কোন মসজিদে বাস বা অবস্থান করে ইবাদত বন্দগেী করার নাম ইতিকাফ। ইতেকাফের শাব্দিক অর্থ-অবস্থান করা, কোন বস্তুর ওপর স্থায়ীভাবে থাকা। আর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি মসজিদে বাস ও অবস্থান করা। ইতিকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ আটকিয়ে রাখা বা আবদ্ধ থাকা। তবে সব আটকিয়ে রাখা বা আবদ্ধ রাখাকে ইতিকাফ বলা যাবে না। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টিতে ইবাদতের নিয়্যতে পুরুষেরা মসজিদে এবং নারীরা নিজের ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। ইতিকাফ এমন এক বৈধ নির্জনতা যেখানে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদত, যিকির ও আল্লাহার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে নিজের আতœা ও সত্তাকে একান্তভাবে নিয়োজিত করে এবং নামায, কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিজকে সম্পূর্ণ বাস্ত রাখে। ইতিকাফের ফযীলত যে ব্যক্তি সহীহ নিয়তে এবং খাঁটি ঈমানের সাথে পূণ্যের উদ্দেশে ইতিকাফ করবে তার পূর্ববর্তী সমস্ত সগিরা গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (দায়লমী)। উল্লখ্যে যে কবিরাহ গোনাহ তাওবাহ ছাড়া মাফ হয় না।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
ইতেকাফের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথে যেন কোন দুনিয়াবী চিন্তা ও কাজ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। তার জন্য নির্জনতা/ মসজিদে অবস্থান করা।
ইতেকাফের উদ্দেশ্য হলো শবে ক্বদরের রাতকে তালাশ করা। ইতেকাফকারী আল্লাহর কাছে নিরবে একাকী দোয়া ও কান্নাকাটি করবে এবং এবাদত করবে।
ইতিকাফের প্রকারভদে
ইতিকাফ চার প্রকার-
১. মোস্তাহাব: রমযানের শেষে দশদিন ব্যতীত যে কোন সময় ইতিকাফ করা মোস্তাহাব।
২. নফল: উলামায়ে কেরামের মতে কেউ যদি ব্যস্ততার কারণে ১৯ রমযান থেকে এতেকাফে বসতে না পারে, তবে সে যে কোন সময় নফলের নিয়তে এতেকাফে বসতে পারবে, প্রয়োজন মতো বেরিয়ে গিয়ে কাজ শেষে আবার এসে বসতে পারবে এর জন্য কাজা ওয়াজিব হবে না। এই ইতিকাফ অনেকটা মোস্তাহাবের মতো।
৩. সুন্নতে কেফায়াহ: এটা অনেকটা জানাজার নামাজের বিধানের মতো গোটা উম্মতের পক্ষ থেকে কয়েকজনের আদায় করলে আদায় হয়ে যায়। রমযানের শেষে দশদিন এমন মসজিদে এই ইতিকাফ করতে হয় যেখানে জামাতে নামায হয়।
৪. ওয়াজিব: মান্নতের ইতিকাফ অর্থাৎ কেউ যদি ইতিকাফ মান্নত করে। মান্নত ইতিকাফের জন্য রোযা রাখেত হবে। মান্নত এতেকাফে কেউ যদি শুধু দিনের কথা বলে তবে শুধু দিনে করলেই চলবে। শর্তের ভেতরে যদি রাতের কথাও থাকে তবে রাতেও করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি শুরু রাতে ইতিকাফের মান্নত করে তবে তা গ্রহণযাগ্য নয়। সুন্নতে কেফায়াহ কিংবা ওয়াজিব ইতিকাফ ভঙ্গ করলে কাজা ওয়াজিব হবে।
ইতিকাফের বিধানসমূহ
১. যে মসজিদে জামাতে নামায হয় পুরুষেরা সেই মসজিদে ইতিকাফ আদায় করবে। নারীরা ইতিকাফ আদায় করবে ঘরে।
২. নিয়ত ছাড়া ইতিকাফ আদায় হবে না।
৩. ইতিকাফের সময় মহিলাদের হায়েজ, নেফাজ এবং ফরয গোসলের প্রয়োজন থেকে পবিত্র হতে হবে। ইতিকাফ চলাকালীন সময় গোসল ফরয হলে সাথে সাথে গোসল করে নিতে হবে।
৪. ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, পরে মসজিদে নববী, তারপর মসজিদুল আকসা, তারপর যে কোন জামে মসজিদ (জামে মসজিদ বলা হয় যেখনে জুম্মার নামায হয়), অতঃপর মহল্লার পাঞ্জেগানা মসজিদ।
৫. ইতিকাফ অবস্তায় দুই কাজ হারাম-
ক) ইতিকাফের স্থান থেকে শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত বের হওয়া। শরয়ী প্রয়োজন হলো-পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফ করলে জুম্মার নামাজের জন্য জামে মসজিদে যাওয়া। প্র¯্রাব, পায়খানা, ফরয গোসল, খাবার আনার কেউ না থাকলে নিজে গিয়ে খেয়ে আসা ইত্যাদিকে তাবয়ী প্রয়োজন বলে মাসায়ালের কিতাব সমূহে পৃথক করা হলেও এগুলো প্রকৃত অর্থে শরয়ী প্রয়োজনের অর্ন্তভূক্ত। এই ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান হলো প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে মসজিদে ফিরে আসা। জরুরী প্রয়োজন ব্যতিত সামান্য সময়ের জন্য বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
খ) এই কাজ করা যা ইতিকাফ অবস্থায় নাজায়েজ। যেমন ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় মসজিদে কিংবা মসজিদের বাইরে স্বামী স্ত্রীর যৌন মিলন হওয়া। যদি চুম্বন কিংবা আলিঙ্গনে বীর্যপাত না হয় তবে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না, কিন্তু গোনাহ হবে। কল্পনা, চিন্তা কিংবা স্বপ্নগত কারণে বীর্যপাত হলে ইতিকাফ নষ্ট হবে না, তবে সাথে সাথে গোসল করে নিতে হবে।
ইতিকাফ অবস্থায় যে দু রকমরে কাজ হারাম তা যদি কেউ করে ফলে তবে তার ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। মোস্তাহাব কাজের কাজা করতে হয় না। বাকিগুলোর কাজা করতে হবে।
