Home ইসলাম কোরআন তিলওয়াতের ফযীলত

কোরআন তিলওয়াতের ফযীলত

by admin
0 comment

কুরআন শিক্ষা ও তিলাওয়াত করা এবং কুরআনকে বুঝা ও মানার ফযীলত
মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী
কুরআন আল্লাহর কিতাব

আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানবতার হেদায়াতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলা হয়। আল কুরআন মানুষের জীবন বিধান। মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণ এবং মুক্তি ও সাফল্যের সত্যিকার গাইড লাইন। কুরআন সর্বজয়ী সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহর বাণী। কুরআনের ভাষা ও বক্তব্য চিরন্তন, চিরশাশ্বত ও চিরজীব। বিশ্ববাসীর কাছে কুরআন এক জীবন্ত মু’জিযা। কুরআন অবতির্ণ হয়েছে সমগ্রহ মাবজাতির জন্য। তাই কুরআনকে অপরিহার্য বিধান হিসেবে গ্রহণ করে এটি পাঠ করা, বুঝা এবং এর মর্ম উপলব্দি করা? সেই সাথে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল কুরআনের নির্দেশ পালন করা ও বাস্তবায়ন করা আমাদের কর্তব্য। যে ব্যক্তি কুরআন জানলোনা, কুরআন বুঝলো না, তার কাছে তো আলো আর অন্ধকার দু’টোই সমান। সুতরাং আলো দেখতে হলে কুরআন বুঝতে হবে। কুরআন না বুঝলে আলোতে আসার সুযোগ কোথায়। মূলত কুরআন জানা, কুরআন বুঝা, কুরআন মানা, কুরআন অনুসরণ করা ও বাস্তবায়ন করাই মুমিন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এজন্যে প্রয়োজন ও অবস্থাবেদে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট ২৩ বছরে কুরআন নাযিল হয়েছে। কুরআন হলো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের বাস্তবজিন্দেগী। আল কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা বিশ্বমানবতার জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘‘নিশ্চয় এ কুরআন বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষে থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।’’ (আশ শোয়ারা-২৬ আয়াত : ১৯২)

আল-কুরআনের পরিচয়

কুরআন আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর বাণী। অতি পঠিত, অধিক অধিক পঠিত। আল্লাহতায়ালা বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হেদায়াত হিসাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই জাহেলী জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন। এতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাব আলকুরআন শিক্ষা আজ অবহেলিত। দিন দিন কুরআন শিক্ষা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। একজন মুসলিম হিসাবে কুরআন শিক্ষার গুরুত্বও যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারছি না। সেজন্য আমাদেরকে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে কুরআনের পরিচয়, কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, কুরআন তিলাওয়াতের ফযিলত ও কুরআন শিক্ষা না করার পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা  হলো।

১.কুরআন হলো নুর বা আলো

অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য আল কুরআন হলো আলো বা নুর। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন’। (মায়িদাহ-৫ আয়াত : ১৫-১৬)

২.কুরআন মানবজাতির জন্য হেদায়াত

কুরআনুল কারীম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন মু‘জিযা, বিশ্ব মানবতার মুক্তিসনদ। এতে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক-নির্দেশনা, রয়েছে আলোকবর্তিকা, উপদেশ, রহমত ও অন্তরের যাবতীয় ব্যাধির উপশম। আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা বলেন,‘‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমাত। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশী হয়। এটি যা তারা জমা করে তার চেয়ে উত্তম।’’ আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার প্রতিটি বিষয় কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আমি তোমার নিকট কিতাবটি নাজিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ’। (নাহল-১৬ আয়াত : ৮৯)

৩.কুরআন রমাদান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে

কুরআন রমাদান মাসে লাইলাতুল ক্বদরে অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে : রমযান এমন মাস যাতে নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। যা বিশ্ব মানবতার জন্য হেদায়েতও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য বিধান কারী’ (বাকারা-২ আয়াত : ১৮৫)।

৪.কুরআন মুমিনদের  জন্য রহমাত

কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমাত হিসাবে নাযিল করা হয়েছে। যারা এ কুরআন পড়বে, তা অনুযায়ী আমল করবে তারা আল্লাহর রহমাতপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়।’ (বনি ঈসরাইল-১৭ আয়াত : ৮২)

৫.কুরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস

কুরআন মাজীদ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস এবং কুরআন যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নির্ভুল ও বাস্তবভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘ইয়া-সীন। বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ’। (ইয়াসিন-৩৬ আয়াত : ১-২)

৬.কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য চ্যালেঞ্জ

কুরআনের মত কোন কিতাব মানুষ বা কারো পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। প্রায় চৌদ্দশত বছর আগের চ্যলেঞ্জ এ পর্যন্ত কেও মুকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি। আর কিয়ামাত পর্যন্ত তা সম্ভবও হবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘বল, যদি মানব ও জ্বিন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআন অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’। (বনি ঈসরাই-১৭ আয়াত : ৮৮)

৭.কুরআন শিক্ষা সহজ

যারা কুরআন শিক্ষা করতে চান বা দিতে চান, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা সহজ করে দিয়েছেন। বুঝমান যেকোন বয়সের মানুষ তা শিখতে পারবে। কুরআনে ঘোষণা : ‘আর আমি তো কুরআন শেখার জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি’? (কামার-৫৪ আয়াত : ১৭)

৮.কুরআনের বেশ কিছু নাম রয়েছে

কুরআনের বেশ কিছু নাম রয়েছে। যেমন, হুদা-পথনির্দেশক, যিকর-উপদেশ বাণী, ফুরকান-সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, নুর-আলো ইত্যাদি। যেমন কুরআনে এসেছে, তিনি বরকতময় যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) নাযিল করেছেন যেন সে জগতবাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে। (ফুরকান-২৫ আয়াত : ১)

কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহর বাণী

১.উহারা কি দাবী করে যে কুরআন (আপনার) বানানো? আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও তাহলে একটি সূরা অন্তত : তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর, সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও। (ইউনুস-১০ আয়াত : ৩৮)

২.আর এই কুরআন এমন এক জিনিস নহে যা আল্লাহর অহী ও শিক্ষা ব্যতীত রচনা করে নেয়া সম্ভব হতে পারে। বরং উহাতে পূর্বে যা এসেছে তার সত্যতার স্বীকার ও আল কিতাবের বিস্তারিত রূপ। উহা যে বিশ্ব নিয়ন্তার তরফ থেকে আসা কিতাব, তাতে কোনরূপ সন্দেহ নেই। (ইউনুস-১০ আয়াত : ৩৭)

৩.আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বিন জাতি মিলেও যদি এ ধরনের একখানা কুরআন তৈরীর করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে। (বনী ইসরাইল-১৭ আয়াত : ৮৮)

৪.নিশ্চয়ই কুরআন আমি নাযিল করেছি। আর অবশ্যই উহার হেফাজতের দায়িত্ব আমারই। (হিজর-১৫ আয়াত : ৯)

৫.হে রাসূল দ্রুত কুরআন আয়ত্ত করার নিমিত্তে আপনি আপনার জিহবা সঞ্চালন করবেন না। কুরআন সংরক্ষণ করা এবং উহা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিব্রাঈলের জবানে) উহা পাঠ করি, তখন আপনি উহা অনুসরণ করুন। অত :পর উহা ব্যাখ্যাদান ও আমার জিম্মাদারী। (কিয়ামাহ-৭৫ আয়াত : ১৬ থেকে ১৯)

৬.উহারা নাকি বলে যে, কুরআন রাসূলের তৈরী করা? আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনে রচিত দশটি সূরা নিয়ে এস। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও। (হুদ-১১ আয়াত : ১৩)

৭.আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপরে নাজিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা, এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে। তাহলে অনুরূপ একটি সূরা তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (আল বাকারা-২ আয়াত : ২৩)

কুরআনে ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য

১.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন কোন রাসূল ছিলেন না যাকে মুজিজা দেয়া হয়নি, যা দেখে লোকেরা ঈমান এনেছে। কিন্তু আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে অহী (কুরআন) যা আল্লাহ আমার কাছে নাযিল করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি, কিয়ামতেরদিন তাদের অনুসারীদের তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা সর্বাধিক হবে। (সহীহ আল বুখারী)

কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব

কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যপারে আল্লাহর বাণী

১.আমরা যদি এ কুরআন কোন পাহাড়ে র উপর অবতীর্ণ করে দিতাম তাহলে তুমি দেখতে যে, তা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে যাচ্ছে ও দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ দৃষ্টান্ত এজন্য মানব জাতীর সামনে পেশ করলাম যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। (হাশর-৫৯ আয়াত : ২১)

কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য

১.হযরত নাওয়াছ ইবনে ছামআন রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আল্লাহ যখন কোন বিষয় ওহী করতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি অহীর দ্বারা কথা বলেন। তখনই আল্লাহর ভয়ে আকাশ কেঁপে উঠে। যখন আকাশ বাসীরা (ফিরেশতা) শুনে, তখন তারা বেহুশ হয়ে যায়, অথবা তিনি বলেন সেজদায় পতিত হয়। সর্ব প্রথম জিব্রাইল মাথা তুলেন। তখন আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তার সাথে ওহীর কথা বলেন। অত :পর জিব্রাইল মালাইকার পার্শ্ব দিয়ে যেতে থাকেন। যখন তিনি কোন আকাশ অতিক্রম করেন, আকাশ বাসীরা তাকে প্রশ্ন করতে থাকেন, ওহে জিব্রাইল! আল্লাহ কি বললেন? তিনি বলেন, তিনি অতীব সত্য বলেছেন, তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল এবং মহান। অত :পর সকলেই জিব্রাইলের মত বলতে থাকেন। আর জিব্রাইল আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী অহী পৌঁছিয়ে দেন। (তিবরানী)

আসমান, জমিন, পাহাড়-পর্বত, ফিরিশতা কুরআনের ভয়ে অস্থির অথচ মানুষ যাদের প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে, যারা কুরআনের কারনে সম্মানিত অথচ তাদের কাছে কুরআন অবহেলিত, যার পরিণতি দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংশ।

কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত

আল্লাহতায়ালা বলেন : “যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।”

কুরআন  তিলাওয়াত  দু’প্রকার। যথা :

১. তিলাওয়াতে লাফজি বা আক্ষরিক পাঠ।

২. তিলাওয়াতে হুকমি বা কার্যকরী পাঠ।

প্রথম প্রকার  তিলাওয়াত  : তিলাওয়াতে লাফজি বা আক্ষরিক পাঠ

কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত অনেক। অল্প আমলে অধিক সওয়াব তার জন্যই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব আকাঙ্খা করে। সুতরাং যে কুরআনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কুরআনের যথাযথ তদারকি করে না এবং তা দ্বারা উপকৃত না হয়, সে ক্ষতিগ্রস্ত। তিলাওয়াতে লাফজি, অর্থাৎ কুরআনের অক্ষর ও শব্দ পাঠ করা। আমাদের কর্তব্য এ কুরআন শিক্ষা করা। নিয়মিত এর তিলাওয়াত করা। এ কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। আমাদের দায়িত্ব নিজ সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া এবং তাদেরকে এর তিলাওয়াত ও ভালোবাসায় অভ্যস্ত হিসেবে গড়ে তোলা। যাতে এর সাথে তাদের হৃদ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এর সঙ্গে তাদের মনোসংযোগ ঘটে। এতে করে তাদের চরিত্র হবে পবিত্র ও অপঙ্কিল। তাদের আত্মা ও হৃদয় হবে পরিশুদ্ধ। তারা হবে কুরআনের ধারক ও বাহক। আমাদের উচিত, আল্লাহতায়ালাকে ভয় করা এবং কুরআনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া।

কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত সর্ম্পকে আল্লাহর বাণী

১.নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিযক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না। যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।

২.আহলে কিতাবের মধ্যে একদল ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ  তিলাওয়াত করে এবং তারা সিজদা করে।

৩.যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে।

৪.যে ব্যক্তি রাতের প্রহরে সিদজাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রব-এর রহমত প্রত্যাশা করো’।

৫.ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন তেলাওয়াত কর। (মুযাম্মিল-৭৩ আয়াত : ৪)

৬.এবং আমি এই কুরআনকে পৃথক পৃথক করে নাযিল করেছি যেন আপনি উহা মানুষের সম্মুখে থেমে থেমে পড়তে পারেন, আর আমি উহাকে নাযিল করার সময়ও (অবস্থামত) ক্রমে ক্রমে নাযিল করেছি। (যেন উহা সহজ ও সুষ্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়) (বনী ইসরাইল-১৭ আয়াত : ১০৬)

৭.আমি উহাকে এক বিশেষ দারায় আলাদা অংশে সজ্জিত করেছি। (ফুরকান-২৫ আয়াত : ৩২)

৮.উহারা কি দাবী করে যে কুরআন (আপনার) বানানো? আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও তাহলে একটি সূরা অন্তত : তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর, সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও। (ইউনুস-১০ আয়াত : ৩৮)

৯.নিশ্চয়ই কুরআন আমিই নাজিল করেছি। আর অবশ্যই উহার হেফাজতের দায়িত্ব আমারই। (হিজর-১৫ আয়াত : ৯)

১০.হে রাসূল দ্রুত কুরআন আয়ত্ত করার নিমিত্তে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কুরআন সংরক্ষণ করা এবং উহা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিব্রাঈলের জবানে) উহা পাঠ করি, তখন আপনি উহা অনুসরণ করুণ। অত :পর উহা ব্যাখ্যাদানও আমার জিম্মাদারী। (কিয়ামাহ-৭৫ আয়াত : ১৬ থেকে ১৯)

কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে  হাদীসের ভাষ্য

১.হযরত উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যিনি কুরআন মজিদ শিক্ষা করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়।”(সহীহ আল বুখারী)

