যিকির অন্তরের মরিচা পরিষ্কার করে পর্ব-১
মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী
সূচীপত্র
১ যিকির
যিকিরের দাবী
আকিদাগত শিরক
২ যিকিরের প্রকারভেদ
৩ যিকিরে কালবী/ মনের যিকির
৫ যিকরে লিসানী বা মৌখিক যিকির
৬ যিকিরে আমলী বা বাস্তব যিকির
যিকির
যিকিরের শাব্দিক অর্থ হলো কোন কিছু স্মরণ করা, আবার বর্ণনা করাও হয়। যিকির শব্দের অর্থ যেহেতু স্মরণ করা, উচ্চারণ করা নয় তাই আল্লাহর যিকির ঠিকভাবে করতে হলে তাসবিহ, তাহমিদ, তাকবির ও তাহলীল যে কোন একটি বাক্যের দ্বারা মনে মনে উচ্চারণ করতে হবে। যিকির শুধু তাসবিহ, তাহমিদ, তাকবির ও তাহলীল বা ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ উচ্চারণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহপাকের প্রতিটি আদেশের বাস্তবায়নই তাঁর যিকির। যিকির যেমন : আল্লাহকে স্মরণ করা বুঝায় তেমনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করাকেও বুঝায়। মোট কথা কুরআন হাদীস ও ইসলামী শরীয়ার যে কোন বিষয় সর্ম্পকে আলোচনা আল্লাহর যিকির বা আল্লাহর স্মরণের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “হে আল্লাহ আপনার যিকিরের দ্বারা আমাদের ক্বলবের তালা গুলো খুলে দিন।” কোন কিছু মনে রাখা বা মনে করাকে আমরা মনের যিকির বলতে পারি আর কোন কিছু মুখে আলোচনা করাকে আমরা মুখের যিকির বলতে পারি। আর এগুলি অনুধাবন করা ও হৃদয়ে প্রতিফলন ঘটানো হল অন্তরের যিকির। আল্লাহর যিকির আল-কুরআনের এক বিশেষ পরিভাষা। কুরআন এটাকে নিজ¯^ একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করছে। আলকুরআনের যে সব আয়াতে যিকির কথাটির উল্লেখ আছে সেগুলোর দিকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে দৃষ্টি দিলে সেই বিশেষ অর্থ আমরা সহজেই উপলিব্দ করতে পারি। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, কোরআন তিলাওয়াত, সুন্নতের ওপর আমল ও ওয়াজ-নছিহত সবগুলোই যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে আল্লাহর যিকির অধিক পরিমাণে করার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানের নির্দেশ কোরআন পাকে এতো বেশি বর্ণিত হয়নি। প্রথমত : এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহর যিকির যাবতীয় এবাদতের প্রকৃত রূহ। তাই আল্লাহপাক বার বার উল্লেখ করে বান্দাকে তার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। দ্বিতীয়ত : যাবতীয় এবাদতের মধ্যে যিকিরই সহজতর। এটি আদায়ের ব্যাপারে শরীয়ত কোনো শর্ত আরোপ করেনি। ওযুসহ বা বিনা ওযুতে, উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সব সময় আল্লাহর যিকির করা যায়, এর জন্যে মানুষের কোনো পরিশ্রমই করতে হয় না। কিন্তু এর প্রতিদান এতো বেশি যে, আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে পার্থিব কাজকর্ম এবাদতে রূপান্তরিত হয়। হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.) এর মতে মুমিনের এক মুহুর্তের জন্য আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরুপ হওয়া বেআদবীর শামিল।”
মরুভূমিতে এক মেষপালকের নিকট এসে এক নিঃসঙ্গ-পথিক আবেদন করলেন, ‘আমি ক্ষুধার্ত, খাবার বলতে আমার কাছে কিছু নেই; আমি-কি তোমার একটি মেষ থেকে কিছু দুগ্ধ দোহন করে নিতে পারি’? মেষপালক বললো, ‘আমি-তো এই মেষের মালিক নই; সুতরাং মালিকের অনুমতি ছাড়া কাউকে দুধ দোহন করতে দিতে পারি না। মালিক নিশ্চয়ই জানতে পারবে এবং সে এটা পছন্দ করবে না’। আসলে পথিকের মনে ছিল অন্য খেয়াল। তিনি বললেন, ‘তুমি বরং আমার কাছে একটি মেষ বিক্রয় করে দাও। মালিক যখন জানতে চাইবে, তুমি বলবে যে, একটি নেকড়ে বাঘ এসে মেষটিকে ধরে নিয়ে গেছে। নেকড়েরা-তো পশুপালগুলোতে প্রায়-সময়ই হানা দেয়। আমিও আমার ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবো, আর তুমিও টাকা পাবে, আমাদের দু’জনেরই লাভ হবে’। মেষপালক অত্যন্ত জোরালোভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘কিন্তু আল্লাহর ব্যাপারে কী-হবে’? অসাধারণ! এই কথা শুনে পথিক-ব্যক্তিটি আনন্দিত হয়ে বলল, ‘যতদিন পর্যন্ত উম্মাহর মধ্যে তোমার মতো মানুষ থাকবে, নেকড়েরা কখনও কোনো মেষকে আক্রমণ করবে না’। মেষপালকের এটা আদৌ জানা ছিল-না যে, সে যার সঙ্গে কথা বলছে, তিনি আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি মানুষের হৃৎস্পন্দন অনুভব করার জন্য সর্বদা সক্রিয় থাকতেন। আসলে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ হল একজন মুমিনের ¯^তঃস্ফূর্ত ও ¯^াভাবিক প্রতিক্রিয়া এবং একজন মুমিনের নিকট থেকে এই রকম মন্তব্যই ¯^াভাবিক; কারণ সে জানে, আল্লাহকে স্মরণ করার কী মূল্য! আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সর্বত্রই নেকড়েরা কেমন অবাধে মেষগুলোকে হত্যা করে চলেছে। কারো অজানা নয়, মুসলিম-বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই দুর্নীতি আজ একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু কেন? কারণ হল, আল্লাহকে স্মরণ রাখার মধ্যেই-যে পাপ ও দুর্নীতির প্রতিরোধ নিহিত, এই সহজ কথাটি আমরা অধিকাংশ মানুষ আজ বিস্মৃত হয়েছি। আমাদের ইহজীবনের এই সফর সম্পর্কে কুরআন বলছে, এটা একটা ক্রমাগত পরিশ্রমের সফর, যার শেষে আমরা আমাদের মহান ¯্রষ্টার সাক্ষাতলাভে ধন্য হব। ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ এগুলি আল্লাহর যিকির-এর কিছু প্রচলিত ধরন। এগুলি উচ্চারণ করা মৌখিক যিকির; আর এগুলি অনুধাবন করা ও হৃদয়ে প্রতিফলন ঘটানো হল অন্তরের যিকির। এই দুটি ধরনই বিশেষভাবে মূল্যবান ও বাঞ্ছনীয়; এবং তারা একটি অপরটির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে। মৌখিকভাবে পুন:পুন: উচ্চারণের কারণে শব্দগুলি হৃদয়পটে গভীরভাবে খোদিত হয়, অপরদিকে আন্তরিক উপলব্ধি ও অনুভূতির প্রতিফলন মৌখিক উচ্চারণকে জীবন্ত ও প্রাণময় করে তোলে এবং উভয়ে একসঙ্গে একীভূত হয়ে এই ইহজীবনের সফরকে এমনভাবে তাৎপর্যমন্ডিত করে তোলে, যা আমাদের দৃষ্টিকে প্রকৃত গন্তব্যের প্রতি তন্ময় ও সজাগ রাখতে সাহায্য করে। এই যিকির আল্লাহ পাকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে গভীর ও শক্তিশালী ও অবিচ্ছেদ্য করে তোলে; এবং ফলত, প্রবৃত্তির সকল অসৎ-অনুচিত আকর্ষণ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ হয়ে আমরা আমাদের হৃদয়ে নিবিড় প্রশান্তি অর্জন করতে পারি; এবং আমরা আশা করতে পারি, যে-ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহ পাকের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে, সময় যখন আসবে, সে বঞ্চিত হবে না। একজন নিরক্ষর মেষপালক সঠিক উপলব্ধির মানদন্ডে একজন বিরাট-মাপের মানুষ; এবং পার্থিব-দৃষ্টিতে অনেক ‘বড়-বড়’ মানুষ যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল, আলোচ্য শিক্ষাদীক্ষাহীন এই মেষপালকের তুলনায় তারা কতই-না ক্ষুদ্র! অবশ্য বিষয়টি আমরা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারি।
যিকিরের দাবী
ক্স যিকরুল্লাহর প্রথম দাবী হলো-ঈমানদারের মনে আল্লাহর জাত, ছিফাত, হুকুম-আহকাম সর্ম্পকে সঠিক ধারণা গভীরভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
ক্স জিকরুল্লাহর দ্বিতীয় দাবী হলো-আল্লাহর জাত, ছিফাত, হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত যে সঠিক ধারণা তার মনে ও মগজে প্রতিষ্ঠিত আছে তাকে আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য মুখে আলোচনা করবে। অপরকেও এধারণা দানের জন্য এ ব্যাপারে আলোচনা করবে।