৬. ইতিকাফের সময় একেবারে নীরবে চুপ থেকে বসে থাকা উচিৎ নয়। কুরআন তেলাওয়াত, দ্বীনি শিক্ষা অর্জন কিংবা দ্বীনি শিক্ষা দান, তাসবীহ ইত্যাদিতে সময় দেওয়া উত্তম। চুপ করে থাকার নাম কোন ইবাদত নয়।

রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ
শবে ক্বদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ইতিকাফ করা। রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে শবে ক্বদর বলা ঠিক নয়। কারণ হাদীসে শেষ দশকে শবে ক্বদর অন্বষেণ করতে বলা হয়েছে। তাই শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদাত করা চাই। মাসনূন ইতিকাফ দশ দিন। যাদের দশ দিন ইতিকাফ করার সুযাগ নেই বা সাহস হয় না তারা দুই তিন দিন নফল ইতিকাফ করতে পারেন। এ মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করার অনেক গুরুত্ব। ইতিকাফে বসলে ইবাদতের মওসুম রমযানকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো সহজতর হয়। ইতিকাফের সর্ব্যত্তেম ক্রমানুসারে
১। মসজিদুল হারাম
২। মসজিদে নব্বী
৩। মসজিদে আকসা
৪। জুমাআর মসজিদ
৫। পাঞ্জেগানা মসজিদ
১. কারণ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকে শবে ক্বদর অন্বেষণ কর।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘তোমরা শেষ দশকে বেজোড় রাত্রগিুলোতে শবে ক্বদর তালাশ কর।’(সহীহ আল বুখারী: ২০১৭; ২০২০)
২. রাসূলুল্লাহ কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের একুশতম রাত এল তখন তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমকে শবে ক্বদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকরে অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে ক্বদর খোঁজ কর।’(সহীহ আল বুখারী : ২০২৭ ও সহীহ মুসলিম : ১১৬৭) সুতরাং বুঝা গলে যে, শেষ দশকে যে ইতিকাফ করবে তার শবে ক্বদর নসীব হবে।
৩. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (সহীহ আল বুখারী : ২০২৫; সহীহ মুসলিম : ১১৭১ ও আবু দাউদ : ২১০৯)
৫. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (সহীহ মুসলিম : ১১৭২)
৬. যে ব্যক্তি রমযানের শেষ দশ দিনের ইতেকাফ করে সে হজ্জ ও ওমর করার সমান সওয়াব পায়।
৭.হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত এ নিয়ম তিনি পালন করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফের সিলসিলা জারি রাখেন। (সহীহ আল বুখারী)
৮.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমযানের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন।
ইতিকাফের ফযীলত
১. হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহতায়ালা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিনি খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুআবুল ঈমান : ৩৯৬৫)
২. হযরত আলী বিন হোসাইন নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ বলেছে: যে ব্যক্তি রমযানের শেষ দশ দিনরে ইতেকাফ করে সে দুই হজ্জ ও দুই ওমর করার সমান সমান সওয়াব পায়।
৩. হযরত আবদুল্ল¬াহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্ল¬াহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একদিন ইতেকাফ করবে, আল্লাহতায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিনটি গহ্বর সৃষ্টি করবেন-যার দূরুত্ব আসমান ও যমীনের দূরত্বের চেয়েও অধিক হবে।
৪. যে ব্যক্তি একদিনও ইতিকাফে বসবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার মধ্যে এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দকের ব্যবধান করবেন। এক খন্দক পাঁচশাত বৎসরের পথ।
৫. যে ব্যক্তি বিশ্বাসসহকারে ও সোয়াবের আশা নিয়ে ইতিকাফ করবে আল্লাহতায়ালা তার অতীতের সকল গুনা মাফ করে দিবেন।

লাইলাতুল ক্বদর
মাহে রমযানের যে রাতে পবিত্র কুরআন অবর্তীণ হয়েছে, সেই রাত্র ‘লাইলাতুল (শবে) ক্বদর’ নামে অভিহিত। লাইলাতুল ক্বদর আরবী শব্দ। লাইলাতুল ক্বদরের মধ্যে দু’টি শব্দ আছে:
১) লাইলাতুন
২) ক্বদর
আরবীতে রাতকে লাইলাতুন বলে। আর ক্বদর শব্দের আভিধানিক অর্থ দু’টি।
১) নির্ধারন করা, সিদ্ধান্ত করা, বন্টন করা অর্থাৎ তকদীর বা ভাগ্যরজনীর রাত।
এই মোবারক রজনীতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারন করা হয়। আগত এক বছর প্রতিটি মানুষের জীবনে যা কিছু ঘটবে, যা কিছু ভোগ করবে, যা কিছু থেকে বঞ্চিত হবে ইত্যাদি সব কিছু ক্বদর রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। এই জন্য রাতটিকে ভাগ্য রজনী বলা হয়।
কুরআন
১. বরকতময় রাতে প্রত্যেকটি হেকমতপূর্ণ হুকুম ফায়সালা করা হয় আমার নিকট থেকে। (দুখান: ৩-৪)।
২. আমি এ কুরআন কে ক্বদরের রাতে নাযিল করেছি। (ক্বদর : ১)
৩. আর ক্বদরের রাত সম্বন্ধে তোমার কি জানা আছে। (ক্বদর : ২)
৪. ক্বদরের রাতে ফেরেশতাসমূহ এবং জিবরাঈল তাদের প্রভূর অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হন। (ক্বদর : ৪)
৫. ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত ঐ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময়। (ক্বদর : ৫).