২.উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম       বলছেন : কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান লেখক ফিরেশতাগণের সঙ্গী (মর্যাদার দিক দিয়ে তারা সম্মানিত ফিরেশতাগনের সমতুল্য) আর যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে মুকে আটকে যায়, বার বার ঠেকে যায় এবং উচ্চারণ করা বড়ই কঠিন বোধ করে তার জন্য দ্বিগুন সওয়াব। শুধু তিলাওয়াত করার জন্য একগুন আর কষ্ট করার জন্য আর একগুণ। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

৩.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন মাজীদ) এর একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে। আর একটি নেকি দশটি নেকীর সমান হয়। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ণ; বরং আলিফ একটি বর্ণ, লাম একটি বর্ণ, মীম একটি বর্ণ।’’ (অর্থাৎ, তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত ‘আলিফ-লাম-মীম’, যার নেকীর সংখ্যা হবে তিরিশ) (জামে আত তিরমিযী, হাসান)

৪.হযরত আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি যে,‘‘তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো। কেননা, কিয়ামতেরদিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে’’। (সহীহ মুসলিম)

৫.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,‘যখন কোনো দয়ালূ আল্লাহর কোনো ঘরে (মসজিদে) একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং একে অপরকে তা থেকে শিক্ষা দেয়, তাদের ওপর সকীনা নাজিল হয়, রহমত তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহতায়ালা তাঁর কাছে যারা আছেন তাদের কাছে এদের আলোচনা করেন।’

৬.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন কোন রাসূল ছিলেন না যাকে মুজিজা দেয়া হয়নি, যা দেখে লোকেরা ঈমান এনেছে। কিন্তু আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে অহী (কুরআন) যা আল্লাহ আমার কাছে নাযিল করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি, কিয়ামতেরদিন তাদের অনুসারীদের তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা সর্বাধিক হবে। (সহীহ আল বুখারী)

৭.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “যে কোন সম্প্রদায় আল্লাহর কোন ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং নিজদের মাঝে তা পঠন ও পাঠন করে, তাদের উপর শান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে রাখে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে রাখে এবং আল্লাহতায়ালা নিকটস্থ ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আলোচনা করেন।”

৮.হযরত উকবা বিন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :“তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দু’টি আয়াত পাঠ করে বা শিখে, তাকে দু’টি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। এভাবে যত বেশি আয়াত তিলাওয়াত করবে, ততবেশি উট সদকা করার সওয়াব প্রদান করা হবে।”

৯.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন : “তোমরা কুরআনের যথাযথ যতœ নাও, তা মুখস্থ ও সংরক্ষণ কর। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায়, তার চেয়েও আরো তীব্র বেগে পালানোর বস্তু এ কুরআন।”

১০.হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : হে আবু যর, তুমি যদি আল্লাহর কিতাব থেকে একটা আয়াত শেখ, তবে সেটা তোমার জন্য একশো রাকাত (নফল) নামায পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি তুমি ইসলামী জ্ঞানের একটা অধ্যায়ও মানুষকে শেখাও, তবে তা তোমার জন্য এক হাজার রাকাত নামায পড়ার চয়েও উত্তম, চাই তদনুসারে আমল করা হোক বা না হোক। (ইবনে মাযাহ)

১১.রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথা বলতে চায়, তবে সে যেন বেশী বেশী করে কুরআন তেলাওয়াত করে।

১২.হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : এই অন্তরসমূহের মরিচা ধরে, যেভাবে লোহায় মরিচা ধরে যখন উহাতে পানি লাগে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো : হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহার পরিশোধক কী? (উহার থেকে বাচাঁর উপায় কী?) তিনি বললেন : বেশী বেশী মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা। (সুনানে বায়হাকী)

১৩.হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তিন ব্যক্তি কিয়ামাতের প্রাক্কালীন মহা আতংকে আতংকিত হবে না এবং তাদের কোন হিসাব দিতে হবে না, বরঞ্চ তারা সমস্ত সৃষ্টি জগতের হিসাব গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত একটা মস্কের পাহাড়ে  থাকবে। (১) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাড়লো এবং জনগনের সম্মতি নিয়ে কুরআনের বিধান অনুযায়ী তাদের নেতৃত্ব করলো, (২) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষকে নামাযের দিকে ডাকে এবং (৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও বান্দার হক সুষ্ঠুভাবে পালন করে। (তাবরানী)

১৪.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘পবিত্র কুরআন পাঠক, হাফেয ও তার উপর আমলকারীকে (কিয়ামতেরদিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন কারীম পড়তে থাকো ও চড়তে থাকো। আর ঠিক সেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাকো, যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। কেননা, (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে।”     (আবু দাউদ, জামে আত তিরমীযি)

১৫.হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘ মহান আল্লাহ এই গ্রন্থ (কুরআন মাজীদ) দ্বারা (তার উপর আমলকারী) জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটান এবং এরই দ্বারা (এর অবাধ্য) অন্য গোষ্ঠীর পতন সাধন করেন’’। (সহীহ মুসলিম)

১৬.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দুজনের ক্ষেত্রে ঈষা করা সিদ্ধ। (ক) যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্ত করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে ওর (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। (খ) যাকে আল্লাহতায়ালা মাল-ধন দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর  পথে) দিন-রাত ব্যয় করে’’। (সহীহ আল বুখারী)

১৭.যে ব্যক্তি কুরআন পাক অধ্যায়ন করবে (অর্থ ও ব্যাখাসহ জ্ঞান করবে) অর্থাৎ তদনুযায়ী জীবন গঠন করবে-উহার হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম জানবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন এবং তার পরিবার পরিজনদের ভেতর থেকে এমন দশজনকে (জান্নাতের জন্য) সুপারিশ করার ক্ষমতা দান করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছিল।

১৮.হযরত ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেন : রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে : যে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছি-তাই তার ব্যাপারে আমাকে সুপারিশ করার অনুমোতি দিন। আর কুরআন বলবে : হে আমার রব! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমাকে তার ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দিন। তখন তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (সুনানে বায়হাকী)

১৯.হযরত ওবাদাহ ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের এক অংশে বলা হয়েছে,“পবিত্র কুরআন কবরে তার সাথীর কাছে এসে বলবে, আমি রাত্রি জাগরণ ও দিনের পিপাসার্ত রেখেছি তোমাকে যৌন চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত রেখেছি এবং তোমার কান ও চোখকে সংযত রেখেছি। সুতরাং তুমি এখন আমাকে তোমার সত্যিকার বন্ধু হিসেবে পাবে। তার পর কুরআন উপরে উঠবে এবং বিছানা ও চাদর কামনা করবে, তখন তাকে বেহেশতের বিছানা, বাতি ও ইয়াসমিন ফুল দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। তার পর কেবলার দিকে কুরআনকে ধাক্কা দিয়ে আল্লাহ যতটুকু চান ততটুকু কবরকে সম্প্রসারণ করবেন।

২০.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু আতœীয়-স্বজন রয়েছে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো : হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা? তিনি  বলেন : যারা কুরআনের ধারক-বাহক, তারাই আল্লাহর আতœীয় ও আপন জন। (আন নাসায়ী,ইবরে মাযাহ,হাকেম)

২১.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যারা কোন জায়গায় একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকে তারা আল্লাহর মেহমান হয়ে যায়। ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে যতক্ষন পর্যন্ত তারা উঠে না যায় বা অন্য কাজে লিপ্ত না হয়। ততক্ষন যাবত ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে।

২২.হযরত উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মসজিদে নববীতে আমরা বিভিন্ন মজলিসে বিভক্ত হয়ে দ্বীনের আলোচনা করতাম, কেউ যিকের, কেউ দোয়া, কেউ কুরআন তেলাওয়াত, কেউ কুরআন সর্ম্পকে আলোচনায় মশগুল থাকতাম। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযরা থেকে এসে কোরআনের মজলিসে বসে যেতেন। তিনি বলতেন আমাকে এই মজলিসে বসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

২৩.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন,‘কিয়ামতেরদিন কুরআন আবির্ভূত হয়ে বলবে, হে রব, (তিলাওয়াত কারীকে) আপনি সুসজ্জিত করুন। তখন তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। তারপর বলবে, হে রব, আপনি আরও বৃদ্ধি করুন। তখন তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অতপর বলবে, হে রব, আপনি তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহতায়ালা তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। তারপর বলবে, তুমি পড় এবং ওপরে উঠো। এভাবে প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে।

২৪.হযরত নাওয়াস ইবনে সামআন রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘‘কুরআন ও ইহজগতে তার উপর আমলকারীদেরকে (বিচারের দিন মহান আল্লাহর সামনে) পেশ করা হবে। সূরা বাক্কারাহ ও সূরা আল ইমরান তার আগে আগে থাকবে এবং তাদের পাঠকারীদের সপক্ষে (প্রভুর সঙ্গে) বাদানুবাদে লিপ্ত হবে। (সহীহ মুসলিম)

২৫.হযরত বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘একদা একটি লোক সূরা কাহাফ পাঠ করছিল। তার পাশেই দু’টো রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। ইতোমধ্যে লোকটিকে একটি মেঘে ঢেকে নিলো। মেঘটি লোকটির নিকটবর্তী হতে থাকলে ঘোড়াটি তা দেখে চমকাতে আরম্ভ করল। অতঃপর যখন সকাল হল তখন লোকটি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হয়ে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল। তা (শুনে) তিনি বললেন, ‘‘ওটি প্রশান্তি ছিল, যা তোমার কুরআন পড়ার দরুণ অবতীর্ণ হয়েছে।’’ (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম)

২৬.হযরত আবু মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কুরআন পাঠকারী মুমিনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঠিক কমলা লেবুর মত; যার ঘ্রাণ উওম এবং স্বাদও উওম। আর যে মুমিন কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক খেজুরের মত; যার (উওম) ঘ্রাণ তো নেই, তবে স্বাদ মিষ্ট। (অন্যদিকে) কুরআন পাঠকারী মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধিময় (তুলসি) গাছের মত; যার ঘ্রাণ উওম কিন্ত স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক মাকাল ফলের মত; যার (উওম) ঘ্রাণ নেই, স্বাদও তিক্ত।’’         (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম )

দ্বিতীয় প্রকার  তিলাওয়াত : তিলাওয়াতে হুকমি বা কার্যকরী পাঠ

আল্লাহর আদেশ মান্য করা ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার করার মাধ্যমে কুরআন অনুযায়ী জীবন-যাপন করাই হচ্ছে তিলাওয়াতে হুকমি। অর্থাৎ কুরআনের সকল সংবাদ বিশ্বাস, কুরআনে বর্ণিত সকল নিষিদ্ধ বস্তু বর্জন ও সকল নির্দেশ পালন করার মাধ্যমে কুরআনের হুকুম আহকাম মেনে চলা। আর কুরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এ প্রকার  তিলাওয়াত।

কুরআনের হুকুম আহকাম মেনে চলার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন

১.আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আমি এমন বরকতপূর্ণ কিতাব তোমার নিকট নাজিল করেছি, যাতে করে তারা এর আয়াত নিয়ে গবেষণা করতে পারে এবং যাতে করে জ্ঞানবানরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।”

আমাদের পূর্ব পুরুষ সালফে সালেহিনগণ এ আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী কুরআন অধ্যয়ন করতেন। তারা এর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও সুদৃঢ় আকিদা পোষণ করে এর হুকুম আহকামগুলো বাস্তবায়ন করতেন।

২.আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়েত আসে, তখন যে আমার হেদায়েতকে অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতেরদিন উত্থিত করব অন্ধ করে। সে তখন বলবে, হে আমার রব, কেন তুমি আমাকে অন্ধ করে উত্থিত করলে? আমিতো ছিলাম চক্ষুষ্মান। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে এসেছিল তোমার নিকট আমার আয়াতগুলো। এরপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তুমি বিস্মৃত হবে। এমনিভাবে আমি তাকে দেব প্রতিফল, যে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং বিশ্বাস করেনি তার রবের আয়াতসমূহের প্রতি। আর পরকালের শাস্তি হবে কঠোরতর এবং অনেক স্থায়ী।”

৩.আল্লাহতায়ালা এ আয়াত সমূহে রাসুলদের নিকট পাঠানো হেদায়েত অনুসরণকারীদের কল্যাণের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আমাদের সামনে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হল সবচেয়ে বড় হেদায়েত। এখানে তিনি হেদায়েত বিমুখদের শাস্তির কথাও বর্ণনা করেছেন। যারা হেদায়েত অনুসরণ করবে, তারা পথভ্রষ্ট হবে না, দুঃখ কষ্টে পতিত হবে না, তাদের থেকে পথ বিচ্যুতি ও অকল্যাণ দূর করে দেয়া হবে। তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে নেয়ামত ও কল্যাণ অব্যাহত থাকবে। আর যারা হেদায়েত বিমুখ, যারা হেদায়েত অনুযায়ী আমল করেনি বরং অহংকার করেছে, তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি। তারা দুনিয়া ও আখেরাতে পথ ভ্রষ্টতায় থাকবে, তাদের থেকে দুঃখ কষ্ট লাগব করা হবে না। তাদের জীবন হবে খুব-ই সংকীর্ণ। তারা দুনিয়াতে দুশ্চিন্তা ও আত্মিক অস্থিরতার মধ্যে থাকবে। কারণ, তাদের কোন সহীহ বিশ্বাস বা নেক আমল ছিল না। আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে-ই বলেছেন। “এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট, এরাই হলো গাফেল।” হেদায়েত প্রত্যাখ্যানকারী এ গ্রুপের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতেরদিন অন্ধ হয়ে উত্থিত হবে, তারা কিছুই দেখতে পাবে না।

৪.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আমি কিয়ামতেরদিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব।”

৫.তারা দুনিয়ায় সত্য পথ অবলম্বন করেনি, সত্য কথাও শ্রবণ করেনি। তারা ছিল অন্ধ-বধির। আল্লাহতায়ালা তাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : “তারা বলে, আপনি যে বিষয়ের দিকে আমাদেরকে ডাকছেন, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আবৃত, আর আমাদের কর্ণে আছে বধিরতা এবং আমাদের ও আপনার মাঝখানে আছে অন্তরায়।”

