Home গল্প বিনি সুতোয় বাধা

বিনি সুতোয় বাধা

by Jafor Salah
0 comment

বিয়ে বাড়িতে চাপা গুঞ্জন চলছে।
*ছিঃ ছিঃ ছিঃ! দেশটা রসাতলে গেল! দুনিয়ায় কি পাত্র/পাত্রীর অভাব ছিল!
*এমন বিয়ে আমি জীবনেও দেখিনি!
*এরা কেমন মানুষ! কোন কমনসেন্স নেই! কিসের সাথে কি!
*এরা নাকি আবার ধার্মিক! সব লোক দেখানো ভণ্ডামি, যত্তসব!
*শুনলাম মেয়েও নাকি পর্দানশীন?
*আরে হ্যা, ছেলেও তো হুজুর।
*ওহ্, তাই বলো।হুজুরদের নজর সবসময়ই খারাপ থাকে। মুখে আল্লাহ আল্লাহ, আর ভেতরে……..
*ঐ মেয়েগুলোও বটে! পর্দার আড়ালে যতসব আকাম-কুকাম করে বেড়ায়!
নারী-পুরুষ উভয় মহলেই এ ধরনের আলোচনা চলছে। কারো মতেই এ বিয়েটা ঠিক হচ্ছেনা।
পাত্রী পক্ষের কেউ কেউ এসব আলোচনা শুনলেও আমলে নিচ্ছে না।তারা তাদের মতো ব্যস্ত।
এত উচ্চশিক্ষিত, স্মার্ট, সরকারি চাকুরীজীবি ছেড়ে কেন তারা একজন সামান্য ব্যবসায়ী, আনস্মার্ট, দাড়িওয়ালা ক্ষ্যাত ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, সেটাই ভেবে পায়না লোকজন!
কেউ কেউ এই বিয়েটাকে “মরা বিয়ে ” বলেও আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, এতে এতে প্রচলিত কোনও আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়নি।সম্পূর্ণ ইসলামিক রীতি অনুযায়ী এ বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে।
বিবাহ অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহঃ-
১.প্রচলিত নিয়মে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হারাম।
২.নববধূকে সাজিয়ে মূল ফটকের সামনে বসিয়ে রাখা হারাম।
৩.গান-বাজনার আয়োজন করা হারাম।
৪.নাম-খ্যাতির উদ্দেশ্যে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হারাম।
৫.নারী-পুরুষের জন্য পর্দাহীনভাবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হারাম।
৬.মেয়ের অভিভাবকের নিকট বরযাত্রী খাওয়ানোর শর্ত করা হারাম।
৭.বিবাহ অনুষ্ঠানে গেটে টাকা ধরা হারাম।
৮.যেকোন ধরনের অপচয় করা হারাম।
৯.পটকা, বাজি কিংবা মানুষের কষ্ট হয় এমন যেকোন জিনিস হারাম।
১০.বিবাহ পড়ানোর পর দাঁড়িয়ে সালাম করা কুসংস্কার।
১১.বিবাহের পর নানী-দাদী ইত্যাদির পায়ে সালাম করা কুসংস্কার।
এইসব বিষয় ইউসুফ-আফিয়ার বিয়েতে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে বিয়ে পড়াতে এলো কাজী সাহেব। ইউসুফ-আফিয়ার বিয়েতে ৫০হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করা হলো।
উপস্থিত নিকটাত্মীয়, যারা এতক্ষণ ফিসফাস করছিল, এবার তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো।
এসব কি মশকরা হচ্ছে? এ যুগের একটা বিয়েতে মাত্র ৫০হাজার টাকা দেনমোহর!
এবার মুখ খুললেন পাত্রীর চাচা- বিয়েটা নিয়ে আপনাদের অনেক আপত্তি, তাইনা?