অপর এক সূরায় এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হা-মীম। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সর্তককারী।’ (দুখান : ১-৩)
হাদীস
১. হযরত ইমাম নাবাবী ও মোল্লা আলী কারী, মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন এ রাতকে ক্বদরের রাত (নির্ধারণ করার রাত) বলে এজন্য নাম রাখা হয়েছে। এ রাতে এক বছরের বিভিন্ন রিযিক, ভাগ্যসমূহ, যত সন্তান পয়দা হবে, যত মানুষ মারা যাবে এ রাতে ফেরেশতাদের দ্বারা লেখানো হয়।
২. ইমাম শাওকানী (রহ:) বলেন: লাইলাতুল ক্বদর (নির্ধারণ করার রাত) বলে নাম রাখা হয়েছে এ জন্য যে, এ রাতে আল্লাহতায়ালা আগামীতে এক বছর পর্যন্ত তাঁর হুকুমগুলো থেকে যা ইচ্ছা নির্ধারণ করেন।
৩. আল্লামা কুতুবুদ্দীন শাহজাহান আবাদী বলেন, এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর এ জন্য বলে যে, পূর্ণ এক বছরের রিযিক, যত সন্তান পয়দা হবে এবং যত মানুষ মারা যাবে এ হুকুমগুলো এ রাতে লেখা হয়।
সমস্ত মুফাস্সীরিন বলেন হেকমতপূর্ণ হুকুমগুলো হলো এক বছরে যত সন্তান পয়দা হবে, যত মানুষ মারা যাবে, বিভিন্ন রিযিক এবং গুরুত্বপূর্ণ হুকুমগুলো ক্বদরের রাতে সিদ্ধান্ত হয়ে জারি করা হয়।
৪. সম্মান মর্যাদা অর্থাৎ সম্মানিত রাত্রি। হাজার মাসের চেয়েও অধিক মর্যাদা ও তাৎপর্যপূর্ণ এই রাত। এই রাতেই আল্লাহতায়ালা লওহে মাহফুয থেকে প্রথম অকাশে কুরআন নাযিল করেছেন। এর পর ২৩ বছরে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় ইবাদত করে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হয়। (সহীহ আল বুখারী)
৬. হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার রমযান মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দেখ এ মাসটি তোমাদের নিকট এসে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত আছে, যেটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হল, সে যাবতীয় কল্যাণ হতেই বঞ্চিত হল। আর চিরবঞ্চিত ব্যক্তি-ই কেবল এর সুফল হতে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাযাহ)
৭. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে অনুসন্ধান কর। (সহীহ আল বুখারী)
৮. এ রাতের বিরাট সম্মান ও মর্যদার কারণে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর (সম্মানিত রাত) বলে নাম রাখা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম ও মিশকাত)
৯. লাইলাতুল ক্বদর (সম্মানিত রাত) বলে নাম রাখা হয়েছে এ রাতের বিরাট সম্মান ও মর্যাদার জন্য। (ফাতহুল কাদীর)
১০.এ রাতের বিরাট সম্মান হওয়ার কারণে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর (সম্মানিত রাত) নাম রাখা হয়েছে। (মাজাহেরে হক)
লাইলাতুল ক্বদরের রাতে ইবাদাত করার ফযীলত
মহান আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি রাত ও দিন মানবজাতির অগনিত কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত। কিন্তু শবে-ক্বদর, শবে বরাত, শবে মিরাজ, শবে ঈদ, জুমাতুল বিদা, জুমার দিন ঈদের দিন, হজ্জের দিন, রোযার দিন এমনকি আরাফাতের রজনী মানবজাতির বিশেষ আশা আকাঙ্খার দিন ও রাত। এদের মধ্যে শবে-ক্বদর সর্বাপেক্ষা উত্তম ও বরকতময় রাত্রি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন সব রাতের মধ্যে শবে-ক্বদরের রাতই সর্বোত্তম। অন্য কোন রাত ক্বদরের রাতের সমতুল্য হতে পারে না। এমনকি ৩৬৪/৩৬৫ রাত একত্র হয়েও এ রাতের সাথে কোন প্রতিযোগিতা ও প্রতিন্দ্বিতা করতে পারে না। ক্বদরের রাতটি হলো সমস্ত রাতগুলো রাজা। আকাশের তারকারাজির উপর পূর্ণচন্দ্রের যেরূপ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে এ রূপ সমস্ত রাতের উপরে ক্বদরের রাতের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।
কুরআন নাযিল
১. রমযান সেই মাস, যে মাসে নাযিল করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত তথা পথ প্রদর্শনকারী এবং পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ। আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (বাকারা-১৮৫)
২. আমি কুরআনকে বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। (দুখান-৩)
৩. আমি কুরআন শরীফকে ক্বদরের রাতে নাাযিল করেছি। (ক্বদর-১)
লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা
রমযান মাসটি হলো ইবাদতের মওসুম। এ মাসে ইবাদতের গুরুত্ব অনেক বেশি। নানা হাদীসে এ মাসে বিভিন্ন ইবাদতের ছাওয়াব নানাভাবে বর্ণিত হয়েছে।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশা নিয়ে লাইলাতুল ক্বদের কিয়াম (রাত জেগে ইবাদাত) পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গোণাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ মুসলিম : ৭৬০ ও সহীহ আল বুখারী : ২০১৪) সুতরাং এই ফযীলত লাভে সচষ্টে হওয়া কর্তব্য।
২.অন্তত ইশা ও ফজর যদি জামায়াতের সাথে হয় তবুও সারারাত নামায পড়ার সমান ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং শবে ক্বদরের ন্যূনতম ফযীলত লাভ করা যাবে। কারণ এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজর জামায়াতের সাথে পড়ল সে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামায পড়ল।(সহীহ মুসলিম : ৬৫৬ ও মুসনাদে আহমদ : ৪০৮)
৩. রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত্রি পাবে, আল্লাহতায়ালা তার উপর জাহান্নামের অগ্নি হারাম করে দিবেন এবং সমস্ত অভাব পূরণ করে দিবেন।
৪. হযরত ওবাদাহ থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: যে ক্বদরের রাত্রের অন্বেষণে সেই রাতে নামায পড়ে এবং তা পেয়ে যায়। তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: যে রমযানে এশার নামায জামায়াত সহকারে আদায় করে সে ক্বদরের রাতে ফযীলত লাভ করে। (আবুশ শেখ ইসপাহানী)
৬. রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন এ রাত হাজার মাস থেকে উত্তম। একদিন রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম নিজে উম্মতের কাছে বনী ইসরাইলদের মধ্যে খুব বড় আবেদ হযরত শামাউন আলাইহিস সালামের একটি ঘটনা বলেছিলেন: শামাউন আলাইহিস সালাম দিবসে জিহাদ করতেন আর সারারাতে ইবাদাতে মুশগুল থাকতেন। এক হাজার মাস ধরে তিনি তার এ সাধনায় রত থাকেন। একথা শুনে সাহাবা কেরাম আক্ষেপ করে বললেন হে, রাসূল আপনার উম্মতের হায়াত এরূপ দীর্ঘ হবেনা তা নইলে তারাও ইবাদত করতে পারতো। হযরত চিন্তিত হলেন এবং তার পরই সূরা ক্বদরের এই আয়াত নাযিল হলো। অর্থাৎ তোমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদাত করবে তাকে হাজার মাসের ইবাদাতের চাইতেও বেশী সওয়াব দান করব।
আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায: সাহাবাগণ আল্লাহর রাসূলের কাছে গেলেন, বললেন আগের কালের মানুষ বহু বছর বেঁচেছে। নূহ আলাইহিস সালাম নয়শত বছর বেঁচেছিলেন। তারা দীর্ঘ জীবনে আখেরাতের জন্য কত পূণ্য সঞ্চয় করেছেন। আমরা আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে অনন্তকাল আখেরাতের জন্য কতটুকু পূণ্য সঞ্চয় করতে পারব ? তখন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের জন্য শবে ক্বদর রয়েছে। সাহাবীরা খুশী হয়ে চলে গেল।
