Home ইসলাম পবিত্রতায় অযুর ভুমিকা

পবিত্রতায় অযুর ভুমিকা

by admin
0 comment

অযু

পবিত্রতায় অযুর ভুমিকা

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

হাদাসে ‘আছগার’ বা ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অযু করা হয়। শরীয়তের বিধান মতে পবিত্র পানি দিয়ে শরীরের কতিপয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধোওয়াকে অযু বলে। শরীয়তে অযুর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অযু ছাড়া নামায হয় না। তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে অযুর বিশেষ বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। যথা :

১. নামাযের জন্য অযু করা ফরয।

২. কা’বা শরীফ তাওয়াফ করার জন্য অযু করা ওয়াজিব।

৩. কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের জন্য, সর্বদা পবিত্র থাকার জন্য এবং গোসলের পূর্বে অযু করা সুন্নত।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে গিয়ে যখন বেহেশত দর্শন করলেন তখন তাঁর সামনে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পায়ের খড়ম (স্যান্ডেল বিশেষ) শব্দ শুনতে পেলেন। পরবর্তীতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করেন : ‘বিলাল! তুমি এমন কী আমল করো যার বরকতে বেহেশতে আমার সামনে সামনে তোমাকে দেখতে পাই।’ উত্তরে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তেমন কোনো আমল করি না, তবে যখনই অযু নষ্ট হয় তার সাথে সাথেই আমি পুনরায় অযু করে দু’রাকাআত নফল নাময আদায় করে নেই।’ সুবহানাল্লাহ্!

সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনেরা! উপরোক্ত বর্ণনা থেকে আমরা অযু এবং নফল নামাযের বরকত সম্বন্ধে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারলাম। সর্বাবস্থায় পবিত্র থাকার লক্ষ্যে আসুন আমরা আজ থেকে ইস্তেঞ্জা এবং গোসল ফরয হয় এমন প্রয়োজনীয়তা অনুভবের পূর্বেই অযু-গোসলের ব্যবস্থায় নিশ্চিত হবো। নেহায়েত অসুবিধায় না পড়লে এরকম ব্যবস্থাহীন স্থানে আমরা অপবিত্র হবো না। এভাবে অতি সহজে আমরা সর্বদা পবিত্রবাস্থায় জীবন অতিবাহিতের একটি পথ খুঁজে পাবো ইনশা‘আল্লাহ। পবিত্র হওয়ার পর বিশেষ করে অযুরর পরই আমরা দু’রাকায়াত তাহিয়্যাতুল অযু নামায পড়ে নেবো। এ পবিত্রতার যে কী উপকারিতা তা কিছুদিন পর আপনি নিজেই অনুভব করবেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র তাই তিনি পবিত্রতাকেই পছন্দ করেন। কম ঘুম এবং পরিমিত খাবার দেহ-মনের পবিত্রতার জন্য সহায়ক। অযুকারীর অযুর অঙ্গগুলো কিয়ামতের দিন ঝলমল করতে থাকবে।

অযুর পদ্ধতি :

অযুর পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কালামে পাকে দিয়েছেন এভাবে: ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু ইযা কুমতুম ইল্সা-সলাতি ফাগসিলু উজুহাকুম ওয়াআইদিয়াকুম ইলাল মারাফিক্বি ওয়ামসাহু বিরুউসিকুম ওয়াআরজুলাকুম ইলাল কা’বাইনি;

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের জন্য তৈরি হও, তখন তোমাদের মুখম-ল ও হাত দু’টি কনুই পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো, মাথার ওপর হাত বুলাও এবং পা দু’টি গোড়ালী পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো। (সূরা ৫ মায়েদা : আয়াত ৬)

অযু সম্পর্কীত কতিপয় হাদীসে রাসূল :