৬.তারা দুনিয়াতে যেরূপ কর্ম করেছে আল্লাহতায়ালা আখেরাতে তাদেরকে সেরূপ প্রতিদান দেবেন। এরা যেরূপ আল্লাহর শরিয়তকে ধ্বংস ও বিনষ্ট করেছে, তদ্রুপ আল্লাহও তাদের ধ্বংস ও বিনষ্ট করবেন।

৭.আল্লাহতায়ালা এসব কাফিরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : “সে বলবে, হে আমার রব! তুমি কেন আমাকে অন্ধ করে উত্থিত করলে অথচ আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান? তখন আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল এরপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে, তাই আজ তোমাকেও সেরূপ ভুলে যাওয়া হবে, বিস্মৃত হবে তুমি।”এটা তাদের কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান হিসেবে দেয়া হবে। তাদের জন্য আরো রয়েছে জাহান্নামের ফুটন্ত পানি ও পুঁজ।

৮.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আর যে ব্যক্তি মন্দ কর্ম নিয়ে আসবে, তবে যারা মন্দ কর্ম করেছে, তাদের সেরূপই প্রতিদান দেয়া হবে।”

কুরআনের হুকুম আহকাম মেনে চলার ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য

১.হযরত আবু আব্দুর রহমান আস্সুলামা রহ. বলেন : “যারা আমাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন, তারা আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ ওসমান বিন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবাবৃন্দ। যখন তারা নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআনের দশটি আয়াত শিখতেন, তখন তারা এ দশটি আয়াতই ভালভাবে আত্মস্থ করতেন এবং এতে যা এলম ও আমল আছে তা বাস্তবায়ন করা ছাড়া সামনে অগ্রসর হতেন না। তারা বলেন, এভাবেই আমরা কুরআন, এলম ও আমল সব এক সঙ্গে শিখেছি।” এ প্রকার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই মানুষের ভাগ্য নির্ণীত হয়, কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা।

২.সহীহ বুখারীতে আছে : “আল্লাহর নবী ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন নামায পড়তেন, অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, যখন ফজরের নামায পড়তেন তখন তিনি আমাদের দিকে মুখ করে অগ্রসর হয়ে বলতেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আজ রাতে কোন স্বপ্ন দেখছে? হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, কেউ স্বপ্ন দেখলে সে তা বর্ণনা করত। তিনি স্বপ্ন শ্রবন করে বলতেন, মা-শাআল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ যা চেয়েছেন তা-ই হয়েছে।

অভ্যাস মোতাবেক একদিন তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কেউ কি আজ রাতে কোন স্বপ্ন দেখেছে? আমরা বললাম না, তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি। দু’জন লোক রাতে আমার নিকট এসেছে, (হাদীসের ভাষা, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন) আমরা চললাম, অতঃপর এমন জায়গায় আসলাম যেখানে একজন লোক শুয়ে আছে, অপরজন তার মাথার কাছে পাথর নিয়ে দাঁড়ানো। মাথার ওপর পাথর নিক্ষেপ করতেই, মাথা পাথরের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, যখন সে পাথর উঠিয়ে আনতে যায়, তার মাথা পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। অতঃপর তার সাথে পুনরায় আগের মত ব্যবহার করা হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আমি এতে আশ্চর্য হয়ে বললাম, সুব্হানাল্লাহ! এটা কি? তারা দু’জন আমাকে বলল, সামনে চলুন।

এ হাদিসের শেষে আছে, যে লোকটার মাথা খ-বিখ- করা হচ্ছিল, সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে কুরআনকে গ্রহণ করে, দূরে নিক্ষেপ করেছে, ফরয নামাজ আদায় না করে ঘুমিয়ে থেকেছে।”

৩.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু  আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে সকলকে লক্ষ্য করে বলেছেন : “এ ভূমিতে শয়তানের দাসত্ব করা হবে, এমন আশা শয়তান করে না। তবে তা ছাড়া অন্য ব্যাপারে যে তোমরা তার আনুগত্য করবে, তাতেই সে সন্তুষ্ট। যেমন তোমরা তোমাদের আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, খবরদার! এমনটি কর না। আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আকড়ে ধরলে তোমরা গোমরাহ হবে না। অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নত।”

৪.সহীহ মুসলিম শরীফে আবু মালেক আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : “কুরআন তোমার পক্ষের কিংবা বিপক্ষের দলীল।”

৫.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “কুরআন সুপারিশকারী এবং তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তার অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।”

৬.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু  আনহু বলেন : “কুরআন পাঠকের রাতের মর্যাদা বুঝা উচিত, যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে; দিনের গুরুত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ রোযা বিহীন থাকে; ক্রন্দনের মহত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ হাসে; তাকওয়ার গুরুত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ গুনাহে লিপ্ত হয়; নিরবতার ফযীলত বুঝা উচিত, যখন মানুষ অযথা গল্পে-আড্ডায় মগ্ন থাকে; বিনয়ের কদর করা উচিত, যখন মানুষ অহংকার করে এবং চিন্তার গুরুত্ব উপলব্দি করা উচিত, যখন মানুষ উল্লাসে মেতে থাকে।”

যাদের বিরুদ্ধে কুরআন মামলা করবে, তাদের জন্য কুরআন কিভাবে সুপারিশ করবে, তারা কিভাবে কুরআনের সুপারিশ আশা করতে পারে? হে আল্লাহর বান্দাগণ! এটা আল্লাহর কালাম, আল-কুরআন। যে কুরআন পাহাড়ের পর নাযিল হলে, পাহাড়ও ভয়ে ফেঁটে পড়ত। তা সত্বেও তোমাদের কর্ণসমূহ কুরআন শ্রবন করছে না! তোমাদের চক্ষুসমূহ অশ্রু “ঝরাচ্ছে না! ভীত সন্ত্রস্ত হচ্ছে না তোমাদের হৃদয়সমূহ! আফসোস! কি ভাবে তোমরা জাহান্নাম থেকে নির্ভয় হয়ে গেলে! অথচ কুরআন হচ্ছে জাহান্নাম থেকে নাজাতের একমাত্র পথ, তার সুপারিশ নিশ্চিত কবুল করা হবে। তবুও কেন তোমাদের এ পশ্চাৎগামীতা, কুরআন বিমূখীতা।

আমাদের অন্তরগুলো তাকওয়া শূন্য, জনমানব হীন পরিত্যক্ত এক মরুভূমি, যার চারদিকে ছড়িয়ে আছে গোনার অন্ধকার। আমাদের অন্তরগুলো পাথরের মত কিংবা তার চেয়ে আরো কঠিন। কত রমযান আমাদের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে অথচ আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কোন যুবক বিরত থাকেনি তার যৌবনের ফানুস উড়ানো থেকে, কোন বৃদ্ধ সরে আসেনি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে। আমরা কবে হব তাদের মত, যারা কুরআনের ডাকে সাড়া দেয়, কুরআনের তিলাওয়াত শুনে যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয়, কেঁপে উঠে। তারা সত্যকে চিনতে পেরেছে, তারাই কল্যাণের পথ এখতিলর করেছে। তাদের ওপরই রয়েছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও দল।

সময় ফুরিয়ে যাবার পূর্বে কুরআন মুখস্থ করে নিন, এর বিধানের সীমালঙ্ঘন করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখুন, এ কুরআন একদিন আপনার পক্ষ নিবে কিংবা বিপক্ষে অবতীর্ণ হবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন : “আর সেদিন যালিম নিজের হাত দু’টো কামড়িয়ে বলবে, ‘হায়, আমি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম! হায়, আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর।’ আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক। আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে। আর এভাবেই আমি প্রত্যেক রাসূলর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শক্র বানিয়েছি। আর পথ পথ প্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।”

কুরআন তিলাওয়াতের আদব

কুরআন কিন্তু যেনতেন কোনো গ্রন্থ না। এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। অতএব এটাকে আমরা অন্য দশটি বইয়ের মতো পড়তে পারি না। এটি পাঠ করার আগে-পিছে কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নইলে তা আমাদের জন্য নেকীর পরিবর্তে পাপই বয়ে আনবে। কুরআন পড়তে গিয়ে তাই বেশ কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। চলুন এবার আমরা সেসব আদব সম্পর্কে জেনে নেই।

১. নিয়ত খালেস করা : কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে নিয়ত খালেস করা।

ক) আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন : “সুতরাং তোমরা আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সাথে ডাক।”

খ) আল্লাহতায়ালা বলেন : “সুতরাং তুমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত কর।”

গ) আল্লাহতায়ালা বলেন : “তাদের এ জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে, এখলাসের সাথে।”

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করছেন : “তোমরা কুরআন  তিলাওয়াত  কর এবং এ  তিলাওয়াত  দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। সে দলের আবির্ভাবের পূর্বে যারা কুরআনকে তীরের ন্যায় স্থাপন করবে। কুরআন দ্রুত পড়বে, ধীর স্থীরভাবে পড়বে না।”

নিয়ত শুদ্ধ করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতেরদিন তিন শ্রেণীর লোকের ওপর আগুনের শাস্তি কঠোর করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ক্বারী। আর কুরআন তিলাওয়াত কারী ক্বারী সাহেবকে আগুনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে এ কারণে যে তিনি ইখলাসের সাথে কুরআন  তিলাওয়াত  করতেন না। অনুরূপভাবে কিয়ামতেরদিন প্রথম যে তিন শ্রেণীর লোককে তীব্র অগ্নিযাতনায় নিক্ষেপ করা হবে তাদের মধ্যেও একজন এই ক্বারী। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘যখন কিয়ামতের দিন হবে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা তাঁর বান্দাদের বিচারের উদ্দেশে আবির্ভূত হবেন। তখন প্রতিটি জাতি ভয়ে নতজানু হয়ে পড়বে।

বান্দাদের মধ্যে প্রথমে ডাকা হবে কুরআনের বাহক, আল্লাহর পথে শহীদ ও সম্পদশালী ব্যক্তিকে। ক্বারীর উদ্দেশে আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাকে তা শিখায়নি যা আমার রাসূলের ওপর নাজিল করেছিলাম? বলবে, জি, হে আমার রব। আল্লাহতায়ালা বলবেন, সুতরাং তুমি যা শিখেছো তার কী আমল করেছো? সে বলবে, আমি দিন-রাতের নানা প্রহরে নামাজে এ কুরআন  তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। ফেরেশতারাও তার উদ্দেশে বলবে, তুমি মিথ্যা বলেছো। তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলবেন, বরং তোমার অভিপ্রায় ছিল লোকেরা তোমাকে ক্বারী বলে ডাকবে। আর তা তো তোমাকে বলা হয়েছেই। ফলে তুমি দুনিয়াতেই তোমার প্রতিদান পেয়ে গেছো। তুমি দুনিয়াতেই তোমার প্রতিদান পেয়ে গেছো।’ (হাদীসের পরের অংশে রয়েছে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের হেফাজত করুন) অতএব কুরআন তিলাওয়াত করার আগে প্রথম আমাদের নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে।

২.অযু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা : পবিত্র হয়ে অযু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা। অযু ছাড়াও কুরআন পড়া যাবে; কিন্তু তা অযু অবস্থায় পড়ার সমান হতে পারে না।

৩.একনিষ্ঠভাবে কুরআন পাঠ করা : একনিষ্ঠ মন নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। যা পড়া হয় তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা, তার অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা, বিনয়ীভাব গ্রহণ করা এবং নিজকে এমনভাবে হাজির করা যেন আল্লাহর সাথে সংলাপ হচ্ছে। বাস্তবেও কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে সংলাপ,যেহেতু কুরআন আল্লাহতায়ালারই বাণী

৪.মিসওয়াক করা : কুরআন তিলাওয়াতের আগে মিসওয়াক করা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘তোমাদের মুখগুলো কুরআনের পথ। তাই সেগুলোকে মিসওয়াক দ্বারা সুরভিত করো।’ (ইবনে মাযাহ)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো বান্দা নামাজে দাঁড়ায়, তখন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি মনোযোগসহ তিলাওয়াত শোনেন আর এগিয়ে আসেন। এভাবে সে পড়তে থাকে আর তিনি এগোতে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ স্থাপন করেন ওই তিলাওয়াত কারীর মুখের ওপর। সে একটি আয়াত  তিলাওয়াত করে তা ফেরেশতার পেটে প্রবেশ করে।’ অতএব  তিলাওয়াত কারীর উচিৎ মিসওয়াক করে তিলাওয়াত  করা যাতে ফেরেশতা তার মুখের গন্ধে কষ্ট না পান।

৫.পবিত্র অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা : পবিত্র অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা। অপবিত্র ব্যক্তি বা যার উপর গোসল ফরজ, সে পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত কুরআন পাঠ করবে না। সম্ভব হলে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে অন্যথায় তয়াম্মুম দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে। তবে গোসল ব্যতীত আল্লাহর যিকির করতে পারবে এবং কুরআনে আছে এমন দোয়া পাঠ করতে পারবে, কিন্তু কুরআন পাঠের নিয়তে নয়। যেমন সে বলতে পারে : “আল্লাহ তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয় আমি জালিমদের অর্ন্তভুক্ত।” কিংবা পড়তে পারবে : “হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে হেদায়েত দান করার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করে দিওনা। আর তুমি তোমার পক্ষ থেকে দান কর আমাদের রহমত। নিশ্চয় তুমি অফুরন্ত দানশীল।”

৬.আউযুবিল্লাহ পড়া : কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে আউযুবিল্লাহ পড়া। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “যখন তুমি কুরআন পাঠ কর, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও।

আয়াতের অর্থ কুরআন পড়ার শুরুতে। কতিপয় বিজ্ঞ আলিম বলেন, এ আয়াতের দাবী অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াতের সূচনায় ‘তাআউউয’ (আউযুবিল্লাহ) পড়া ওয়াজিব। অবশ্য আলিমদের সর্বসম্মত মত হলো এটি মুস্তাহাব।