৭. রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এর এশকত ডানা (পাখা) আছে, সেগুলোর মধ্যে এমন দুইটি ডানা আছে যা তিনি ক্বদরের রাতে বিস্তৃত করেন এবং তা পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত ছড়িয়ে পড়ে। এর পর তিনি ফেরেশতাদেরকে উদ্ভুদ্ধ করতে থাকেন। ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত লোককে সালাম করতে থাকেন যারা দাঁড়িয়ে বসে ইবাদাত করে আর যারা নামায পড়ে এবং যারা আল্লাহর স্মরণ করে। তারা তাদের সাথে করমদন করে এবং তাদের দোয়ায়ও শামিল হয়ে আমীন বলতে থাকে ফযর উদয় হওয়া পর্যন্ত। অতপর ফযর হলে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম উচ্চস্বরে বলেন, হে ফেরেশতাগণ চল, চল। তখন ফেরেশতাগন বলে, হে জিবরাঈল! আহমাদ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম এর মু’মিন উম্মতের আশা-আকাংখাও প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে আল্লাহতায়ালা কি করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা এ রাতে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন এবং তাদেরকে সম্পুর্ণ রূপে ক্ষমা করেছেন।

কিন্তু চার শ্রেণীকে ক্ষমা করেনি। (একথা শুনে সাহাবীগণ বলেন) হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ! সে চার শ্রেণী কারা? রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন:
১। শরাব খোর
২। মাতা পিতার অবাধ্যাচারী নাফরমানকারী
৩। আতœীয়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী
৪। অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও শক্রতা পোষণকারী
৮. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আমার উম্মতেরা! তোমরা রমযান মাসে চারটি আমল অধিক পরিমাণে কর। তম্মধ্যে দুটি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। আর দুটি যা না হলে তোমাদের উপায়ন্তর নেই। প্রথম দুটি হলো (এক) কালেমা তাইয়্যিবাহ, এবং (দুই) এস্তেগফার বেশি বেশি করে পড়া। আর শেষ দুটি হলো (তিন) আল্লাহর কাছে বেহেস্ত চাও এবং (চার) দোযখ থেকে মুক্তি চাও। রহমত ও মাগফিরাতের দশক অতিবাহিত করে নাজাতের দশকে রয়েছি। আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করতে হবে। অতীত অপরাধের কথা স্মরণ করে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে। জাহান্নাম কতই না ভয়ংকর জায়গা,এর অধিবাসীদের যে কত কঠোর শাস্তি দেয়া হবে তা চিন্তা করলে বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয়। জাহান্নামে যেন আমাদের প্রবেশ করেত না হয় এজন্য রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমযানেরশেষ দশ দিনে আল্লাহর কাছে নাজাত চাও এবং জান্নাতের প্রত্যাশা কর। রমযানের প্রথম দশদিন ইবাদাদের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমতের সীমাহীন সাগরে বিচরণ করবে। দ্বিতীয় দশকে বন্দেগী করে তার ক্ষমা লাভে নিজেকে ধন্য করবে এবং শেষ দশ দিনে ইবাদতের মাধ্যমে রহমত ও মাগফিরাতকে পূঁিজ করে আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইবে। হিংসা-বিদ্বেষ, ওয়ালৌকিকতা পরিহার করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে নি:সন্দেহে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করবেন। জাহান্নাম থেকে নাজাত দেবেন। তাছাড়া রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর গোপন রয়েছে। অতএব এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর সময় এখই। নাজাত লাভের সর্বোত্তম সুযোগ রমযানের শেষ দশক । কোনো রোযাদারই যেন এই সুবর্ণ সুযোগ না হারায়।
৯. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেছেন, তোমাদের নিকট রমযান মাস সমুপস্থিত। উহা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহতায়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় ও সেরা শয়তানগুলো আটক করে রাখা হয়। আল্লাহর জন্য এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এই রাত্রির কল্যাণ লাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যই বঞ্চিত ব্যক্তি। (আন-নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ ও সুনানে বায়হাকী)
ঝগড়া কারীদের শাস্তি
১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা খোলা হয়। মা’মার বলেন; সুহাইল ব্যতীত অন্যরা বলেছেন: প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার আমল পেশ করা হয়, অত:পর আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে না, তবে ঝগড়াকারী দুই ব্যক্তি ব্যতীত, আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের বলেন: এদেরকে অবকাশ দাও, যতক্ষণ না তারা মীমাংসা করে নেয়। (মুসনাদে আহমদ)
ক্বদরের রাতের দোয়া
১. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহুলল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ক্বদরের রাত্রিতে বেশী বেশী বলবে-
ক.“আল্ল¬াহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি”। অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমাকে পছঁন্দ কর। অতএব আমাকে ক্ষমা করো।
খ.“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আ‘ফুউন কারিমুন তুহ্বিবুল আ’ফওয়া ফাফু আ’ন্না। অর্থাৎহে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়, ক্ষমাকে তুমি পঁছন্দ কর, কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
(ইবনে মাজাহ, তিরমিযী, আহমেদ)
লাইলাতুল ক্বদরের সংঘঠিত ঘটনাবলী
১। লাইলাতুল ক্বদরে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদেরকে পয়দা করেন।
২। লাইলাতুল ক্বদরে বেহেশতের মধ্যে বৃক্ষসমূহ রোপন করা হয়।
৩। লাইলাতুল ক্বদরে হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর মূল ও উপদানসমূহ একত্রি করা হয়।
৪। লাইলাতুল ক্বদরে কুরআন শরীফ নাযিল করা হয়।
৫। লাইলাতুল ক্বদরে আল্লাহ প্রদত্ত খেলাফত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে সোর্পদ করা হয়।
৬। কিয়ামত পর্যন্ত প্রতি বছর লাইলাতুল ক্বদরেই মানুষের ভাগ্য বন্টন হতে থাকে।
৭। লাইলাতুল ক্বদরের রাতে নাম আল্লাহতায়ালা লাইলাতুল ক্বদর ও লাইলাতুল মোবারাকাহ রেখেছেন।
৮। লাইলাতুল ক্বদরের ফযীলত ও মর্তবা এক হাজার মাস থেকে উত্তম বলে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন।
৯। লাইলাতুল ক্বদরের রাতে অসংখ্য ফেরেশতা ও জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নাযিল হওয়ার কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন।
১০। লাইলাতুল ক্বদরের রাতে আল্লাহ খাছ রহমতের ভান্ডার সূর্যাস্ত থেকে আরম্ভ হয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত সর্বত্র বর্ষিত হতে থাকে।
