Home ইসলাম সফরে থাকা অবস্থায় নামাযের রাকা’আত সংখ্যা

সফরে থাকা অবস্থায় নামাযের রাকা’আত সংখ্যা

by admin
0 comment

সফরে থাকা অবস্থায় নামাযের রাকাআত সংখ্যা

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

সফরের সময় ৪ রাকা’আত ফরয (যোহর+আসর+এশা) নামায ২ রাকা’আত পড়তে হয়, কিন্তু ২/৩ রাকা’আত ফরয নামায ২/৩ রাকা’আতই পড়তে হয়। একে নামায “কসর” বা সংক্ষিপ্ত করা বলা হয়।
১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরে রওয়ানা করতেন, তখন সফর শেষে মদীনায় ফিরে আসা পর্যন্ত চার রাকা’আতের নামায সমূহ কসর (হ্রাস) করে দুই রাকা’আত পড়তেন। সফরে তিনি চার রাকা’আত পুরো পড়েছেন বলে প্রমাণ নেই।
২.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন-তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের রাসূলের ভাষায় নিজ বাসস্থানে চার রাকা’আত, সফরে দুই রাকা’আত এবং ভয়ের সময় এক রাকা’আত (অর্থাৎ জামায়াতের সাথে এক রাকা’আত) নামায ফরয করেছেন। (সহীস মুসলিম, সুনানে নাসাঈ, তাবরানী)
৩. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয় থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেছেন : রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে দুই রাকা’আত নামায পড়ার নিয়ম প্রবর্তন করেছেন। এই দুই রাকা’আত মূলত পূর্ণ নামায, হ্রাসকৃত নয় (বরং আবাসের নামায দুই রাকা’আত বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বিতির নামাযও পড়তেন। (ইবনে মাজাহ)
৪.ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অনেক যুদ্ধে শরীক হয়েছি। মক্কা বিজয়কালও আমি তাঁর সাথে ছিলাম। এ সময় তিনি মক্কায় আঠার রাত অবস্থান করেন, এ সময় তিনি নামায দুই রাকা’আত করে পড়েছেন। (আবু দাউদ)
৫.আল্লাহতায়ালা প্রথমত, প্রতি ওয়াক্ত নামাযই দুই রাকা’আত করে ফরয করেছেন। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন আবাসে নামাযের রাকা’আত সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। আর প্রবাসের (সফরের) নামায পূর্ববৎ বহাল রাখা হয়।
৬.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মুআয্যামার দিকে গিয়েছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক ফরয নামায দুই রাকা’আত করে পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, সহীহ আল বুখারী, আবু দাঊদ, তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
৭.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে রিওয়ায়াত করেন-তিনি বলেন, আমি মিনায় রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার পিছে প্রত্যেক ফরয নামায দুই রাকআত করে পড়েছি। হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এর খিলাফাতের প্রাথমিক সময়েও অনুরূপ পড়েছি। পরবর্তী সময়ে হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পূর্ণ পড়া শুরু করেছেন। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈ)
৮.হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে রিওয়ায়াত করেন-তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে দুই রাকা’আতই ফরয করেছেন, যেমন নিজ বাসস্থানে চার রাকা’আত ফরয করেছেন।” (তাবরানী)
৯.হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে রিওয়ায়াত করেন- তিনি বলেন, সফরের নামায দুই রাকা’আত, চাশতের নামায দুই রাকা’আত, ঈদুল ফিতরের নামায দুই রাকা’আত, জুমুআর নামায দুই রাকা’আত। এ দুই রাকা’আত হলো পরিপূর্ণ অসম্পূর্ণ নয়। আর তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতৃভাষাতেই। (সুনানে নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হাব্বান)
১০.সাইয়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিায়াল্লাহু আনহু থেকে রিওয়ায়াত করেন-ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছে দুই রাকা’আত নামায পড়েছি এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক ও হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পিছেও দুই রাকা’আত পড়েছি। পরবর্তীতে বিভিন্ন পন্থা তোমাদেরকে পৃথক করে দিয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার আশা হলো চার রাকা’আতের পরিবর্তে কবূলকৃত দুই রাকা’আত পাওয়া।