তবে শুনুন, ইসলাম যেভাবে বলেছে আমার ভাতিঝির বিয়েটা ঠিক সেভাবেই হচ্ছে।
আপনাদের প্রথম সমস্যা ছিল ওদের সম্পর্ক নিয়ে।
*ইসলামের দৃষ্টিতে চাচাতো, মামাতো, খালাতো ও ফুফাতো ভাই-বোনের মেয়েকে বিবাহ করা জায়েজ। শুধুমাত্র আপন ভাই-বোনের মেয়েকে বিবাহ করা হারাম।(মা’আরেফুল কুরআন-৭/১৫৬, শামী-৪/৯৯, দারুলউলুম-৭/২২০, জাওয়াহিরুল ফিকহ-১/২৮)
*তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে তোমাদের মাতা, কন্যা, ভগিনী, ফুপু, খালা, ভাতুষ্পুত্রী, ভাগিনেয়ী, দুগ্ধ-মাতা, দুগ্ধ-ভগিনী, শাশুড়ি ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের সাথে সহবাস হয়েছে তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তবে যদি কন্যাদের মাতার সাথে সহবাস না হয়ে থাকে তবে তাতে তোমাদের (বৈধভাবে সংগত হওয়া) কোন দোষ নেই।
এবং তোমাদের জন্য তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দুই ভগিনীকে একসঙ্গে বিবাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সুরা নিসা-২৩
ইউসুফ-আফিয়া দূরসম্পর্কের চাচা-ভাতিজি।সুতরাং তাদের বিয়েতে শরয়ী কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।
আশা করি এই নিয়ে আর কারও কোন মন্তব্য নেই।
আপনাদের দ্বিতীয় সমস্যা হলো দেনমোহর নিয়ে। তবে শুনুন, দেনমোহর নিয়ে আমাদের সমাজে যা হয়ে থাকে সেটা শরীয়ত সম্মত নয়। দেনমোহর ঠিক ততটুকু হবে যেটা দেওয়ার সামর্থ্য পাত্রের আছে।
আজকাল আমাদের সমাজে কাগজে-কলমে দেনমোহরের একটা অংক লেখা হয় কিন্তু পরিশোধ করা হয় না। অথচ দেনমোহর স্ত্রীর হক, এটা আদায় করা বাঞ্ছনীয়। আশা করি আপনাদের আর কোন মন্তব্য নেই।
চোখের জলে আফিয়াকে বিদায় জানায় তার পরিবার পরিজন। নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে।
শ্বশুর বাড়ি এসে হোঁচট খায় আফিয়া।তার শাশুড়ি, জাসহ অন্যান্য আত্মীয় তাকে বরণ করার জন্য ডালায় ধান, দূর্বাসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে এসেছ।
ইউসুফ তার মাকে একপাশে টেনে নিয়ে যায়- মা, এসব কি!
কেন, তুই জানিস না? নতুন বৌকে এভাবেই বরণ করতে হয়।
মা,এসব ভ্রান্ত ধারণা। এগুলোর কোন ভিত্তি নেই।
ইউসুফের দাদাও এগিয়ে গেলেন- কি হয়েছে?
দেখেন তো আব্বা, ওবলে এগুলো নাকি ঠিক না।এত বছর পর ওর থেকে আমাক ঠিক বেঠিক শিখতে হবে!
বৌমা, তুমি মানো আর না মানো এগুলো সম্পূর্ণ অনৈসলামিক কাজ। বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন তিনি।
অন্যরা এসে তাড়া দিলো- কি হলো? বউ কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?
আমি জানিনা বলে বরণ ডালটা ছুড়ে ফেলে ঘরে চলে গেলেন তিনি।
উপস্থিত আরো অনেকে তাকে অনুসরণ করলো।
এমনিতেই এই বিয়েতে তার মত ছিলনা। ইউসুফের বাবাও প্রথমে আপত্তি করেছিলেন কিন্তু নিজের বাবার ওপর কথা কখনোই কথা বলতে পারেননা তিনি।
মূলত ইউসুফের দাদার ইচ্ছেতেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝতে পারেনি আফিয়া।শুধু কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
সে তার হবু শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতোনা। শুধু তার স্বামী দ্বীনদার এটাই জানতো।বিয়ের আগে মাত্র একবারই ইউসুফের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে।
সুন্নতী লেবাস পরিহিত এক যুবকের সামনে তাকে বসানো হয়েছিল। এক পলক দেখেছিল তাকে। দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হয়নি আফিয়ার।এমনিতেই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল!
ইউসুফের ছোটবোন সুমাইয়া এসে আফিয়াকে ভেতরে নিয়ে যায়।
বাসরঘরে বসে আছে আফিয়া।ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে যায় আফিয়ায়।দরজা খোলার আওয়াজে নড়েচড়ে বসে সে।
আসসালামু আলাইকুম (ইউসুফ)
ওয়ালাইকুমুস সালাম (মৃদুস্বরে বললো আফিয়া)
এই প্রথম কোন পুরুষ মানুষ তার এত কাছে। লজ্জায়, সংকোচে কথা বলতে পারছেনা সে।
ইউসুফও কোনদিন কোন গায়ের মাহরাম নারীর দিকে তাকায় নি, তাই তার কাছে মনে হচ্ছে আফিয়াই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী!