১১। আগামী এক বছরের রিযিক, আহকাম, যত মানব সন্তান পয়দা হবে ও যত মানুষ মারা যাবে তা এ রাতে নির্ধারণ করা হয়।
১২। লাইলাতুল ক্বদরে অসংখ্য ফেরেশতা ও জিবরাঈল আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে এসে ইবাদতকারীদের সালাম ও করমদন করেন এবং তাদের দোয়ায় আমীন আমীন বলতে থাকেন।
১৩। লাইলাতুল ক্বদরের রাতে একনিষ্ঠভাবে ইবদাতকারী মু’মিনদের পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করা হয়।
১৪। লাইলাতুল ক্বদরের রাতে আল্লাহতায়ালা বান্দাহদের প্রতি সুদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
শবে-ক্বদরের নামাযের নিয়্যত
নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’তাই ছালা-তিল লাইলাতুল ক্বদর (নফল) মোতাওয়াজ্জিহান, ইলা-জিহালতিল, কা’বাতিশ শরী-ফাতি- আল্লাহু আকবার।

যাকাত
ইসলামী জীবন বিধানে যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্বের একটি অন্যতম স্তম্ভ। ঈমান এবং নামাযের পরই এর স্থান। প্রত্যেক ধনবান নর-নারীর ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সবচেয়ে বেশী তাগিদ এসেছে নামাজের। এর পর এসেছে যাকাতের। যাকাতের কথা পবিত্র কোরআনে অধকিাংশ স্থানে নামাজের পাশাপাশি এসেছে পবিত্র কুরআনে বিরাশিবার নামাজের তাগিদ এসেছে। তার প্রত্যেকবারই যাকাতের কথা বলা হয়েছে। যাকাত আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা বৃদ্ধি। মালের নির্ধারিত অংশ যাকাতের হকদারের কাছে পৌঁছে দিলে বাকি অংশ পবিত্র এবং বরকতময় হয়ে যায়। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো মালে নেসাবের মালিক ব্যক্তি তার মালের কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ অন্যকে মালিক করে দেয়া। অভিধানিক নিয়মে যাকাতের দুইটি অর্থ রয়েছে। একটি বর্ধিত হওয়া। অপরটি পবিত্র করা। শরীয়তের পরিভাষায় কোন কিছুর বিনিময় ব্যতিরেকে শরীয়তের নির্দেশিত খাতে নিজের মাল সম্পদের একাংশের স্বত্বাধিকার কোন অভাবী নি:স্ব-গরীবের প্রতি অর্পণ করাকে যাকাত বলে। যাকাত পবিত্র কুরআন হাদীসের অকট্য (ক্বতেয়ী) দলিলের মাধ্যমে ফরয। এরকমের যে কোন ফরয কাজকে কেউ অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। আদায় না করলে তাকে ফাসেক বলা যাবে।
১. নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকুকারীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে রুকু কর। (বাকারা-৪৩)
২. আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও, যেসব নেক কাজ তোমরা নিজেদের কল্যাণার্থে এখানে (দুনিয়ার জিন্দেগিতে) করবে তার সবটুকুর প্রতিফলই আল্লাহর কাছে পাবে। (বাকারা-১১০)
৩. অথচ তাদেরকে এমনি হুকুম দেয়া হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদাত এমনভাবে করবে যাতে তা একমুখী হয়ে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়। আর তারা যেন নিয়মিতভাবে নামায ও যাকাত আদায় করে। এটিই হচ্ছে দ্বীন। (বাইয়েনাহ-১০৩)
৪. তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ কর, যার সাহায্যে তুমি তাদেরকে গুণাহমুক্ত করবে এবং তাদেরকে পাক-পবিত্র করে দেবে। (তাওবা-১০৩)
৫. যদি তারা (কুফর ও শিরক থেকে) তাওবা করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। (তাওবা-১১)
৬. তারা এমন লোক, যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে নামায কয়েম করবে, যাকাত দেবে, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। আর সব বিষয়ের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে। (হজ্জ-৪১)
৭. আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমারই বিধান অনুযায়ী পরিচালিত পথ প্রদর্শন করে। আমি ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভাল করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করছি, তারা খাঁটিভাবে আমার ইবাদত করে। (আম্বিয়া-৭৩)
৮.আল্লাহ আমাকে বরকতময় করেছেন-যেখানেই আমি থাকি না কেন এবং আমি জীবিত থাকব ততদিন নামায পড়া ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন।
৯.এবং ইসমাইল তার আপন লোকজনকে নামায ও যাকাতের জন্যে তাকীদ করত এবং সে তার রবের পছন্দসই বান্দাহ ছিল। (মরিয়ম-৫৫)
১০.হে বনি-ইসরাইলগণ। তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলুল্লাহগণের উপর ঈমান আন, তাদের সাহায্য কর, আল্লাহকে কর্যে হাসানা দাও, তাহলে আমি তোমাদের সঙ্গী এবং তোমার দোষত্রুটিগুলো দূর করে দেব। (অন্যথায় রহমত লাভের কোন আশাই তোমরা করতে পার না) (মায়েদা-১২)
১১.তোমাদের প্রকৃত বন্ধু সাহায্যকারী হচ্ছেন শুধু আল্লাহ, তার রাসূলুল্লাহ এবং ঈমানদার লোকগণ। ঈমানদার লোক তারাই যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহর সম্মুখে মাথা নত করে। (মায়েদা-৫৫)
১২.ঈমানদার পুরুষ এবং স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর বন্ধু ও সাথী। উহাদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, উহারা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে উহাদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন। (তাওবা-৭১)
১৩.আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তোমার যাকাত দাও, যাকাত দানকারী প্রকৃতপক্ষে তার মাল বর্ধিত করে। (রুম-৩৯)
হাদীস
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: পাঁচটি বস্তুর ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত।একথায় সাক্ষ্য দেয়া, যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইল্াহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূলুল্লাহ। দুই-নামায কায়েম করা। তিন-যাকাত আদায় করা। চার-বাইতুল্লাহর হজ্জ করা। পাঁচ-রমযানের রোযা রাখা।
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। একবার জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলো এবং বললো: হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো। তিনি বললেন আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে আর কোন কিছুই শরীক করোনা, নিয়মিত নামায পড়, ফরয যাকাত আদায় কর এবং রমযানের রোযা রাখ। সে ব্যক্তি বললো: সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ আমি এর উপর কিছুই বাড়াবোনা। তারপর যখন সে ফিরে যেতে লাগলো, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যে ব্যক্তি জান্নাতের কোন অধিবাসীকে দেখে নয়ন জুড়াতে চায় সে ঐ লোকটিকে দেখতে পারে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৮. জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি নামায কায়েম করার জন্য, যাকাত দেয়ার জন্য এবং প্রতিটি মুসলমানের কল্যাণ কামনার জন্য। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
যাকাতের উদ্দেশ্য