যাতে তিলাওয়াতের সর্বক্ষেত্রে শয়তানের বাধা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। সূরার মাঝখান থেকে তিলাওয়াত করলে বিসমিল্লাহ পড়ার প্রয়োজন নেই, শুধু আউজুবিল্লাহ পড়লেই চলবে, সূরার শুরু থেকে পাঠ করলে বিসমিল্লাহ পড়বেন। অবশ্য সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়বেন না। কারণ এ সূরার প্রথমে বিসমিল্লাহ নেই।

৭. ময়লা আবর্জনা আছে এমন স্থানে কুরআন তিলওয়াত না করা : ময়লা আবর্জনা আছে এমন স্থানে কুরআন তিলওয়াত না করা। যেখানে গান-বাদ্য বা শোরগোল হচ্ছে এমন জায়গায় কুরআন তিলাওয়াত না করা। এ সব জায়গায় কুরআন  তিলাওয়াত করা, কুরআনের সাথে অসম্মান ও অপমান জনিত ব্যবহার করার শামিল। প্রশ্রাব কিংবা পায়খানার জন্য তৈরীকৃত স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েজ নেই।

৮.বিসমিল্লাহ পড়া : বিসমিল্লাহ পড়া। তিলাওয়াত কারীর উচিত সূরা তাওবা ছাড়া সকল সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে তিনি এক সূরা শেষ করে বিসমিল্লাহ বলে আরেক সূরা শুরু করতেন। কেবল সূরা আনফাল শেষ করে তাওবা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তেন না।

৯.তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া : তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা তারতীলের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত কর।’

১.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্ত্রীকে তাঁর তিলাওয়াতের ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা সেভাবে পড়তে পারবে না। বলা হলো, আপনি আমাদের তা কেমন বলুন। তখন তিনি একটি কিরআত পড়লেন। তিনি স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে পড়লেন।

২.হযরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত কেমন ছিলো? তিনি বলেন, তিনি টেনে টেনে (মদসহ) পড়তেন।

৩.হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এক ব্যক্তি বলল, আমি এক রাক‘আতে ‘মুফাসসালে’র একটি সূরা পড়ি।

৪.হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বললেন, কাব্যের মতো স্বচ্ছন্দে!? (তিনি তার পড়ার দ্রুতগতির কথা ভেবে বিস্মিত হলেন) নিশ্চয় একটি সম্প্রদায় কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ সে তিলাওয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করে না। কিন্তু তা যখন অন্তরে পতিত হয় এবং তাতে গেঁথে যায়, তখন তা উপকারে আসে।

৫.হযরত ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা একে (কুরআন) নষ্ট খেজুরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ো না কিংবা কবিতার মতো গতিময় ছন্দেও পড়ো না। বরং এর যেখানে বিস্ময়ের কথা আছে সেখানে থামো এবং তা দিয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করো। আর সূরার সমাপ্তিতে পৌঁছা যেন তোমাদের কারো লক্ষ্য না হয়।’ বলাবাহুল্য, তারতীলের সঙ্গে তিলাওয়াত করা কুরআন নিয়ে চিন্তা করা এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক।

১০. তিলাওয়াতের কণ্ঠ সুন্দর করা : কুরআন তারতীল বা ধীর স্থীরভাবে সুন্দর করে  তিলাওয়াত করা। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে  তিলাওয়াত  কর।” কুরআন  তিলাওয়াত করবে ধীর স্থীরভাবে। কারণ ধীর স্থীরভাবে তিলাওয়াত করলে শব্দ ও অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ করা যায় এবং কুরআনের অর্থ অনুধাবন করার জন্যও সহায়ক হয়। সহীহ বুখারীতে এসেছে : “আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কেরাতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, তার কেরাত ছিল দীর্ঘ আকারের, টেনে টেনে তিনি তিলাওয়াত করতেন। এরপর তিনি রাসূলের তিলাওয়াত নকল করার জন্য পড়লেন : তিনি ‘আল্লাহ, রাহমান ও রাহীম শব্দে মদ করলেন।

হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : “রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা একটা আয়াত, আলাদা আলাদা করে পড়তেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :“তোমরা বালু ছিটানোর মত ও কবিতার আবৃতি দ্রুত কুরআন  তিলাওয়াত কর না। কুরআনের বিস্ময়কর বিষয়ের নিকট থামো এবং কুরআন দ্বারা তোমাদের অন্তরসমূহকে আন্দোলিত কর। তোমাদের কারো সূরা শেষ করা-ই যেন তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য না হয়।”

তিলাওয়াতের কণ্ঠ সুন্দর করা এবং সুর দিয়ে তিলাওয়াত করা। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনের ক্ষেত্রে আওয়াজ সুন্দর করার জন্য যতটুকু তাগিদ দিয়েছেন, অন্য কোন বিষয়ে তত তাগিদ দেননি।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত জুবাইর ইবনে মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “আমি মাগরিব নামাযে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরায়ে তুর পড়তে শুনেছি। এত সুন্দর কণ্ঠ ও কেরাত আমি আর কারো থেকে শুনিনি।”

সুন্দর করে মনের মাধুরী মিশিয়ে কুরআন পড়া। হযরত বারা’ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি এশার নামাজে সূরা তীন পড়েছেন। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি।’

হযরত বারা’ বিন আযেব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজ কণ্ঠ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য দান করো। কারণ সুরেলা কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।’ অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সুকণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য।’

উল্লেখিত উভয় হাদীসই বিশুদ্ধ। উল্লেখ্য যে, সুকণ্ঠ দিয়ে তিলাওয়াতের মধ্যে রয়েছে একে সৌন্দর্য দান, শ্রীবৃদ্ধিকরণ ও নতুনত্ব আনয়ন। সুরারোপ করে কুরআন তিলাওয়াত করা। এটি সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াতেরই অংশ বিশেষ। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মত নয় যে সুরসহযোগে কুরআন পড়ে না।’

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,‘আল্লাহতায়ালা কোনো রাসূলকে এতটুকু সূর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন রাসূলকে কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন।’ অতএব বুঝা গেল সুর দিয়ে কুরআন  তিলাওয়াত  করা কুরআন তিলাওয়াতের আদবের অন্তর্ভুক্ত এবং তা মুস্তাহাব।

১১.উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ না করা : অন্যের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এমন উচ্চ আওয়াজে কুরআন পড়বে না।

কারো কষ্টের কারণ হলে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করবে না। যেমন নামাযী, ঘুমন্ত বা অসুস্থ ব্যক্তির নিকট। একদা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতক সাহাবাদের দেখলেন, তারা নামাযে উচ্চ স্বরে কেরাতে পড়ছে, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন : “নামাযী ব্যক্তি নিজ রব আল্লাহর সাথে মোনাজাত করে, অতএব তার লক্ষ্য রাখা উচিত, কিভাবে সে প্রার্থনা করবে। কুরআন পাঠের সময় একজনের আওয়াজ অপর জনের আওয়াজের চেয়ে যেন উচ্চ না হয়।”

উচ্চারণে জোর দিয়ে পড়া। অর্থাৎ  তিলাওয়াত কারী পুরুষ হলে মেয়েদের মতো কণ্ঠ মোলায়েম করে পড়বে না। তদ্রুপ  তিলাওয়াত কারী নারী হলে পুরুষের মতো করে উচ্চস্বরে পড়বে না। প্রত্যেকে নিজের স্বাভাবিক স্বরে কুরআন পড়বে। আল্লাহতায়ালার পবিত্র গ্রন্থ আবৃত্তি করতে গিয়ে কেউ কারও নকল করবে না।

একজন আরেকজনের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত না করা। কারণ এভাবে স্বর উঁচু করার মধ্য দিয়ে অন্যকে কষ্ট দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মনে রেখো, তোমরা সবাই আপন রবের সঙ্গে সঙ্গোপনে কথা বলছো। অতএব একে অপরকে কষ্ট দেবে না। একজন অপরের ওপর গলা চড়িয়ে  তিলাওয়াত করবে না।’

হযরত আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন পাঠের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তিনি টেনে টেনে পড়তেন। ”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করার সময় ”বিসমিল্লাহ্” টেনে পড়তেন, একইভাবে ”আররাহমান” টেনে পড়তেন, ”আররাহীম” টেনে পড়তেন। (সহীহ আল বুখারী)

১২.তেলাওয়াতে সেজদা

তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত এলে সিজদা দেয়া। সিজদার নিয়ম হলো, তাকবীর দিয়ে সিজদায় চলে যাওয়া।

কুরআন তিলাওয়াতের সময় সেজদার আয়াত আসলে সেজদা করা, তবে ওজু থাকা জরুরি। সিজদার নিয়ম : প্রথমে আল্লাহু আকবার বলে সিজাদায় যাবে এবং সিজদায় গিয়ে বলবে : সুবাহানা রাব্বিয়াল আলা অতঃপর দোয়া করবে। সিজদা থেকে তাকবীর বলে মাথা উঠাবে, তবে নামাজের ন্যায় সালাম ফিরাবে না।

বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সিজদায় মাথা উঠাতে ও নামাতে তাকবির বলতেন। তিনি বলতেন,

“রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এরূপ করেছেন।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্যেকবার মাথা উঠাতে ও নামাতে, বসতে ও দাঁড়াতে তাকবির বলতে দেখেছি।” এ হাদিস নামাযের সিজদা ও নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতের সিজদা উভয়কেই শামিল করে। এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের কতিপয় আদব।

১৩.ওয়াকফ করা : আয়াত শেষে ওয়াকফ করা। কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, আয়াতের সমাপ্তি স্থলে ওয়াকফ করা। যদিও তা অর্থগত দিক থেকে পরবর্তী আয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কারণ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে কেটে কেটে পড়তেন। ওয়াকফ করতেন। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  তিলাওয়াত  সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে টুকরো টুকরো করে পড়তেন।

১৪. ঘুম পেলে বা ঝিমুলি এলে  তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা : রাতে ঘুম পেলে বা ঝিমুনি এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ে, ফলে তার জিহ্বায় কুরআন এমনভাবে জড়িয়ে আসে যে সে কী পড়ছে তা টের না পায়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।’ অর্থাৎ তার উচিত এমতাবস্থায় নামাজ না পড়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। যাতে তার মুখে কুরআন ও অন্য কোনো শব্দের মিশ্রণ না ঘটে এবং কুরআনের আয়াত এলোমেলো হয়ে না যায়।

১৫.ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো বেশি বেশি  তিলাওয়াত  করা : ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীলংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়বে! তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য।’ (সহীহ মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘তোমরা (লোকজনকে) একত্রিত করো। আমি তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো। ফলে সাহাবীদের মধ্যে যারা ছিলেন সমবেত হলেন। অতপর তিনি তাঁদের সামনে কুলহু আল্লাহহু আহাদ (সূরা ইখলাস) পড়লেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন আমরা একে অপরকে বলতে লাগলাম, এটা বোধ হয় আসমান থেকে আসা কোনো খবর, যা সংগ্রহ করতে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। এক্ষণে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বের হলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের বলেছি, তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ  তিলাওয়াত করবো। শুনে রাখো, সেটি কুরআনের এক তৃতয়াংশের সমান।’(সহীহ মুসলিম) অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ-লাম-সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।

১৬. রুকূ ও সিজদায় কুরআন তিলাওয়াত না করা : রুকূ ও সিজদায় তিলাওয়াত না করা। সহীহ হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘হে লোকসকল, নবুওয়াতের সুসংবাদের মধ্যে কেবল সুন্দর স্বপ্নগুলোই অবশিষ্ট আছে, যা একজন মুসলমান দেখে বা তাকে দেখানো হয়। জেনো রাখো,আমাকে রুকূ ও সিজদায় কুরআন পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। রুকূতে রবের বড়ত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করবে। আর সিজদায় বেশি বেশি দোয়ায় সচেষ্ট হবে। তবে তা কবূলের অধিক যোগ্য বিবেচিত হবে। (সহীহ মুসলিম)

এর হিকমত বা রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিল রহ. বলেন, ‘রুকূ ও সিজদা নতি প্রকাশের জায়গা। তাই নতি প্রকাশের স্থানে কুরআন না পড়া শ্রেয়। হ্যা, রুকু সিজদায় গিয়ে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করবে।

১৭. ধৈর্য্য নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা : ধৈর্য্য নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। যিনি অনায়াসে কুরআন পড়তে পারেন না তিনি আটকে আটকে ধৈর্যসহ পড়বেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কুরআন পাঠে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে সে সম্মানিত রাসূল ও পুণ্যত্মা ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে। আর যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কুরআন তিলাওয়াত করবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী লেখা হবে।’(সহীহ আল বুখারী)

অতএব কেউ যদি এই কষ্টের ওপর ধৈর্য ধরেন এবং ভালোভাবে শেখা অব্যাহত রাখেন তাহলে নিশ্চিত তিনি বিশাল প্রতিদান লাভ করবেন ইনশাআল্লাহ।

১৮.তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা। আল্লাহতায়ালা তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দনরতদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (বনি ইসরাইল-১৭ আয়াত : ১০৯)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘আমাকে তুমি তিলাওয়াত করে শুনাও।’ বললাম, আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন, ‘আমি অন্যের  তিলাওয়াত  শুনতে পছন্দ করি’। অতপর আমি তাঁকে সূরা নিসা পড়ে শুনাতে লাগলাম। যখন আমি (অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর সাক্ষীরূপে? এ পৌঁছলাম, তিনি বললেন, ব্যাস, যথেষ্ট হয়েছে। তখন আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। ’(সহীহ আল বুখারী)

আরেক সাহাবী বলেন, ‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম। তিনি নামাজ পড়ছিলেন আর তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।’(আন নাসায়ী)

হযরত উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু একদিন সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি নিচের আলতে পৌঁছেন, তাঁর দুইগ- বেয়ে অশ্রুর ধারা বইতে শুরু করে। আয়াতটি ছিলো-‘সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’। ইউসূফ-১২          আয়াত : ৮৬