কেমন আছো আফিয়া?(সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো ইউসুফ)
আলহামদুলিল্লাহ ভালো (ক্ষীণস্বরে)
আমি কেমন আছি জানতে চাইবেনা?
আফিয়া নিরুত্তর।
তুমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলে, যাও ওজু করে এসো।
আফিয়া ওজু করে এলো।
তারপর দুজন একসাথে শুকরানা দুই রাকা’ত নামাজ আদায় করলো।অতঃপর ইউসুফ আফিয়ার কপালের (উপরিভাগের) চুল ধরে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করলো-
আল্লাহুমা ইন্নী আসআলুকা খইরাহা ওয়া খইরা মা-জাবালতাহা আলাইহি ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা ওয়া মিন শাররি মা-জাবালতাহা আলাইহি।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি তোমার নিকট এর(নববধূর) কল্যাণ এবং যে প্রকৃতির উপর তুমি একে সৃষ্টি করেছ তার কল্যাণ প্রার্থনা করছি।আর তোমার নিকট এর(নববধূর) অকল্যাণ এবং যে প্রকৃতির উপর একে সৃষ্টি করেছ তার অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আফিয়া এখনও কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। তার পাশে বসে তার হাতে ৫০০টাকার একটা বান্ডিল তুলে দিল ইউসুফ।
অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালো আফিয়া- কিসের টাকা?
তোমার মোহরের টাকা।
এগুলো আমাকে দিচ্ছেন কেন?
বারে, এটা তোমার হক।তোমার প্রাপ্য তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। নাও, এগুলো তুলে রাখো।
আফিয়া, তুমি দৌঁড়াতে পারো?
নাতো! কেন?
সমস্যা নেই, আমি তোমাকে কাঁধে নিয়ে দৌঁড়াবো।
কেন?
রাসূল(সাঃ) আয়েশা রাযি. এর সাথে দৌঁড় প্রতিযোগিতা করতেন। এখন তুমি যদি দৌঁড়াতে না পারো, তাহলে আমার তো………..
এবার মৃদুশব্দে হেসে উঠলো আফিয়া।
মাশাআল্লাহ! তোমার হাসিটা তো খুব সুন্দর!
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো আফিয়ার মুখটা।
ওহ্, শোন আগামী পরশু কিন্তু আমাদের ওলীমা।ওলীমা করা সুন্নাত, জানতো?
জ্বি।
আনাস ইবনে মালিক রাযি. বর্ণিত। নবী করিম (সাঃ) আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি. এর কাপড়ে হলুদের রং দেখে বললেন, এ কী? তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি খেজুরের আঁটি পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে এক মহিলাকে বিবাহ করেছি। তিনি বললেন-
আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন, তুমি ওলীমা করো, যদিও একটি বকরী দ্বারা হয়।
জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো প্রবেশ করেছে। ঘরটা মৃদু আলোয় ভরে উঠেছে। চাঁদনী রাত, পূর্ণিমা শশী ইউসুফের খুব পছন্দ।
জানালা দিয়ে ঝলমলে আকাশটা দেখলো সে।তারপর এগিয়ে গেল তার নব পরিণীতার দিকে।
আফিয়ার হাতদুটো ধরে বললো- জানো আফিয়া, আজকে না দুটো চাঁদ। একটা আকাশে আরেকটা আমার সামনে!
আবারও লজ্জায় লাল হয়ে গেল আফিয়া। ইউসুফ তার থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরলো-
চলো, হাটঁতে বের হই।
এখন? এত রাতে!
কেন? কোন সমস্যা? ভূত-টুতে ভয় পাও নাকি তুমি?
নাহ!
তাহলে?
কেউ যদি জানতে পারে কি ভাববে বলুন তো!
কেউ জানবে না।আমরা পিছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি যাবো আবার ফিরে আসবো।
নিরব, নিস্তব্ধ রজনীতে পাশাপাশি হাঁটছে ইউসুফ-আফিয়া।সাথে চলছে গল্পের ঝুড়ি। চলতে চলতে কখন যে একে অন্যের হাত উষ্ণতায় জড়িয়ে নিয়েছে বুঝতেই পারেনি তারা।
পৃথিবীর সকল মুসলিম নর-নারীর বিয়ে হোক মাসনুন বিবাহ। দাম্পত্য জীবন মধুময় হয়ে উঠুক প্রিয় নবীজী (সঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহ সকলকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।
বিনি সুতোয় বাধা
নূরজাহান তানিয়া

You may also like