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: কুরআনের আয়াতে: যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে ও উহা আল্লাহর পথে খরচ করে না-যখন নাযিল হল (তাতে ধন-সম্পদ সঞ্চয়কারীদের পরকালে কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা বলা হয়েছে) এই করণে সাহাবায়ে কিরামের মনে উপর ভীষন চাপ পড়ল এবং তাঁরা চিন্তা-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তা বুঝতে পেরে বললেন: আমি তোমাদের এই চিন্তা ও উদ্বেগ দূর করতে চেষ্টা করব। অত:পর তিনি রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ। এই আয়াতটির কারণে আপনার সাহাবিগণ বিশেষ চিন্তা-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহতায়ালা যাকাত এই উদ্দেশ্যে ফরয করেছেন যে, তা আদায় করার পর অবশিষ্ট ধন-মাল যে পবিত্র হয়ে যায়-অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার আইন জারী করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তার দরুন তোমাদের পরবর্তী লোকদের জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হবে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই ব্যাখা শুনে আনন্দে আল্লাহু আকবার বলে উঠলেন। তার পর রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি কি তোমাদেরকে ইহা অপেক্ষাও উত্তম সঞ্চয়ের কথা বলব? তা হল পবিত্র স্বভাব-চরিত্রের স্ত্রী, যার দিকে সে যখন তাকাবে সে তাকে সন্তুষ্ট করে দিবে, যখন তাকে কোন কাজের আদেশ করবে, সে তা পালন করবে। আর যখন সে তার নিকট হতে অনুপস্থিত থাকবে তখন সে তার সংরক্ষণ করবে ।
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু কে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন তখন তাকে বলেছিলেন তুমি আহলি কিতাবদের এক জাতির নিকট পৌছবে। তাদেরকে এই কথার সাক্ষ্য দিতে আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ চাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহতায়ালার রাসূলুল্লাহ। তারা যদি তোমার এই কথা মেনে নেয় তারপর তাদেরকে জানিয়ে দাও যে আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি রাত দিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। তোমার এ কথাও যদি স্বীকার করে নেয়, তবে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি তাদের ধনসম্পত্তির উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। উহা তাদের ধনী লোকদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে ও তাদেরই গরীব ফকীর লোকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। তোমার এই কথাও যদি তারা মেনে নেয় তাদের উত্তম মালই যেন তুমি যাকাত বাবদ আদায় করে না নেও। আর তুমি মজলুমের দোয়াকে সব সময় ভয় করে চলবে। কেননা মজলুমের দোয়া ও আল্লাহর মাঝখানে কোন আবরণ নেই। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ)
৩. হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ করীমের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি নামায কায়েম করার জন্য, যাকাত দেয়ার জন্য এবং প্রতিটি মুসলমানের কল্যাণ কামনার জন্য। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মসুলিম)
৪. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। আমি রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬ামকে বলতে শুনেছি, যে সম্পদের সাথে যাকাতের (সম্পদ ও টাকা পয়সার) সংমিশ্রণ ঘটে তা সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়। (সহীহ আল বুখারী)
যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ
১. অবশ্যই যাকাত পাবে তারা যারা- ফকির (নি:শ্বলোক), মিসকিন (অভাবীরা), যাকাত আদায় ও বন্টনের কর্মচারী, মুয়াল্লাফাতুল কুলুব (ইসলামের পক্ষে যাদের মন জয় করা প্রয়োজন), ব্যয় হবে দায়গ্রস্তদের দায় পরিশোধ, দায়মুক্তির জন্যে ব্যয় হবে আল্লাহ রাহে এবং মুসাফিরদের জন্য। উহা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরয। আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান। (তাওবা-৬০)
রমযানে যাকাত প্রদান করা
রমযানের মতো যাকাত পৃথক একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজ যাকাত সাধারণত রমজানেই আদায় করে থাকেন। রমযানে যাকাত আদায়ের দুটি ফযীলত রয়েছে-
১. যাকাতের মতো একটি ফরয কাজ আদায় হলো,
২. রমযানের ফযীলত হিসাবে পূণ্যের ক্ষেত্রে একে সত্তর।
যাকাত যাদের ওপর ফরয
যাকাত ফরয হয় প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ্য মস্তিস্ক সম্পন্ন এই স্বাধীন মুসলমানের ওপর যার কাছে প্রয়োজনীয় খরচের পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ন অথবা এই পরিমান সম্পদ পূর্ণ এক বছর মওজুদ আছে। এই সম্পদ থাকাকেই শরীয়তের পরিভাষায় যাকাতের নেসাব বলা হয়। যার কাছে নেসাব পরিমান সম্পদ আছে তাকে সাহেবে নেসাব বলে।
সাহেবে নেসাবের প্রকারভেদ
১. যদি কারো কাছে বছরের শুরুতে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে আর শেষের দিকে থাকে না তবে যাকাত ফরয হবে না।
২. যদি কারো কাছে বছরের শুরুতে এবং শেষে নেসাব পরিমান সম্পদ থাকে আর মধ্যখানে থাকে না তবু যাকাত দিতে হবে।
৩. যদি কারো কাছে র্স্বণ, রৌপ্য এবং ব্যবসার মাল এমন হয় যে, পৃথক থাকেন কোনটাই মালে নেসাব নয়, আর এক করলে মালে নেসাব হয়ে যায় তবে যাকাত ফরয হয়ে যাবে। এখানে হিসাবটা করতে হবে এক করে। (হেদায়াহ)
যাকাতের পরিমাণ
যাকাতের পরিমাণ মালের চল্লিশভাগের একভাগ যাকাত দেয়া ফরয। যদি কেউ মালের হিসাব করে নগদ টাকা দিয়ে যাকাত আদায় করতে চায় তবে তা আদায় হয়ে যাবে। নগদ অর্থের হিসাবটা হবে চল্লিশ টাকায় এক টাকা। একশ টাকায় আড়াই টাকা। এক লাখে আড়াই হাজার টাকা। মাল যে দেশে বা যে অঞ্চলে থাকবে সেখানের হিসাবানুসারে যাকাত দিতে হবে। ইংল্যন্ডে পাউন্ড, আমেরিকায় ডলার এবং সৌদিতে রিয়ালের হিসাবে যাকাত আদায় করতে হবে। হিসাব হবে চল্লিশে এক এবং একশতে আড়াই পাউন্ড/ ডলার/ রিয়াল ইত্যাদি।

যাকাত আদায়ের শর্ত
যাকাত আদায়ের শর্ত যাকাত হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ধনীর মালে গরীবের অধিকার। এই অধিকার আদায়কালে আদায়কারী হক্বদারকে মালের পূর্ণাঙ্গ মালিকত্ব দিয়ে দিতে হবে। কাজের বিনিময় কিংবা অনুগ্রহ আর দয়া-মায়ায় দিলে হবে না। দিতে হবে যাকাতের নিয়্যতে। যিনি যাকাত দিবেন তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস থাকতে হবে আমি যা দিচ্ছি তা আল্লাহ র্কতৃক নির্ধারিত গীরবের হক। যাকে দেয়া হবে সে এই মাল স্বাধীনভাবে খরচের অধিকার পাব। যদি আদায়কারী কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন তবে যাকাত আদায় হবে না। নির্বাচন কিংবা দারাসূলুল্লাহর প্রচারের উদ্দেশে যদি কেউ যাকাত দেন তবে তা আদায় না হয়ে বরং পাপ হবে। যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে যদি সামান্যও আমিত্ব কাজ করে তবে তাতে পাপ অবশ্যই হবে।
যে সকল বস্তু থাকলে যাকাত ফরয হয়