১১.উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (আমার খালা) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: নামায দুই রাকা’আত করেই ফরয হয়। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরত করার পর চার রাকা’আত ফরয করা হয়, তবে সফরের নামায আগের মতোই দুই রাকা’আত ফরয থাকে। ইমাম যোহরী বলেন, আমি উরওয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম: তবে আপনার খালা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন সফরে চার রাকা’আত পড়তেন? জবাবে উরওয়া বলেন: এ ব্যাপারে তাঁর একটি ব্যাখ্যা ছিল, যেমন হযরত ওসমানের একটি ব্যাখ্যা ছিল। (সহীহ আল বুখারি ও সহীহ মুসলিম) ব্যাখ্যা দুইটি নিম্মরূপ-
ক) হযরত আয়েশার ব্যাখ্যা ছিল এই যে, তিনি মনে করতেন, সফরে ভয় ও সন্ত্রাসের সম্মুখীন হলেই নামায কসর করতে হবে, নতুবা নয়।
খ) হযরত উসমান একবার হজ্জের সময় মিনায় চার রাকা’আত নামায পড়েন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন : আমি এখানে এসে বিয়ে করেছি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন কেউ সফরে গিয়ে কোথাও বিয়ে করলে, সে সেখানে মুকীম হয়ে যাবে এবং পূর্ণ নামায পড়বে।
এখানে উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকটি হাদীস পেশ করা হয়েছে। নচেৎ এ সম্পর্কে আসংখ্য হাদীস রয়েছে। উক্ত রিওয়ায়াতগুলো থেকে বুঝা যায় সফরে কসরই ফরয। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফা-ই-রাশিদীন কসরই পড়েছেন, সাহাবায়ে কিরাম চার রাকা’আত পড়তে নিষেধ করেছেন কিংবা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বিবেকের চাওয়াও এটা যে সফরে কসর ফরয। মুসাফিরকে কসর ও সম্পূর্ণকরণ উভয়ের স্বধীনতা দেয়া শরয়ী জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধী। কারণ সফরে প্রত্যেক চার রাকা’আত বিশিষ্ট নামাযে প্রথম দুই রাকা’আত সকলের ঐক্যমতে ফরয। এখন শেষ দুই রাকা’আত সম্পর্কে প্রশ্ন হলো তাও মুসাফিরের উপর ফরয কি না? যদি ফরয হয় তাহলে তা না পড়ার সুযোগ কি ভাবে থাকবে? ফরযের ক্ষেত্রে কোন স্বাধীনতা নেই। ফরয ও ইচ্ছাধীনতা একত্রিত হতে পারে না। আর যদি ফরয না হয়ে নফল হয়, তাহলে একই তাকবীরে তাহরীমায় ফরয ও নফল নামায আদায় শরীআতের নিয়মবিরুদ্ধ, যার উদাহরণ কোথাও পাওয়া যাবে না। ফরয ও নফলের তাকবীরে তাহরীমা ভিন্ন ভিন্ন। একটি তাকবীরে তাহরীমায় এক ধরণের নামাযই হতে পারে দুইরকম নয়।
যে ভাবেই হোক, দুই রাকা’আত কিংবা চার রাকা’আত পড়ার স্বাধীনতা শরয়ী জ্ঞানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মোট কথা যে ভাবে নিজ বাসস্থানে চার রাকা’আতই ফরয, হ্রাস-বৃদ্ধির স্বাধীনতা নেই তদ্রুপ সফরে কেবল মাত্র দুই রাকা’আতই পড়া আবশ্যক কোন রূপ এখতিয়ার ছাড়াই।
ফরয নামাযের আগে পরে যেসব নফল পড়া হয়েছে সেগুলো ছিলো সাধারণ নফল, ফরয নামাযের সাথে সম্পর্কিত নয়। কারণ মুসাফিরর সুবিধার জন্যে যে ফরয নামাযই হ্রাস করে দুই রাকা’আত করা হয়েছে, সেখানে ফরযের আগে পরে সুন্নাত নামাযের রীতি চালু রাখার তো কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এমনটি হলে তো ফরয নামায পূর্ণ করাই উত্তম ছিলো। এজন্যেই আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন : সফরে ফরযের আগে পরে সুন্নাত নামায পড়ার দরকার হলে তার চাইতে ফরয নামাযই (কসর না করে) পূর্ণ করতাম।
শরীআতের মাসআলা হলো, মুসাফিরের উপর চার রাকা’আত বিশিষ্ট ফরয নামাযে, কসর ফরয। মুসাফির উক্ত নামায সম্পূর্ণ পড়তে পারবে না। যদি ভুলে দুই রাকা’আতের পরিবর্তে চার রাকা’আত পড়ে নেয় তার হুকুম হবে ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে ফজরের ফরয চার রাকা’আত পড়েছে। অর্থাৎ যদি সে প্রথম তাশাহহুদ পাঠ করে তৃতীয় রাকাআতে দাড়িয়ে যায়, তা হলে সে সাহু সিজদা দিবে। নচেৎ নামায পুনরায় আদায় করবে। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে দুই রাকা’আতের স্থলে চার রাকা’আত পড়ে তাহলে নামায আদায় হবে না। কেউ যদি মনে করে সফরে নামায কসর করবেনা পুরা পড়লে বেশী সওয়াব হবে, তাহলে তার নামাযই হবেনা। কারন এটা আল্লাহর হুকুম।

 

You may also like