১.হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। একদা তিনি একটি পানির পাত্র আনিয়ে দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। তারপর তিনি ডান হাত পানির পাত্রে প্রবেশ করালেন এবং কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। তারপর তিনবার মুখম-ল এবং তিনবার দু’হাতের কনুই পর্যন্ত ধুইলেন। তারপর মাথা মাসেহ করলেন। দু’পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত তিনবার ধুইয়ে বললেন: রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার ন্যায় এরূপ অযু করার পর একাগ্রচিত্তে দু’রাকাত নামায পড়বে, কিন্তু মাঝখানে সে নাপাক হবে না। আল্লাহ পাক তার পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।”   (সহীহ আল বোখারী)

২.হযরত হুমরান থেকে বর্ণিত। তিনি একদা উসমান ইবনে আফফানকে দেখলেন যে, একটি পানির পাত্র আনিয়ে সে পানি দিয়ে দু’হাত তিনবার ধুলেন। তারপর তিনি তার ডান হাত পানির পাত্রে প্রবেশ করালেন এবং কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়লেন। তারপর তিনবার মুখম-ল এবং তিনবার দু’হাতের কনুই পর্যন্ত ধুলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার এ অযুর ন্যায় অযু করতে দেখেছি। আর তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার ন্যায় এরূপ অযু করার পর একাগ্রচিত্তে দু’রাকাত নামায পড়বে, কিন্তু মাঝখানে সে নাপাক হবে না। আল্লাহ তার পূর্বকৃত সকল গোনাহ মাফ করে দেবেন। (সহীহ আল বোখারী)

৩. হযরত উকবাহ ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তিই সুন্দর করে অযু করে প্রফুল্ল মন নিয়ে একাগ্রচিত্তে দু’রাকাআত সালাত আদায় করে, তখন তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম)

৪.হযরত মুসআব ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অযু ছাড়া নামায হয়না এবং আত্মসাতের সম্পদ থেকে সাদাকাহ হয় না। (সহীহ মুসলিম)

৫.যার অযু নষ্ট হবে অযু করার আগ পর্যন্ত তার নামায হয় না। (সহীহ আল বোখারী)

৬.নুয়াইম মুজমির বলেন- আমি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে মসজিদের ছাদে উঠলাম। তিনি অযু করলেন এবং বললেন, আমি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামাতের দিন আমার উম্মতকে এমন অবস্থায় ডাকা হবে যে, তাদের অযুর অঙ্গগুলো ঝলমল করতে থাকবে। অতএব তোমাদের কেউ যদি তার উজ্জল স্থানকে দীর্ঘ করতে চায় তবে সে যেন তা করে। (অর্থাৎ অযুর অঙ্গগুলো নির্ধারিত স্থান থেকে বেশি করে ধৌত করবে)। (সহীহ আল বোখারী)

৭. উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত-রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি উত্তমরূপে অযু করে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে- আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়ারাসূলুহু। তাহলে জান্নাতের আটটি দরজাই তার জন্য উম্মুক্ত হয়ে যায়। উক্তদরজা যেটি দিয়ে ইচ্ছা সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (সহীহ মুসলিম)

৮. অযু শুরুর দু‘আ : আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এমন এক সময় নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিলাম, যখন তিনি অযু করছিলেন এবং তাঁর যবান মুবারক থেকে এ দু‘আ উচ্চারিত হচ্ছিল : “হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করে দিন। আমার ঘরের প্রয়োজন মিটিয়ে দিন এবং আমার রিযিকে বরকত দান করুন।” (আন-নাসায়ী

৯. অযু শেষের দু‘আ : উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অযু সম্পন্নের পর নিম্নলিখিত দু‘আ করে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হবে। সে যে কোনো দরজা দিয়েই ইচ্ছা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে। (সহীহ মুসলিম ও জামে আত-তিরমিযী) দু‘আটি নিম্নরূপ :

আশহাদ আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শরীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ’আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। আল্লাহুম্মাজ্’আলনী মিনাত্ তাওয়াবীনা ওয়াজ’আলনী মিনাল মুতাত্বহ্হেরীন।

অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো ইলাহ্ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারী লোকদের মধ্যে শামিল করুন। (সহীহ মুসলিম ও জামে আত-তিরমিযী)