যে সকল বস্তু থাকলে যাকাত ফরয হয় ইসলামি শরীয়তে চার প্রকার বস্তুর ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে ১) স্বর্ণ রৌপ্য, ২) ব্যবসার মাল, ৩) চতুস্পদ জন্তু, ৪) কৃষি উৎপাদনের ওপর। এখানে উল্লখ্য যে, কৃষি উৎপাদনের ওপর যে হিসাব তা যাকাত থেকে একটু ভিন্ন। তাই এটাকে যাকাত না বলে শরীয়তে তাকে ‘ উশর’ বলা হয়। উশরের হিসাব হলো উৎপাদনের দশ ভাগের এক ভাগ।
যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
যাকাত দেয়ার মতো মাল থাকার পরও যাকাত না দিলে এই ব্যক্তি ফাসেক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই রকমের ব্যক্তির প্রতি ইসলাম এবং মুসলমানের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। ইসলামী রাষ্ট্র থাকলে তাদের কে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে এবং রাষ্ট্র ওদের কোন নিরাপত্তা দিতে বাধ্য নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘যদি তারা তাওবাহ করে আর নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে তা’হলে তাদের রাস্তা বন্ধ করবে না, তাদেরকে কষ্ট দেবে না (তাওবাহ)। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে গরীবের হক যাকাত আদায় করে না তার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে তাকে কষ্ট দেয়া বৈধ আছে। এই আয়াত আমাদেরকে শোষক এবং পূঁজিবাদির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিচ্ছে। হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত অনাদায়কারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতে রয়েছে‘ যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের ভাই। (তাওবাহ) অর্থাৎ যারা যাকাত দেয় না তাদের সাথে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যাকাত আর জিজিয়া অনেকে জিজিয়াকে অমুসলিমদের ওপর জুলুম বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে যাকাত আর জিজিয়ার বিধান চিন্তা করলে একই। আমরা জানি যে, যাকাত শুধু মুসলমানদের ওপর ফরয। ইসলামি রাষ্ট্রে যাকাত আদায়কারীর জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিবে রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে যাকাত আদায় করবে রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্রে যাকাত আদায়কারির মালের ওপর অন্য কোন রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স আসবে না। এখন কথা হলো ইসলামি রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম হবে তাদের তো যাকাত-ফিতরা নেই, তা হলে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নেবে না? অবশ্যই নেবে। বিনিময়ে তারা জিজিয়া ট্যাক্স দিবেন। এক্ষেত্রে বিধান হলোÑযদি রাষ্ট্র জিজিয়া ট্যাক্স আদায়কারী কোন নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তবে অবশ্যই তার জিজিয়ার টাকা ফেরত দিতে হবে। জিজিয়া ট্যাক্স নিয়ে অজ্ঞতা বশত: অনেকে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। এই বিষয়টি শরীয়তে এতই স্পষ্ট রয়েছে যে, বিভ্রান্তির কোন সুযাগ নেই। ট্যাক্সের ওপর নাম অমুসলিমদের নিরাপত্তা ট্যাক্স। মুসলমানরা যাকাত দেয়, অমুসলিমরা জিজিয়া দেয় এই হলো ব্যবধান। যাকাতের তাৎপর্য পবিত্র কোরআনে মহান
১.আল্লাহপাকের ঘোষণা হলো ‘যে নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করে অতি নিকটবর্তী আল্লাহ তার ওপর দয়াবান হবেন।’(তাওবাহ)।
২.অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে‘ হে রাসূলুল্লাহ, আপনি তাদের মাল থেকে সদকা আদায় করুন যা দ্বারা তাদেরকে গোনাহ থেকে পবিত্র ও পরিস্কার করা হয়।’(তাওবাহ)
৩. যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য (ধন-মাল) সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না (যাকাত দেয় না) তাদের এক কঠিন পিড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে, অত:পর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দিয়ে দেয়া হবে। (তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে) ইহা তাহাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। অতএব তোমাদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ কর। (তাওবাÑ৫৩)
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলে করীম সল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যে কোন স্বর্ণ ও রৌপ্যর মালিক নিজের মালের হক (যাকাত) আদায় করে না (তার জেনে রাখা উচিৎ) কিয়ামতের দিন সেই স্বর্ণ ও রৌপ্যকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তখতি বানানো হবে তার পর তাকে জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত করা হবে এবং (কবর থেকে উঠার সাথে সাথেই) ঐ ব্যক্তির পার্শদেশ, কপাল ও পিঠ তা দিয়ে দাগানো হবে। যখন ঐ তখতিগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে সংগে সংগেই সেগুলোকে আবার জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তাকে বার বার দাগানো হতে থাকবে সেই দিন যার দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এমনি অবশেষে লোকদের বিচারপর্ব সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং তারা জান্নাত বা জাহান্নাম দেখতে পাবে।
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইন্তেকাল করলেন ও তাঁর পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু খলীফা (নির্বাচিত) হলেন, আর আরবদেশের কিছু লোক ‘কাফির’ হয়ে গেল, তখন হযরত ওমর উবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বললেন: আপনি এই লোকদের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করতে পারেন, অথচ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন: লোকেরা যতক্ষন লা-ইলাহা ইল্লাহু (এক আল্লহ ছড়া আর কোন মা‘বুদ নাই) মেনে না লইবে ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। যদি কেহ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্বীকার করে, তবে তার ধন-সম্পদ ও জানপ্রাণ আমার নিকট পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। অবশ্য ইহার উপর ইসলামের হক কখনো ধার্য হলে অন্য কথা। আর তার হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লহর উপর ন্যাস্ত। তখন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আল্লাহ শপথ যে লোকই নামায ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করবে, তারই বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব। কেননা যাকাত হচ্ছে মালে হক। আল্লাহর শপথ, তারা যদি রাসূলের সময় যাকাত বাদ দিত- এমনকি একগাছি রশিও দেয়া বন্ধ করে, তবে অবশ্যই আমি তা দেয়া বন্ধ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তখন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আল্লাহর শপথ করে বলছি তা আর কিছু নয় আমার মনে হল আল্লাহ যেন আবু বকরের অন্তরে যুদ্ধের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং বুঝতে পারলেন এটাই ঠিক (তিনি নির্ভুলসিদ্ধান্তই করেছেন) (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে আত-তিরমিযী, আন-নাসাঈ, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ)