কাসিম একদা হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি দেখেন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু নিচের আয়াতটি বারবার আবৃত্তি করছেন আর কেঁদে কেঁদে দু‘আ করছেন। আয়াতটি হলো-‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’ (আততুর-৫২ আয়াত : ২৭)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিচের আয়াত তিলাওয়াত করেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন ‘আর মৃত্যুর যন্ত্রণা যথাযথই আসবে। যা থেকে তুমি পলায়ন করতে চাইতে’। (ক্বাফ-৫০ আয়াত : ১৯)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিচের আয়াতটি পড়তেন, তখনই তিনি কান্নাকাটি করতেন-‘আর তোমরা যদি প্রকাশ কর যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে অথবা গোপন কর, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন’। (বাকারা-২ আয়াত : ২৮৪)

তাছাড়া আমরা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা জানি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর যখন খলীফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলো, তখন হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী, নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে তিনি খুব বেশি কাঁদেন।’ (সহীহ ইবনে খুযাইফা) কুরআন তিলাওয়াতের সময় কান্নাকাটি করা এবং চোখে পানি আসা বিনয় ও ঈমানের লক্ষণ, যদি কান্নাটি আসে অন্তর থেকে। কান্না কিন্তু কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে : বিনয় ও ন¤্রতার কান্না, ভীতি ও আতঙ্কের কান্না, ভালোবাসা ও অনুরাগের কান্না, খুশি ও আনন্দের কান্না এবং দুঃখ ও বেদনার কান্না। মনে রাখতে হবে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় কেবল বিনয় ও ন¤্রতার কান্নাই কাম্য; কপট তথা কৃত্রিম বা লোক দেখানোর কান্না নয়। আর বিনয়ের কান্না সেটিই যা মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার করে। যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কুরআন তিলাওয়াতের সর্বোত্তম কণ্ঠ সে ব্যক্তির, যার  তিলাওয়াত কেউ শুনলে মনে হয় সে কাঁদছে।’(ইবনে মাযাহ)

তবে কান্নার ভান করা দুই ধরনের। একটি প্রশংসনীয় আরেকটি নিন্দনীয়। প্রশংসনীয় কান্না হলো, যে কান্নার ভান করার দ্বারা হৃদয় বিগলিত হয়, মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় আর সঙ্গে সঙ্গে তা হয় রিল ও লৌকিকতা মুক্ত। যেমন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কান্নার কথা বলেছিলেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বদরের কয়েদিদের ব্যাপারে কাঁদতে দেখে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে অবহিত করুন কোন জিনিসের কারণে আপনি ও আপনার সাথী কাঁদছেন? সম্ভব হলে আমি কাঁদবো, নয়তো আপনাদেরদুজনের অনুকরণে কান্নার ভান করবো।’ (সহীহ মুসলিম)

দেখুন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিন্তু তাঁর এ কথা অপছন্দও করেননি। তেমনি অনেক পূর্বসুরী বুযুর্গ বলতেন, আল্লাহর ভয়ে তোমরা কাঁদো যদি কাঁদতে না পারো তাহলে কান্নার ভান করো। পক্ষান্তরে নিন্দনীয় কান্না হলো, যে কান্নার উদ্দেশ্য মানুষের প্রশংসা বা সুনাম কুড়ানো। এটি মুনাফেকদের কান্না।

আমাদের খেলল রাখতে হবে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় যেন আমাদের অন্তর ডানে-বামে ছোটাছুটি না করে। মনোযোগসহ নিবীষ্ট চিত্তে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে।

১৯. কুরআনের মর্ম নিয়ে চিন্তা করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো এর মর্ম নিয়ে চিন্তা করা। সাধারণভাবে বলতে গেলে এটিই আসলে তিলাওয়াতের সবচেড়ে গুরুত্বপূর্ণ আদব। তিলাওয়াতের সময় চিন্তা-গবেষণা করাই এর প্রকৃত সুফল বয়ে আনে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’।               (সোয়াদ-৩৮ আয়াত : ২৯)

অতএব কুরআন থেকে সে-ই উপকৃত হতে পারবে যে আল্লাহতায়ালার মহান বাণী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব ও মহিমার কথা মনের পর্দায় ভেসে তুলবে। কুরআন তাকে কী বলছে তা বুঝার চেষ্টা করবে। এবং এ কথা মনে রাখবে যে সে এটি বুঝার জন্য এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য তিলাওয়াত করছে। তাই কেউ যদি মুখে কুরআন পড়ে আর মন পড়ে থাকে তার অন্য কোথাও, তবে সে তিলাওয়াতের কাঙ্গিত ফায়দা অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’। (মোহাম্মদ- ৪৭ আয়াত : ২৪)

হযরত ‘হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একরাতে আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামাজ পড়লাম। তিনি বাকারা শুরু করলেন। আমি মনে মনে বললাম, তিনি একশত আয়াত পড়ে রুকূ করবেন। অবশ্য তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম, তিনি দুইশত আয়াত পড়ে রুকু করবেন। কিন্তু তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম, তিনি হয়তো এ সূরা দিয়েই একরাত পড়বেন। এরপরও তিনি পড়েই চললেন। (বাকারা শেষ করে) নিসা শুরু করলেন। নিসা পড়ে তিনি আলে-ইমরান শুরু করে তাও শেষ করলেন। তিনি মন্থর গতিতে পড়ছিলেন। তাসবীহ সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে তাসবীহ পড়েন। প্রার্থনা সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে প্রার্থনা করেন। শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তারপর তিনি রুকূতে যান।’ (আন নাসায়ী, সহীহ মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খারেজী সম্প্রদায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, তারা কুরআন  তিলাওয়াত  করবে কিন্তু তা তাদের গলা অতিক্রম করবে না। (সহীহ আল বুখারী)

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না।’ (আবু দাউদ)

যায়েদ বিন সাবেতকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সাত দিনে কুরআন খতম করাটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? তিনি বললেন, এটা ভালো। অবশ্য আমি এটাকে পনের দিনে বা দশ দিনে খতম করাই পছন্দ করি। আমাকে জিজ্ঞেস করো, তা কেন? তিনি বললেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। যায়েদ বললেন, যাতে আমি তার স্থানে স্থানে চিন্তা করি এবং থামি।’ (মুয়াক্তা মালেক)

আমাদের কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে হবে কেবল আমলের জন্য : ‘হযরত আবু আবদুর রহমান রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের কুরআন পড়িয়েছেন তারা বলেছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দশ আয়াত শিখতেন। তারপর আরও দশ আয়াত ততক্ষণ শিখতেন না যাবৎ তাঁরা এ কয়টি আলতে কী এলেম আছে আর কী আমল আছে, তা না জানতেন। তাঁরা বলেন, সুতরাং আমরা এলেম শিখেছি এবং আমল শিখেছি।’ (সুমনাদে আহমাদ)

যে ব্যক্তিই আল্লাহ উদ্দেশ্যে একনিষ্ঠভাবে কুরআন পাঠ করবে সেই তার সওয়াবের অধিকারী হবে। কিন্তু এই সওয়াব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে যখন হৃদয়-মন উপস্থিত রেখে আয়াতগুলোর অর্থ বুঝে গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে তা পাঠ করবে। তখন একেকটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ থেকে সত্তরগুণ; কখনও সাতশত গুণ পর্যন্ত সওয়াব দৃদ্ধি করা হবে।

২০. মাঝামাঝি সূরে কুরআন পাঠ করা : উচ্চস্বরে ও নিরবের মাঝামাঝি স্বরে কুরআন তিলাওয়াত  করা। সরবে কুরআন  তিলাওয়াত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা কোনো রাসূলকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন রাসূলকে কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন।’ (আবু দাউদ, আন নাসায়ী)

অনুরূপ তিনি ইরশাদ করেছেন,‘সরবে কুরআন তিলাওয়াত প্রকাশ্য সদকাকারীর ন্যায় এবং নিরবে কুরআন  তিলাওয়াত গোপনে সদকাকারীর ন্যায়।’ (আবু দাউদ)

প্রথম হাদীসে সরবে আর দ্বিতীয় হাদীসে নিরবে পড়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাহলে কীভাবে সিদ্ধান্তে আসবো? হ্যা, উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ইমাম নববী রহ. বলেন, যেখানে রিল, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙ্গানো বা নামাজরত ব্যক্তি কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেখানে নিরবে পড়া উত্তম। কারণ, নামাজী ব্যক্তির পাশে সরবে  তিলাওয়াত করলে তার পড়ায় বিঘœ ঘটবে। তাছাড়া তিলাওয়াতেও ব্যাঘাত ঘটবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে নিরবে পড়াই  শ্রেয়। এছাড়া অন্য সময় সরবে পড়া উত্তম। কারণ এতে স্বর উঁচু করা, কষ্ট ও চেষ্টা ব্যয় করার অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়। তদুপরি সরবে তিলাওয়াত পাঠক হৃদয়কে জাগ্রত করে। তার চিন্তাকে কুরআনের প্রতি নিবীষ্ট এবং কর্ণকে এর দিকে উৎকর্ণ করে। এর ফলে পাঠক বেশি লাভবান হন। এভাবে তা বেশি আত্মস্থ হওয়া, শয়তানকে বিতাড়ন করা, ঘুম তাড়ানো ও উদ্যম সৃষ্টিতে অধিক সহায়ক। (আল ইতকান)

হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিরবে কুরআন  তিলাওয়াত  করতেন আর উমর করতেন সরবে। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সরবে পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘সরবে পড়ে আমি শয়তানকে বিতাড়ন করি এবং ঝিমুনি তাড়াই। অতপর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু বাড়াতে আর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু কমাতে। (মুসান্নাফ)

আরেকটি কথা, ধরুন আপনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন। কিছুক্ষণ সরবে পড়ার পর একটু ক্লান্ত হয়ে গেলেন। এবার একটু আওয়াজ কমিয়ে পড়তে লাগলেন। তারপর যখন ক্লান্তি কেটে গেল তো আবার সরবে পড়া শুরু করলেন। আমাদের অনেকেরই হয়তো এমন হয় ঠিক না? জেনে রাখুন, এতে কোনো সমস্যা নেই।

২১. আদবসহ বসা : যথাসম্ভব আদবসহ বসা। বসা, দাঁড়ানো, চলমান ও হেলান দেয়া-সর্বাবস্থায়  তিলাওয়াত করার অনুমতি রয়েছে। কারণ আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে’। (ইমরান-৩ আয়াত :১৯১)

তবে উদাহরণ স্বরূপ বিনয়ের সঙ্গে বসে পড়া হেলান দিয়ে পড়ার চেয়ে উত্তম। জায়েযের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনোটাতেই সমস্যা নেই। কিন্তু উত্তমের কথা বিবেচনা করলে বিনয় ও ন¤্রতার সঙ্গে বসে পড়াই  শ্রেয়। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে চারজানু হয়ে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার জিকির করতেন।

২২.তিনদিনের কম সময়ে খতম না করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো তিনদিনের কম সময়ে খতম না করা। কেননা আগেই উল্লেখ করেছি যে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না।’ (আবু দাউদ)

২৪. সুন্দর পোশাক পরিধান করবে।

২৫. কিবলামুখী হয়ে বসবে।

২৬. হাই উঠলে কুরআন পড়া বন্ধ করে দিবে।

২৭. বিনা প্রয়োজনে কুরআন পড়া অবস্থায় কারো সাথে কথা বলবে না।

২৮. সওয়াবের আয়াত পাঠ করলে থামবে এবং উক্ত সওয়াব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। আর শাস্তির আয়াত পাঠ করলে তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।

২৯. (পঠন ব্যতিত) কুরআনকে খুলে রাখবে না বা তার ওপরে কোনো কিছু চাপিয়ে রাখবে না।

৩০. বাজারে বা এমন স্থানে কুরআন পড়বে না যেখানে মানুষ আজেবাজে কথা-কাজে লিপ্ত।

৩১.দিন-রাতে কতটুকু কুরআন পাঠ করবে : রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ সাধারণত প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাঁদের কেউ সাতদিনের কম সময়ে সাধারণত কুরআন খতম করতেন না। বরং তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করার ব্যাপারে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

অতএব সম্মানিত পাঠকের কাছে নিবেদন, আসুন আমরা আমাদের দিনের একটি অংশ কুরআন পাঠের জন্য নির্ধারণ করি। যত ব্যস্তই থাকি না কেন ওই অংশটুকু পড়ে নিতে সচেষ্ট হই। যুক্তি হচ্ছে যে কাজ সব-সময় করা হয় তা অল্প হলেও বিচ্ছিন্নভাবে বেশি কাজ করার চেয়ে উত্তম। অবহেলা বা গাফিলতির কারণে যদি কুরআন পড়া না হয় তাহলে পরবর্তী দিন যেন আবারও পড়ার জন্য সচেষ্ট হই সকলে।

রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষ্য হচ্ছে ‘কোনো মানুষ যদি কুরআনের নির্দিষ্ট অংশ না পড়ে ই ঘুমিয়ে পড়ে  তবে ফজর ও জোহর নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে যেন তা পড়ে নেয়। তাহলে তার আমলনামায় তা রাতে পড়ার মতো সওয়াব লিখে দেওয়া হবে।’ (সহীহ মুসলিম)

কুরআনের বৈশিষ্ট

এ কুরআন যা আপনাদের নিকট আছে, আর যা আপনারা  তিলাওয়াত  করছেন, শুনছেন, মুখস্থ করছেন ও লিপিবদ্ধ করছেন, তা বিশ্ব জাহানের রব মহান আল্লাহতায়ালার কালাম। যিনি আপনাদের রব। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার ইলাহ। এ কুরআন আল্লাহতায়ালার সুদৃঢ় রজ্জু, তার সরল সঠিক পথ ও দিক নির্দেশনা এবং বরকতময় উপদেশ বাণী ও স্পষ্ট নূর। এ কুরাআন দ্বারাই আল্লাহতায়ালা নিজ শান মোতাবেক কালাম করেছেন। তিনি জিব্রাইল এর মাধ্যমে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর এ কুরআন নাজিল করেছেন। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায় মানব জাতিকে সতর্ক করবেন।