ক্স যিকরুল্লাহর তৃতীয় দাবী হলো-মন মগজের প্রতিষ্ঠিত এই ধারণার আলোকে তার আমলী জিন্দেগীকে পরিচালনা করবে।
আকিদাগত শিরক
আকিদাগত শিরক অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহ সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা।
আকিদাগত শিরক ৪ (চার প্রকার) ঃ
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলি
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার
তাওহীদকে বুঝতে হলে শিরককে বুঝতে হবে। শিরকের বিপরীতই তাওহীদ। ঈমান শিরকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাওহীদের দাবী পূরণ হতে পারে না।
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তার উদাহরণ : আল্লাহ সত্তাকে শরীক করা যেমন কাউকে আল্লাহ পুত্র, স্ত্রী মনে করা। ফেরেশতা, দেব-দেবী ইত্যাদিকে আল্লাহ বংশধর বলে বিশ্বাস করা।
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলির উদাহরণ : যে সব গুন একান্তই আল্লাহ সে সবগুন কারোর মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া কাউকে সকল রকম দুর্বলতা ও দোষক্রটি থেকে পাক মনে করা। যেমন-গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য সর্ম্পকে জ্ঞান। কারো সর্ম্পকে এমন ধারণা করা যে, তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্রæটি থেকে মুক্ত।
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতার উদারহণ : আলৌকিকভাবে উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা, প্রয়োজন পূরণ ও হেফাযত করার যোগ্যতা, মানুষের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গা, দোয়া করা, মানব জীবনের জন্য আইন কানুন রচনা করা, সন্তান দান করা, রোগ ভাল করা, গুনাহ মাফ করা, হায়াত ও মওত দেয়া, রিযক দান করা ইত্যদি।
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকারের উদাহরণ : কাউকে রুকু, সিজদা ও পূঁজা পাওয়ার অধিকারী বা হাত বেঁধে নত হয়ে দাড়িয়ে ভক্তি করার পাত্র মনে করা, কারো আস্তানাকে চুমু দেয়ার যোগ্য মনে করা, কুরবানী করা, নযর, নিয়ত, মানত পেশ করার যোগ্য মনে করা। নিয়ামতের শুকরিয়া পাওয়ার অধিকারী বা আপদে বিপদে সাহায্যের জন্য আবেদন গ্রহনের যোগ্য, সব অবস্থায় যাকে ভয় করা যায় বা যার জন্য আর সব মহŸত ত্যাগ করা যায় বলে মনে করা।
যিকিরের প্রকারভেদ
যিকির হলো তিন প্রকার। যথা-
১। যিকিরে কালবী বা মনের যিকির
২। যিকিরে লিসানী বা মৌখিক যিকির
৩। যিকিরে আমলী বা বাস্তব যিকির
১. যিকিরে কালবী/ মনের যিকির : ঈমানে মুযমালে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ঘোষণা দিতে গিয়ে আমরা যে ভাবে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এবং তার হুকুম আহকাম মেনে নেবার অঙ্গীকার করে থাকি, মূলত: এটা আল্লাহর সাথে কৃত একটি ওয়াদা। মনে মগজে সব সময়ের জন্য এই ওয়াদা বা অঙ্গীকারের কথা স্মরণ রাখার নাম যিকিরে কালবী বা মনের যিকির।
২. যিকরে লিসানী বা মৌখিক যিকির : উক্ত বিষয় তিনটি মনে গেঁথে রাখার প্রয়োজনে অথবা আল্লাহর আরো বান্দাদের শিখাবার প্রয়োজনে এগুলো মুখে উচ্চারণ করতে হয়, আলাপ আলোচনা করতে হয়, অনুশীলন করতে হয়। এটাকেই আমরা মৌখিক যিকির বা জিকলে লিসানী নামে অভিহিত করব।
৩. যিকিরে আমলী বা বাস্তব যিকির : উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো নিষ্ঠার সাথে যদি কেউ মনে বদ্ধমূল করে নেয় এবং নিষ্টার সাথে মুখে এ বিষয়ে আলোচনা করে তাহলে তার বাস্তব জীবন এর বিপরীত পথে চলতে পারে না। শুধু তাই নয় বরং ইতিবাচক ভাবে অন্তরের বিশ্বাসের প্রকাশ প্রতিনিধিত্ব যেমন মুখের কথায় হবে তেমনি বাস্তব জীবনের যাবতীয় কার্যক্রম লেনদেন, আমল আখলাকের মাধ্যমেই তার বহি:প্রকাশ ঘটবে। এটাকেই আমরা বাস্তব যিকির বা যিকিরে আমলী নামে অভিহিত করতে পারি।