৩. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহতায়ালা যাকে ধন-মাল দান করেছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে তা হলে কিয়ামতের দিন তার ধন-মাল তার জন্য অধিক বিষধর সাপের আকার ও রূপ ধারণ করবে। তার কপালের উপর দুইটি কালো চিহৃ কিংবা দুইটি দাঁত বা দুইটি শৃঙ্গ থাকবে। কিয়ামতের দিন তা তার গালায় পেচাইয়া দেওয়া হবে। অত:পর তা তার মুখের দুই পাশ, দুই গাল কিংবা দুই কর্নলগ্ন মাংসপিন্ড-এর গোশত খাবে ও বলতে থাকবে: আমিই তোমার মাল-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত বিত্ত-ম্পত্তি। অত:পর রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন: যারা কার্পণ্য করে তাদের সম্পর্কে ধারণা করো না। (সহীহ আল বুখারী ও আন- নাসাঈ)
৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে তিনি রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করছেন, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে লোকই তার ধন-মালের যাকাত আদায় করবে না, তারই মাল-সম্পদ কিয়ামতের দিন বিষধর সর্পের রূপ পরিগ্রহ করবে। শেষ পর্যন্ত সে সর্পটি তার গলায় পেচাইয়া দেওয়া হবে। (ইবনে মাজাহ)
৫. হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে সম্পদের সাথে যাকাতের (সম্পদ ও টাকা পয়সার) সংমিশ্রণ ঘটে তা সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়। (সহীহ আল বুখারী)

সাদকায়ে ফিতরা
ফিতরাকে বলা হয় রোযার যাকাত। যাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে তেমনি ফেতরাও রোযাকে পবিত্র করে, অর্থাৎ রোযা রেখে যে ভুল-ত্রুটি হয় তা ফেতরার মাধ্যমে পূরণ হয়ে কবুলিয়তের কারণ হয়ে যায়।
ফিতরা কাদের ওপর ওয়াজিব
সঙ্গতি সম্পন্ন (যে ব্যক্তি জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরন ব্যতীত যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমান মালের মালিক) রোজাদারের উপর তার নিজের পক্ষ হতে এবং নাবালক পুত্র-কন্যাদরে পক্ষ হতে এবং দাস-দাসীর পক্ষ হতে ঈদের দিন ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে যাদের এমন মাল আছে যে ঘরের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত থাকে তার ওপর ফেতরা ওয়াজিব। ফেতরা দিতে হয় নিজের পক্ষ থেকে এবং পৌষ্যের পক্ষ থেকে।
ফিতরার পরিমাণ
ফিতরার জন্য মালের এক বছর হওয়া জরুরী নয়। ঈদের দিন জামাতের পূর্বে ফেতরা আদায় করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে ফিতরার পরিমাণ হলো গমের অর্ধ ছা’য়া বা এক সের বারো ছটাক। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের পূর্ণ এক ছা’য়া বা তিন সের নয় ছটাক। নাবালগের ফিতরা তার অভিবাবকের পক্ষ থেকে দিতে হয়। যাকাত যাদের দেয়া যায় ফিতরা ও তাদেরকে দেয়া যায়। বিষয়টি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন ‘মুসলমান ক্রীতদাস ও আজাদ, নারী পুরুষ, ছোট বড় সবার ওপর রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদকায়ে ফিতর এক ছা’য়া খেজুর বা যব নির্ধারণ করেছেন। মানুষ ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (মুত্তাফেকুন আলাইহে)।
সাদকায়ে ফেতরা দেওয়ার ফযীলত
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম ফিতরার যাকাত রোযাদারকে বেহুদা অবাঞ্ছনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথা বার্তা বা কাজ কর্মের মলিনতা হতে পবিত্র করার এবং গরীব মিসকিনদের (ঈদের দিনের উত্তম) খাদ্যের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্য আদায় যোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। যে লোক তা ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করবে, তা ওয়াজিব সাদকাত বা সাদকাহ হিসাবে আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে। আর যে লোক তা ঈদের নামাযের পর আদায় করবে, তা সাধারণ দান রুপে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাযা)

নেকী যাতে হাত ছাড়া না হয়
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল¬াহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের মধ্যে সেই ব্যক্তিই প্রকৃত কাংগাল যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাতসহ আল্লাহর দরবারে হাজির হবে, সেই সাথে দুনিয়াতে কাউকে গালি দিয়ে থাকবে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকবে, কাউকে হত্যা করে থাকবে অথবা অন্যায়ভাবে প্রহার করে থাকবে। ফলে এসব মজলুমদের মধ্যে তার সব নেকীগুলো বন্টন করে দেয়া হবে। যদি পাওনা পরিশোধের পূর্বেই তার সব নেকীগুলো শেষ হয়ে যায় তা’হলে তাদের পাপসমূহ তার ভাগে ফেলে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম)।
২. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কিয়ামতের দিন কিছু লোক তামার পাহাড় সমান সৎ কর্ম নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সংগে সংগেই তাকে ধুলিকণার মত বানিয়ে উড়িয়ে দেবেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো হে রাসূল, এটা কিভাবে সম্ভব। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এই লোকগুলো নামায পড়তো, রোযা রাখতো, যাকাত দিত ও হজ্জ করতো। কিন্তু যখনই কোন হারামের সংষ্পর্শে আসতো, অমনি তাতে লিপ্ত হয়ে পড়তো। তাই আল্লাহ তাদের সকল নেক আমল বাতিল করে দিয়েছেন। (তাবরানী)
৩. ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূলুল্লাহু সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বলনে, দুনিয়াতে অপরিচিত অথবা ভ্রমণকারী মুসাফিরের মত হয়ে যাও। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, সন্ধ্যা বেলায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না। আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। অসুস্থতার জন্য সুস্থতাকে কাজে লাগাও, আর মৃত্যুর জন্য জীবিত অবস্থা থেকে (পাথেয়) সংগ্রহ করে নাও। (সহীহ আল বুখারী)
সম্মানিত ভাইসব আখেরাতে নিয়ে যাওয়া কোন নেকী যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যায় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। আল্ল¬াহর হুকুম মেনে চললে হয় নেকী, আর আল্ল¬াহর হুকুম লংঘন করলে হয় গুনাহ। প্রতিটি মানুষের জীবনে গুনাহ থাকা স্বাভাবিক। তবে অনুশোচনাসহ তাওবা করে গুনাহ মাফ করে নিতে হয়। কিন্তু কিছু গুনাহ এমন আছে যা দুনিয়াতে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তির সাথে জড়িত। দুনিয়াতে জীবিত থাকতেই সমাধা করে যেতে হবে। নইলে আখেরাতে নেকী কাটা পড়বে এবং অন্যের গুনাহ যোগ হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। এ যেন সেই ব্যক্তির মত যে বহু কষ্ট করে কলসী ভর্তি পানি মাথায় বহন করে বাড়ীতে নিয়ে গেল। কিন্তু বাড়ীতে নিয়ে কলসী ছিদ্র করে দিল। ফলে তার জমানো পানি সব ছিদ্র দিড়ে বেরিয়ে গেল।

You may also like