আমাদের অন্তরে এ কুরআনের মহত্ব, গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ধিত করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা কতিপয় বিশেষণে বৈশিষ্ট্যম-িত করেছেন এ কুরআনকে।

১.আল্লাহতায়ালা বলেন : “রমযান এমন মাস যাতে নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। যা বিশ্ব মানবতার জন্য হেদায়েতও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য বিধান কারী।”

২.আল্লাহতায়ালা বলেন : “এটা এমন গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ আপনার নিকট  তিলাওয়াত  করি।”

৩.আল্লাহতায়ালা বলেন : “হে মানব জাতি! অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দলীল এসেছে এবং তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নূর আমি নাজিল করেছি।”

৪.আল্লাহতায়ালা বলেন : “অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে।”

৫.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আর এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।”

৬.আল্লাহতায়ালা বলেন : “হে লোক সকল! তোমাদের নিকট উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, এবং তা অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েতও মুমিনদের জন্য রহমত।”

আল্লাহতায়ালা বলেন : “এটা এমন কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্টিত। অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময় সত্বার পক্ষ থেকে।”

৭.আল্লাহতায়ালা বলেন : “নিশ্চয় আমি উপদেশ বাণী তথা কুরআন নাজিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই।”

৮.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আমি তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহা কুরআন। আমি তাদের কিছু শ্রেণীকে যে ভোগ উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি দু’চোখ প্রসারিত করো না। আর তাদের জন্য দুঃখিত হয়ো না। এবং মুমনিদের জন্য তোমার বাহু অবনত কর।”

৯.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আমি তোমার নিকট কিতাবটি নাজিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদয়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ।”

১০.আল্লাহতায়ালা বলেন : “নিশ্চয় এ কুরআন, যা যথার্থ ও সঠিক পথের দিকেই পথ নির্দেশ করে এবং ঈমানদারদের সুসংবাদ প্রদান করে, যারা নেক কাজ করে, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে। আর যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান আনে না তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।”

১১.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আমি নাজিল করেছি এমন কুরআন যা রোগের নিরাময় এবং মুমিনদের জন্য রহমত স্বরূপ। আর এটা জালিমদের ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছুই বৃদ্ধি করে না।”

১২.আল্লাহতায়ালা বলেন : “বলে, যদি মানব ও জ্বিন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআন অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়।”

১৩.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আমি তোমার প্রতি আল কুরআন এ জন্য নাজিল করিনি যে, তুমি দুর্ভোগ পোহাবে। বরং যে ভয় করে তার জন্য উপদেশ স্বরূপ। যিনি যমীন ও সুউচ্চ আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট থেকে অবতীর্ণ।”

১৪.আল্লাহতায়ালা বলেন : “বরকতময় সেই সত্বা যিনি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী কুরআন তাঁর বান্দার প্রতি নাজিল করেছেন, যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।”

১৫.আল্লাহতায়ালা বলেন : “নিশ্চয় এ কুরআন তো বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেস্তা একে নিয়ে অবতরণ করেছে, আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্যতম হোন, সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায়। নিশ্চয় এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে। তাদের জন্যে এটা কি নিদর্শন নয় যে, বনী-ইসরাইলের আলেমগণ এটা অবগত আছেন।”

১৬.আল্লাহতায়ালা বলেন : “আর শয়তানরা এ কুরআন নিয়ে অবতরণ করে না। আর তাদের জন্য উচিতও নয় এবং তারা পারবেও না।”

১৭.আল্লাহতায়ালা বলেন : “বরং এ কুরআন কতিপয় নিদর্শন ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে এদের হৃদয়ে কতিপয় সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা।”

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “এটা তো কেবল এক উপদেশবাণী ও প্রকাশ্য কুরআন। যাতে তিনি সতর্ক করতে পারেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।”

১৮.আল্লাহতায়ালা বলেন : “তোমার নিকট অবতীর্ণ করেছি এক বরকতপূর্ণ কিতাব যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে পারে, আর জ্ঞানীরা যেন উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।”

১৯.আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : “আল্লাহ উত্তম বাণী নাজিল করেছেন, যা সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কিতাব, যা বার বার পঠিত হয়। যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, অতঃপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনয় হয়ে যায়। এটা আল্লাহর  হেদায়াত, তিনি যাকে চান এর দ্বারা হেদায়েত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হেদায়েতকারী নেই।”

২০.আল্লাহতায়ালা বলেন : “নিশ্চয়ই কুরআন তাদের নিকট আগমন করার পর যারা তা অস্বীকার করে (তাদের পরিণাম ভোগ করতে হবে) এটা অবশ্যই মহিমাময় গ্রন্থ। বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করে না, না সামনে থেকে, না পিছন থেকে, এটা প্রশংসিত, প্রজ্ঞাময় রবের পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে।”

২১.আল্লাহতায়ালা বলেন : “এমনিভাবে আমি তোমার কাছে আমার নির্দেশ থেকে রূহ-কে ওহী যোগে  প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী আর ঈমান কী? কিন্তু আমি একে আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করি। আর নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও।”

২২.আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন : “নিশ্চয় এ কুরআন আমার কাছে উম্মুল কিতাবে সুউচ্চ মর্যাদা, প্রজ্ঞাপূর্ণ।”

২৩.আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন : “এটা মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়াত ও রহমত।”

২৪.আল্লাহতায়ালা বলেন : “অতএব আমি তারকারাজির অস্তাচলের শপথ করছি। নিশ্চয় এটা মহা শপথ যদি তোমরা জানতে। নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক গুপ্ত গ্রন্থে, লওহে মাহফুযে। যারা পাক-পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করে না। এটা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।”

২৫.আল্লাহতায়ালা বলেন : “যদি আমি নাজিল করতাম এ কুরআনকে পাহাড়ের ওপর তাহলে অবশ্যই তুমি দেখতে পেতে পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য উপস্থাপন করি। যাতে তারা চিন্তা করতে পারে।”

২৬.আল্লাহতায়ালা জ্বিন জাতির কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : “নিশ্চয় আমরা বিস্ময়কর এক কুরআন শুনেছি যা হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। সুতরাং আমরা এর প্রতি ঈমান আনলাম।”

২৭.আল্লাহতায়ালা বলেন : “বরং এটা সম্মানিত কুরআন। যা লওহে মাহফুজে রয়েছে।”

এ সব বৈশিষ্ট যা কুরআনের ব্যাপারে উল্লেখ করলাম আর যা উল্লেখ করিনি, সব গুলোই এ কুরআনের মহত্ব ও বিশালত্বের জ্বলন্ত দলীল এবং কুরআনকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন করার প্রতি আহ্বান জানায়। বিরত থাকতে বলে এর সাথে সব ধরনের আদব বর্হিভূত আচরণ, উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা থেকে।

কুরআন শিক্ষা থেকে উদাসীনতা এবং এর ভয়াবহ পরিণাম

অধিকাংশ মানুষই আজ কুরআন শিক্ষা থেকে উদাসীন। বড়রা ব্যস্ত দুনিয়া আর দুনিয়াদারি নিয়ে। ছোটরা ব্যস্ত স্কুলের রুটিন নিয়ে যেখানে কুরআন শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না। যথাযথ যতœও নেয়া হয় না। শিক্ষকরাও তাদের প্রতি কাম্য দায়িত্ব পালন করেন না। আর তাদের অবশিষ্ট সময় অপচয় হয় রাস্তা-ঘাটে খেলাধুলার পেছনে। ফলে তারা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে বেড়ে উঠছে। তাই দেখা যায় বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় হচ্ছে অথচ শুদ্ধভাবে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতও পড়তে পারে না। এজন্যই দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদেই এখনো শুদ্ধ তিলাওয়াত  করতে পারে এমন ইমাম পাওয়া যায় না। আর এসবের প্রধান কারণ সন্তানদের কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে পিতাদের অবহেলা। এদিকটিকে তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া। তারা জানেন না তাদের সন্তান কুরআন পড়তে পারে কি-না। এমনি আজ অধিকাংশ মুসলমানই কুরআনকে ছেড়েই দিয়েছেন। দেখুন আল্লাহর রাসূল এদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালার কাছে কীভাবে অভিযোগ করছেন-‘আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।’

ইবনে কাসির রহ. বলেন, কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করা, কুরআন বুঝতে চেষ্টা না করাও কুরআন পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। কুরআনের আমল ছেড়ে দেয়া, এর নির্দেশ পালন না করা এবং নিষেধ উপেক্ষা করাও তা পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। এবং কুরআন ছেড়ে অন্য কথা-কাব্যে, অনর্থক বাক্যালাপ ও গান-বাজনায় ডুবে থাকাও পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য।

কুরআন অমান্য করার শাস্তি

কুরআন

১.যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক সমস্যার সমাধান করেনা তারা কাফের। (মায়েদা-৫ আয়াত : ৪৪)

২.আমার ষ্পষ্ট বয়ান সম্বলিত আয়াত সমূহ নাযিল করেছি। অস্বীকার কারীদের জন্য অপমানকর আযাব।             (মোজাদালা-৫৮ আয়াত : ৫)

৩.যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান সমূহ গোপন করে এবং সামান্য বৈষয়িক স্বার্থের জন্য তা বিসর্জন দেয়, তারা মূলত : নিজেদের পেট আগুনের দ্বারা ভর্তি করে। কিয়ামতেরদিন আল্লাহ কখনই তাদের সাথে কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি রয়েছে। (আল বাকারা-২ আয়াত : ১৭৫)

৪.তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো (মান) আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো। জেনে রাখো, তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ আচরণ করবে, তারা দুনিয়ার জীবনে অপমানিত ও লাঞ্চিত হতে থাকবে এবং পারকালে তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষেপ করা হবে। (আল বাকারা-২ আয়াত : ৮৫)

হাদীস

১.হযরত সোহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন : যে কুরআনে বর্ণিত হারামকে হালাল মনে করে, সে কুরআনের প্রতি ঈমান গ্রহণকারী নয়। (জামে আত তিরিমিযী)

২.হযরত হারিসুল আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের বিধি-বিধান, নিয়মনীতির দিকে আহ্বান জানায়, সে জাহান্নামী। যদিও সে রোযা রাখে, নামায পড়ে , এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। (মুসনাদে আহমাদ ও জামে আত তিরমিযি)

৩.হযরত আবু হুরায়ারা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কুরআনের কোন বিষয় নিয়ে বাদ-প্রতিবাদে লিপ্ত হওয়া কুফরী। (মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদ)

কুরআন শিক্ষা ও তিলাওয়াতের উপকারীতা

১.কুরআন শিক্ষা করা ফরয

প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। যে নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহর ঘোষণা : ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’। (আলাক-৯৬ আয়াত : ১)

কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে হযরত ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’। (মুসান্নাফ)

২.সালাত আদায়ের জন্য কুরআন শিক্ষা করা

আল্লাহতায়ালা ঈমানদার বান্দাহদের উপর প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সালাত আদায় হয় না। সালাত আদায় করার জন্যও কুরআন শিখতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়’। (মুযযাম্মিল-৭৩ আয়াত : ২০)

এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না’। (সহীহ আল বুখারী )

৩.কুরআন প্রচারের জন্য শিক্ষা করা

কুরআন মাজীদে কুরআন প্রচারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে নির্দেশের আলোকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম কুরআন প্রচার-প্রসারে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না, সে কীভাবে তা প্রচার করবে? সুতরাং কুরআন প্রচার-প্রসার ভূমিকা পালন করার জন্য তা শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। কুরআনে বলা হয়েছে, হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও। (মায়িদাহ-৫ আয়াত : ৬৭)

৪. কুরআন শিক্ষা করা অন্তরের প্রশান্তি

মানব জীবনে অর্থ বা অন্যান্য কারণে জাগতিক তৃপ্তি আসলেও প্রকৃত তৃপ্তি ও শান্তি কুরআন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এ জন্য কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমান আনে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ (আররাদ-১৩ আয়াত : ২৮)।

৫.হেদায়েত লাভের জন্য কুরআন শিক্ষা করা

আল-কুরআনুল কারীম মহারাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন মু‘জিযা, বিশ্ব মানবতার মুক্তিসনদ। এতে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক-নির্দেশনা, রয়েছে আলোকবর্তিকা, উপদেশ, রহমত ও অন্তরের যাবতীয় ব্যাধির উপশম। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন,‘‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমাত। বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে ও রহমাতে’। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশী হয়। এটি যা তারা জমা করে তার চেয়ে উত্তম।’’

কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়াতের সন্ধান পাওয়া যাবে। সে জন্য কুরআন থেকে  হেদয়াত পাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক’।            (বনি ইসরাঈল-১৭ আয়াত : ০৯)

তিনি আরো বলেন,‘‘আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, শুধু এজন্য যে, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে, তাদের জন্য তা তুমি স্পষ্ট করে দেবে এবং এটি হিদায়াত  ও রহমাত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।’’

৬.জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা করা

প্রত্যেক মু’মীনের সর্বোচ্চ কামনা হলো জান্নাতে যাওয়া। তাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। হাদীসে এসেছে, সিয়াম ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব, আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি  (রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (মুসনাদ আহমাদ)

৭.কুরআন পাঠকারী  প্রত্যেক হরফের জন্য সওয়াব লাভ করে

কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরাট সওয়াব অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। এর সাথে অনেক উপকারিতাও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।’’ (জামে আত তিরমিযি)

৮.কুরআনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সর্বোত্তম ব্যক্তি

কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে  কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয় ’’। (সহীহ আল বুখারী)

৯.কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা

কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন ব্যবসায় লাভ এবং ক্ষতি দুটিরই সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এখানে লাভ ছাড়া কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা নেই। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন :‘‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দলবান।’’ (ফাতির-৩৫ আয়াত : ২৯-৩০)