ছুবহানাকা ওয়াবিহামদিকা আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা আছতাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।

অর্থ : সমস্ত ত্রুটি ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত তুমি। তোমার প্রশংসা স্বীকার করে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তোমার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, তোমারই দিকে আমি প্রত্যাবর্তন করছি।

নিম্নে ধারাবাহিকভাবে ক. অযুর ফরয, খ. অযুর সুন্নাত ও নফল এবং গ. অযু ভঙ্গের কারণ বর্ণিত হলো :

. অযুর চার ফরয :

১. সমস্ত মুখম-ল ধোয়া (কপালের উপরিভাগ থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত এবং এক কানের লতি থেকে অপর কানের লতি)

২.দু’হাতের কনুইসহ একবার ধোয়া

৩. মাথার চার ভাগের এক ভাগ মাসেহ করা এবং

৪. দু’পায়ের টাখনুসহ একবার ধোয়া।

এ চারটি ফরযের যে কোনো একটি বাদ পড়লে অথবা বর্ণিত কোনো অঙ্গ চুল পরিমাণ শুকনা থাকলে অযু হবে না।

. অযুর সুন্নাত নফল:

১. অযুর পূর্বে মেসওয়াক করা

২. ‘বিসমিল্লাহ’ বলে অযু শুরু করা

৩. ডান দিক থেকে অযু শুরু করা

৪. দু’হাতের কব্জি ধোয়া

৫. অযুর নিয়ত করা

৬. এক অঙ্গ ধোয়ার পর অপর অঙ্গ ধুইতে বিলম্ব না করা

৭. প্রতি অঙ্গ তিন বার ধোয়া

৮. হাত পায়ের আঙ্গুলসমূহ মর্দন/খিলাল করা

৯. কুলি করা

১০. গড়গড়া করা

১১. নাকে পানি দেয়া

১২. ডান হাতে পানি দেয়া, বাম হাতে নাক পরিষ্কার করা

১৩. হাতে আংটি থাকলে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নেয়া

১৪. কানের ভিতর ও বাইরে দিয়ে পানি নেয়া

১৫. সমস্ত মাথা মাসেহ করা

১৬. ঘাড় মাসেহ করা

১৭. দাড়ি খেলাল করা

১৮. মোজা পায়ে না থাকলে পা ধোয়া, মোজা থাকলে মোজার উপর মাসেহ করা

১৯. মোজার উপর মাসেহ করা নিজ বাড়িতে থাকা অবস্থায় অর্থাৎ মুকীম-এর জন্য ১ দিন ১ রাত আর ভ্রমণে অর্থাৎ মুসাফির-এর জন্য ৩ দিন ৩ রাত পর্যন্ত

২০. কেবলামুখী হয়ে অযু করা

২১. অযুর সময় বাজে কথা না বলা

২২. ওয়াক্তের পূর্বে অযু করা

২৩. অযু করতে গিয়ে পানি অপচয় না করা

২৪. অযুর তারতীব (ধারাবাহিকতা) রক্ষা করা

২৫. উঁচু স্থানে বসে অযু করা

২৬. অযু শেষে দাঁড়িয়ে অযুর পানি পান করা

২৭. ডান হাতে করে পানি দেয়া

২৮. অযু করার পর ধৌত করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না মোছা

২৯. অযু শেষে দোয়া করা।

গ.অযু ভঙ্গের কারণ :

১. পায়খানা পেশাবের রাস্তা দিয়া কোন কিছু বের হওয়া

২. মুখ ভরে বমি হওয়া

৩. শরীরের কোন জায়গা হতে রক্ত, পুঁজ বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া

৪. থুথুর সাথে রক্তের ভাগ সমান বা বেশী হওয়া

৫.চিৎ বা কাত হয়ে হেলান দিয়ে ঘুম যাওয়া

৬. পাগল, মাতাল, অচেতন হওয়া এবং

৭. নামাযে উচ্চস্বরে হাসা।

You may also like