১০.কুরআন তিলাওয়াত কারীর পক্ষে সুপারিশ করবে

কিয়ামতেরয়াবহ অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত কারীর পক্ষে সুপারিশ করবে। এটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। হযরত আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ, কুরআন কেয়ামতের দিন তিলাওয়াত কারীর জন্য সুপারিশ করবে’ (সহীহ মুসলিম)

১১.কুরআন পড়া উত্তম সম্পদ অর্জন

কুরআন পড়া বা শিক্ষা দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকা উত্তম সম্পদ অর্জন করার অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ কোন সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কোরআন হতে দুটি আয়াত পড়ে বা শিক্ষা দেয়? তাহলে সেটি তার জন্য দুটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম হবে। তিনটি আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা উত্তম। চারটি আয়ত চারটি উট অপেক্ষা উত্তম। অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা অনুপাতে উটের সংখ্যা অপেক্ষা উত্তম।                       (সহীহ মুসলিম)

১২.কুরআন তিলাওয়াত ঈমান বৃদ্ধি করে

কুরআন তিলাওয়াত বানাদাহর জন্য এমন উপকারী যে, তা তিলাওয়াত করলে ঈমান বৃৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে’।                (আনফাল-৫ আয়াত : ২)

১৩.কুরআনের ধারক-বাহক ঈর্ষণীয় ব্যক্তি

কোন ব্যক্তি কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে তার হক আদায় করে তেলাওয়াত করলে তার সাথে ঈর্ষা বা তার মত হয়ার আকাঙ্খা করা যাবে। ‘একমাত্র দুই ব্যক্তির উপর ঈর্ষা করা যায়। (ক) এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহতায়ালা কোরআনের ইলম দান করেছেন, সে দিবা-রাত্রি ঐ কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত থাকে। (খ) দ্বিতীয় সে ব্যক্তি, যাকে আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদ দান করেছেন। সে তা দিনরাত (বৈধ কাজে) খরচ করে’। (সহীহ  আল বুখারী)

কুরআন শিক্ষার জন্য করণীয়

১.ভাল শিক্ষকের কাছে কুরআন পড়া

আমাদের সবার জন্য জরুরি কুরআন শিক্ষা করা। এমন শিক্ষকের কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষা করা যিনি বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে জানেন। তার নিকট কুরআন শিক্ষা করতে হবে। অতএব যিনি নিজে কুরআন শিখবেন বা আপন সন্তানাদিকে শেখাবেন তার কর্তব্য হলো একজন ভালো ক্বারী সাহেবের শরণাপন্ন হওয়া। যাতে বিশুদ্ধভাবে এবং সুন্দর পদ্ধতিতে কুরআন শেখা যায়। মনে রাখতে হবে যে আল্লাহতায়ালার পবিত্র কালাম সবচে বেশি গুরুত্ব ও যতেœর দাবিদার। ইদানীং অনেককেই দেখা যায় আরবী পড়ান। অথচ তিনি নিজেও শুদ্ধভাবে আরবী পড়তে জানেন না। মহিলাদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

মদ-গুন্না কিছুই জানা নেই, মাসআলা-মাসায়েল জানা নেই। অথচ দিব্যি কুরআনের ওস্তাদি করে যাচ্ছেন। আপনার সন্তানকে এদের হাতে তুলে দেবেন না। যদি বাংলা-ইংরেজি শেখার জন্য ভালো মাস্টারের দরকার হয়, তাহলে আল্লাহর কিতাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার জন্য তো আরও ভালো ওস্তাদের প্রয়োজন। দুনিয়ার শিক্ষার বেলায় গুরুত্ব দেই অথচ আখিরাতের শিক্ষার বেলায় অবহেলা করি- এটা তো ঈমানের দাবি হতে পারে না। যে আল্লাহ আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখার মতো বুদ্ধি ও মেধা দিলেন তাঁর কিতাব পড়ার ব্যাপারে এমন অবহেলা কি চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক নয়? আমাদের চিন্তা করা উচিৎ, তিনি যদি আমাকে বা আমার সন্তানকে পাগল বানিয়ে দেন তাহলে কী অবস্থা হবে?

আমাদের স্কুলগুলোতে নামকাওয়াস্তে একজন করে আরবী শিক্ষক রাখা হয় ঠিক; কিন্তু আরবী বিষয়কে করা হয় চরম অবহেলা। সাধারণ শিক্ষার টিচার নিয়োগ, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের জন্য রাষ্ট্র কত ব্যবস্থা আর উদ্যোগ নেয়। অথচ কুরআন শিক্ষা ও কুরআনের শিক্ষা নিয়ে আমাদের সরকার বা স্কুল কর্তৃপক্ষের যেন কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। বৃটিশ আমল থেকে যেনতেন একজন ধর্মীয় শিক্ষক রাখার নিয়ম চলে আসছে, তা রক্ষা হলেই চলে। স্কুলে এই আরবী শিক্ষককে কোনো দামই দেয়া হয় না। তাঁর পরামর্শ ও পরিকল্পনার প্রতি ভ্রুক্ষেপই করা হয় না। ব্যস, বার্ষিক মিলাদ-মাহফিলের সময় শুধু তাঁকে সামনে এগিয়ে দেয়া হয়।

সত্যি কথা বলতে কী, কুরআন ও কুরআনের শিক্ষার প্রতি এই ঔদাসীন্যের কারণেই সমাজে শিক্ষিতের হার বাড়ছে ঠিক; কিন্তু নীতিবান ও আদর্শ দেশ  প্রেমিকের সংখ্যা বাড়ছে না। সমাজের প্রতি শাখায়, প্রতিটি পরিবারে শিক্ষিত সন্তানদের নিয়েও বিপদে দিন গুজরান করছেন অসহায় অভিভাবকরা। আল্লাহ মাফ করুন, আমরা অভিভাবকদের বুঝতে হবে কুরআনের প্রতি আমাদের অনাদরের কারণেই আমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষ হচ্ছে না।

প্রতিটি মুসলিম সরকারের আমাদের কাছে আবেদন, তারা যেন প্রতিটি শিশুর জন্য কুরআনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। প্রতিটি শিশুকে কুরআনের আলোয় বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেন। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে এবং মসজিদে মসজিদে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

২.নিয়মিত কুরআন পড়া

সহীহভাবে কুরআন শিক্ষার জন্য নিয়মিত সময় দেয়া দরকার। যদিও কম সময় হয়। প্রতিদিন  শিখার মধ্যে থাকলে সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা সহজ হবে এবং যা শেখা হবে তা আয়ত্ত্বে থাকবে।

৩.কুরআন মশক করা

কোন যোগ্য শিক্ষকের কাছে মশক করলে পড়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। মশক হলো-শিক্ষক পড়বে তারপর সভাবে ছাত্রও পড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন সিডির মাধ্যমেও মশক করা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী মানশাওয়াভীর কুরআন প্রশিক্ষণ সিডির সহযোগিতা নেল যেতে পারে।

৪.পরিবার পরিজন ও সন্তানদের  শিক্ষা দেয়া

প্রত্যেক মুসলিমকে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কুরআনে এসেছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’। (তাহরীম-৬৬ আয়াত : ৬)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কুরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কুরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। (সহীহ আল বুখারী, ইবন বাত্তাল)

৫.ফযীলাতপূর্ণ সূরাগুলো বেশী বেশী করা

ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীলংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীলংশ কিভাবে পড়বো তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য’।             (সহীহ আল বুখারী)

অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও  বশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা হা-মিম-আস সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মূলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।

কুরআন শিক্ষা না করার পরিনতি

১.রাসূলের অভিযোগ পেশ

কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহতায়ালার অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতের জন্য শাফায়াত চাইবেন। কিন্তু যারা কুরআন শিক্ষা করেনি, কুরআনের যেসব হক রয়েছে তা আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ পেশ করবেন। কুরআনে এসেছে : ‘আর রাসূল বলবেন, হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’ (ফুরকান-২৫ আয়াত : ৩০)। ইবনে কাসীর বলেন, কুরআন না পড়া, তা অনুসারে আমল না করা, তা থেকে হেদায়াত গ্রহণ না করা, এ সবই কুরআন পরিত্যাগ করার শামিল।

২.কিয়ামতে অন্ধ হয়ে উঠবে

যে কুরআন শিখা থেকে থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আলকুরআনে এসেছে, আর যে আমার যিকির (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, নিশ্চয় তাঁর জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থয় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন ? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন? তিনি বলবেন, অনুরুপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অত :পর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’। (তোয়াহা-২০ আয়াত : ১২৪-১২৬)

৩.মূক,বধির অবস্থায় ঊঠবে

সবচেয়ে বড় হেদায়েত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতেরদিন মূক ও বধির হয়ে উঠবে। আলকুরআনে এসেছে : আমি কিয়ামতেরদিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব। (বনি ঈসরাইল-১৭ আয়াত : ৯৭)

৪.গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত

কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। কুরআনে এসেছে, ‘এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট এরাই হলো গাফেল’। (আরাফ-৭ আয়াত : ১৭৯)

৫.কুরআন দলিল হিসাবে আসবে

কুরআন শিক্ষা থেকে বিরত থাকার কারণে কুরআন তার বিপক্ষের দলিল হিসাবে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলীল। (সহীহ মুসলিম)

৬.জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে

জাহান্নামের মত ভয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। রাসূল কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’। (ইবনে হিববান)

৭.আখেরাতে জবাবদিহী করতে হবে

কুরআন শিক্ষায় যথাযথ ভুমিকা পালন না করলে এ বিষয়ে আখেরাতে জবাবদিহী করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয় এ কুরআন তোমার জন্য এবং তোমার কওমের জন্য উপদেশ। আর অচিরেই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। (যুখরুফ-৪৩ আয়াত : ৪৪)

কুরআনের প্রতি যতœবান হওয়া এবং কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণার আহ্বান

আলহামদুলিল্লাহ আমরা যারা কুরআন শিখেছি, যারা কুরআন পড়তে পারি, তাদের উচিত কুরআনের প্রতি যতœবান হও। মনোযোগসহ বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। বিনয় ও আদবের সাথে চিন্তা-গবেষণার মানসিকতা নিয়ে  তিলাওয়াত  করা। আমরা নিশ্চয় জানি  কী বিপুল সওয়াব এ তিলাওয়াতে! রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত পড়বে, তার জন্য একটি নেকী লেখা হবে। আর নেকীটিকে করা হবে দশগুণ। আমি বলছি না م ل ا (আলিফ লাম মীম) একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ।’ সুবহানাল্লাহ!

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘আল্লাহর বাণী (কুরআন) নিয়ে চিন্তা করুন। আপনি এমন এক বাদশাহকে পাবেন, সবই যার রাজত্ব এবং যাবতীয় প্রশংসাও তাঁর। প্রতিটি বিষয়ের গুরুদায়িত্ব তাঁর হাতে। তিনি তাঁর বান্দাদের উপদেশ দেন। যাতে তাদের সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য নিহিত তাদেরকে তার সন্ধান দেন। তাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। তাদেরকে সতর্ক করেন সেসব কাজ থেকে যাতে তাদের ধ্বংস ও অকল্যাণ রয়েছে। তিনি তাদের কাছে যাবতীয় গুণাবলি ও নামসহ নিজের পরিচয় তুলে ধরেন। কুরআন স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের ওপর আল্লাহর নেয়ামত সমূহের কথা। আমাদের দায়িত্ব ও জীবনের লক্ষ্যের কথা। আমাদের জন্য নেক কাজের পুরস্কার স্বরূপ যেসব নেয়ামত বেহেশতে রেখেছেন তার কথা। অবাধ্য হলে যেসব শাস্তি রেখেছেন তার কথা। তাঁর বন্ধুদের সুপরিণাম ও শক্রদের কুপরিণতি সম্পর্কে কুরআন আমাদের সংবাদ দেয়। কুরআন আমাদের জন্য উপমা পেশ করে। দলিল ও ইতিহাস তুলে ধরে। আমাদেরকে শান্তির ঠিকানার দিকে আহ্বান জানায় এবং এর গুণাবলি ও উপকারিতা মনে করিয়ে দেয়। সতর্ক করে শাস্তির ঠিকানা ও তার আজাব থেকে। তাঁর বান্দাদের চোখে আগুল দিয়ে দেখিয়ে নিজের দৈন্যতা ও অসহায়ত্বের করুণ চিত্র। বোধে আঘাত করে উপলব্ধিতে আনে তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া এক মুহূর্তও আমরা চলতে পারব না। অতএব কুরআন পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের অন্তর যখন দেখবে যে তিনি এমন রাজা, যিনি মহাপরাক্রমশালী, দললু, দাতা ও চিরসুন্দর, তখন সে আর তাঁকে ভুলে থাকতে পারবে না। তাঁর নির্দেশ অমান্য করতে পারবে না।’ সুতরাং কুরআন আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করে। তাই মুসলমানদের উচিত ভালোভাবে কুরআন শিক্ষা করা এবং বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। কুরআনে রয়েছে আলো, আরোগ্য, রহমত, সুবাস, হিদায়াত, আল্লাহর যিকির এবং তাঁর প্রমাণ।

কুরআন শিক্ষাকারীর পিতার প্রতি প্রতিদান

১.রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, শিক্ষা করবে ও তদানুযায়ী আমল করবে; তার পিতা-মাতাকে দু’টি পোশাক পরিধান করান হবে, যা দুনিয়ার সকল বস্তুর চেয়ে অধিক মূল্যবান। তারা বলবে, কোন আমলের কারণে আমাদেরকে এত মূল্যবান পোশাক পরানো হয়েছে? বলা হবে, তোমাদের সন্তানের কুরআন গ্রহণ করার কারণে। (হাকেম)

২.হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহতায়ালা  ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যায়নে নিয়োজিত থাকায় আমার নিকট কিছু চাওয়ার সময় পায় না তাকে আমি ঐ ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত দান করবো যে আমার কাছে চায়। কুরআন অধ্যয়নকারীর অন্তরের ইচ্ছাগুলো চাওয়া ছাড়াই পূরণ করে দেই। সমগ্র সৃষ্টির ওপর আল্লাহর যেমন শ্রেষ্ঠত্ব তেমনি দুনিয়ার অন্যসব বাণীর ওপর আল্লাহর কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব।” (জামে আত তিরমিযী)

৩.যে ব্যক্তি কুরআন পাক অধ্যায়ন করবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে কেয়ামতের দিন তার পিতা-মাতাকে এমন মুকুট পরিধান করানো হবে যার জ্যোতি সূর্যের (আলো) জ্যোতির চেয়েও উজ্জল হবে।

পরকালে কুরআন সুপারিশ করবে

১.রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা কিয়ামত দিবসে কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। (সহীহ মুসলিম)

২.অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহ কাছে সুপারিশ করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাকেম)

৩.জাহান্নামের মত বয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। রাসূল কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’। (ইবনে হিববান)

৪.রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, শিক্ষা করবে ও তদানুযায়ী আমল করবে; তার পিতা-মাতাকে দু’টি পোশাক পরিধান করান হবে, যা দুনিয়ার সকল বস্তুর চেয়ে অধিক মূল্যবান। তারা বলবে, কোন আমলের কারণে আমাদেরকে এত মূল্যবান পোশাক পরানো হয়েছে? বলা হবে, তোমাদের সন্তানের কুরআন গ্রহণ করার কারণে। (হাকেম)

কুরআন তিলাওয়াত,অধ্যয়ন এবং কুরআন নিয়ে আলোচনা

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোনো সম্প্রদায় যদি আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং তা পরস্পরে শিক্ষা লাভ করে, তবে তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে। আল্লাহ তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন। (সহীহ মুসলিম)

কুরআনের বিশেষ বিশেষ সূরার ফযীলত

কুরআনের যেসব সূরা ও আয়াতের কথা সহীহ হাদিসে বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত হয়েছে, সেযসব সূরা ও আয়াতের উপস্থাপন করা হল। প্রত্যেক বছর রমযান মাসে জিব্রীল আলাইহিস সালাম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একবার পুরো কুরআন খতম করতেন। আর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের বছর দু’ বার পুরো কুরআন খতম করেন। যাতে কুরআন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে স্থায়ী ও স্থিরভাবে বদ্ধ মূল হয়ে যায়। উলামায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন রমযান ও রমযান ছাড়া অন্য মাসে কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। ইমাম যুহরি রাদিয়াল্লাহু আনহু রমযান মাস আগমন করলে বলতেন, এটা কুরআন তিলাওয়াতের মাস এবং খাদ্য দানের মাস। রমযান মাসে ইমাম মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু হাদিস পাঠ ও এলমি আসর পরিত্যাগ করতেন এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতেন। কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করতেন। রমজানে প্রতি ৩ দিনে একবার খতম করতেন এবং রমযানের  শেষ দশকে প্রতি দিন এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কুরআন আমাদের উপর আল্লাহ নিয়ামত। এই নিয়ামতের শুকর হিসেবে আমাদের বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিৎ। সকল নেককারদের অনুসরণ করা উচিত। মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য দিন রাতের সদ্ব্যবহার করুন। কারণ, আয়ু খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ! আমাদের এমন তিলাওয়াতের তওফিক দান করুন, যাতে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হই। কুরআনকে আমাদের জন্য সুপথ ও সহজ-সরল নির্ভেজাল পথ প্রদর্শক রূপে বানিয়ে দিন। কুরআনের রশ্মি ও আলোর মাধ্যমে আমাদেরকে বক্রতা, পথভ্রষ্টতা ও অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিময় আলোর সন্ধান দিন। এ কুরআনের মাধ্যমে আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করুন। আমাদেরকে গোপনীয় দোষ-ক্রটি ও অপরের দোষ চর্চা করা থেকে বিরত রাখুন এবং আমাদের যাবতীয় গোপনীয় গুনাহ গোপন রাখুন। হে পরম করুণাময় ও দয়ালু প্রভু! আমাদের পিতা-মাতা ও শান্তি প্রিয় সকল মুসলমানকে ক্ষমা করুন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ও তার পরিবারসহ সকল সাহাবী ও অনুসরণকারীদের উপর।

১.সূরা ফাতিহার ফযীলত

ক) হযরত বগভীর রহ. নিজেস্ব সনদে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছেন মহান  আল্লাহতায়ালা বলেন যে, ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা আল-ইমরানের শাহিদাল্লাহু আয়াত শেষ পর্যন্ত এবং কুলিল্লাহুম্মা আয়াত বিগাইরি হিসাব পর্যন্ত পাঠ করে আমি তার ঠিকানা জান্নাতে দিবো, তাকে আমার নিকট স্থান দিবো, দৈনিক সত্তরটি প্রয়োজন মিটাবো, শক্রর কবল থেকে আশ্রয় দিবো এবং শক্রর বিরুদ্ধে তাকে জয়ী করবো। (তাফসীরে মা’আরেফূল ক্বোরআন- অনুবাদ দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা-৪৫)

খ) তাবেয়ী হযরত আবদুল মালেক রহ. ইবনে উমায়ের মুরসালরূপে বর্ণনা করেন যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সূরা ফাতেহায় (শারীরিক ও মানসিক) সব রোগের আরোগ্য রয়েছে। (আদ-দায়েমী ও সুনানে বায়হাকী)

গ) হযরত আবু সাইদ রাফে’ ইবনে মুআল্লা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “মসজিদ থেকে বের হবার পূর্বেই তোমাকে কি কুরআনের সব চেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব না?” এই সাথে তিনি আমার হাত ধরলেন। অতঃপর যখন আমরা বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম, তখন আমি নিবেদন করলাম, “ইয়া রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! আপনি যে আমাকে বললেন তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সব চেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব?’ সুতরাং তিনি বললেন,          “(তা হচ্ছে) ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ (সূরা ফাতেহা)। এটি হচ্ছে ‘সাবউ মাসানি (অর্থাৎ নামাযে বারংবার পঠিতব্য সপ্ত আয়াত) এবং মহা কুরআন; যা আমাকে দান করা হয়েছে”। (সহীর আল বুখারি)

ঘ) সাহাবী হযরত আবু সাইদ ইবনে মুআল্লা বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন :“আমি তোমাকে কুরআনের একটি সুমহান সূরা শিখাব। সেটা হলো সূরা আল ফাতেহা। যার প্রথমাংশ আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। এটা সাবউল মাসানী বা সাতটি প্রশংসাযুক্ত আয়াত এবং এক মহান কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (সহীহ বুখারী) সম্ভবত এ সব ফযীলতের কারণে সূরা ফাতেহার সালাতের মধ্যে পাঠ করা ওয়াজিব।

ঙ) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল, কিন্তু সূরা ফাতেহা পাঠ করল না, তার সালাত ক্রটিপূর্ণ। তিনি কথাটি তিনবার বলেছেন।” তখন হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞাসা করা হল, আমরা তো ইমামের পিছনে থাকি ? তিনি বললেন, মনে মনে পড়বে।”

চ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত : হযরত জিব্রীল আলাইহিস সালম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থাকা অবস্থায় বলেন, দেখুন, এটা আকাশের একটি দরজা যা এই মাত্র খোলা হল। ইতিপূর্বে কখনো তা খোলা হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ঐ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা রাসূলের নিকট এসে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যা আপনার পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি।  সেটা হল, সূরা ফাতেহা ও সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোর সুসংবাদ। আপনি এ দু’টো তিলাওয়াত করে যে কোন হরফ দ্বারা যা চাইবেন, তা আপনাকে দেয়া হবে।

২.সূরা বাকারা ও সূরায়ে আলে-ইমরানের ফযীলত

ক) হযরত আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন আমি রাবূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আল কুরআন পাঠ করো, এটা এর পাঠকারীর জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশকারীরূপে আসবে। বিশেষত এর দু’টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নূরানী সূরা ‘বাকারা’ ও সূরা ‘আল ইমরান’ পাঠ করবে কিয়ামতের দিন এ দু’টি সূরাও এর পাঠকারীদের নিজের ছায়াতলে নিয়ে এমনভাবে হাজির হবে, যেমন দু’টি মেঘমালা অথবা দু’টি চাঁদোয়া বা সারিবদ্ধ পাখিদের পক্ষে ওকালতি করবে। বাতিলপন্থী লোকেরা সে শক্তি রাখে না, তারা এর থেকে কোনো রবকত পাবে না।     (সহীহ মুসলিম)

খ) হযরত নাওয়াস ইবনে সাময়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি হযরত রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি ‘কিয়ামতের দিন আল-কুরআন এবং যেসব কুরআন ওয়ালাদের হাজির করা হবে যারা এর ওপর আমল করতো। প্রথম দিকে সূরা বাকারা ও সূরা আল ইমরান (এর আমল) অগ্ররূপে থাকবে। মনে হবে যেন সূরা দু’টি মেঘমালা অথবা দু’টি কালো রঙের চাঁদায়ো, এতে  নূরের চমক বা প্রবা রয়েছে অথবা এ দু’টি যেন সারিবদ্ধভাবে উড়ন্ত পাখির দু’টি ডানা। আর তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের জন্য ওকালতি করবে। (সহীহ মুসলিম)

গ) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে, হযরত সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জিনিসের একটি চূড়া বা শিখর থাকে। আর আল-কুরআনের শিখর হচ্ছে সূরা বাকারা। এর একটি আয়াত আল-কুরআনের সমস্ত আয়াতের সর্দার, আর তা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী। (জামে আত তিরমিযি)

ঘ) হযরত মা’কেল ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছে, রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সূরা বাকারা আল কুরআনের সর্বেচ্চ চূড়। এর প্রত্যেক আয়াতে সাথে আশিজন করে ফেরেশতা নেমে এসেছিলো। এর ২৫৫ নম্বর আয়াকে (আয়তুল কুরসী) যার প্রথমাংশ ‘আল্লাহ তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিন চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী, আরশের নিচ থেকে বের করে এনে এটিকে সূরা বাকারতে যুক্ত করা হয়েছে। আর সূরা ইয়াসীন আল-কুরআনের হৃদয়। আল্লাহর  সন্তষ্টি ও আখিরাতের মুক্তি কামনা করে কেউ এ সূরা পাঠ করলে তার গুনাহ অবশ্যই ক্ষমা করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ. সুনানে আবুদ দাউদ, আন নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ)

ঙ) হযরত নো’মান ইবনে বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু  বর্ণনা করেন যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার দু’হাজার বছর আগে একটি কিতাব লেখেন। সেই কিতাবটি থেকে দু’টি আয়াত নাযিল করেছেন। আর সেই আয়াত দু’টি হলো সূরা বাকারার শে দু’টি আয়াত। কোনো বাড়িতে তা তিনদিন পড়া হলেই সেখান থেকে শয়তান পালিয়ে যায়। (জামে আত তিরমিযি)

চ) রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :“তোমরা দু’টি যাহরাবীন তথা পুষ্প পাঠ কর, যথা সূরা আল-বাকারা ও সূরা আলে ইমরান। কারণ এ দু’টি সূরা কেয়ামতের দিন মেঘমালার মত অথবা দু’দয়াপাখির ঝাঁকের ন্যায় সারিবদ্ধভাবে উড়বে। এরা উভয়ে পাঠকের পক্ষ গ্রহণ করবে। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ কর। কারণ তার পাঠ করা বরকতের কারণ, তার পাঠ ত্যাগ করা হতাশা। অলসরা তা করতে পারবে না। হযরত মুআবিয়া বলেন, আমার শ্রুত হয়েছে যে, বাতালার অর্থ জাদু।”(সহীহ মুসলিম)

ছ) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “ঘরে সূরা আল-বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না।” শয়তান ঘরে প্রবেশ না করার কারণ হচ্ছে তাতে আয়াতুল কুরসী রয়েছে। (সহীহ মুসলিম)

জ) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বললেন, একদা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসে ছিলেন। এমন সময় উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি (জিব্রাইল) মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজ খোলা হল। ইতোপূর্বে এটা কখনও খোলা হয় নাই। ওদিক দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতির্ণ হল। এই ফেরেশতা যে দুনিয়াতে অবতরণ করেছে, ইতোপূর্বে কখনও অবতরণ করেনি। সুতরাং তিনি এসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘‘আপনি দুটি জ্যোতির সুসংবাদ নিন। যা আপনার আগে কোন রাসূলকে দেওয়া হই নাই। (সে দুটি হচ্ছে) সূরা ফাতেহা ও সূরা বাক্কারার শেষ আয়াতসমূহ। আপনি এ দুটো তিলাওয়াত করে যে কোন হরফ দ্বারা যা চাইবেন, তা আপনাকে দেয়া হবে।” (সহীহ মুসলিম)

ঝ) হযরত আবু মাসাঊদ বদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য  সেই দু’টি যথেষ্ট হবে’। (সহীহ আল বুখারী)            বলা হয়েছে যে, সে রাতে অপ্রীতিকর জিনিসের মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে। অথবা তাহাজ্জুদের নামায থেকে যথেষ্ট হবে।

ঞ) হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলোকে কবরে পরিণত করো না। কেননা, যে বাড়িতে সূরা বাক্কারা পাঠ করা হয়,  সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে’। (সহীহ মুসলিম) (অর্থাৎ সুন্নত ও নফল নামায তথা পবিত্র কুরআন পড়া ত্যাগ করে ঘরকে কবর বানিয়ে দিয়ো না। যেহেতু কবরে এ সব বৈধ নয়)।

ট) হযরত আবু মাসাঊদ বদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য সেই দু’টি যথেষ্ট হবে’। (সহীহ আল বুখারী) বলা হয়েছে যে, সে রাতে অপ্রীতিকর জিনিসের মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে। অথবা তাহাজ্জুদের নামায থেকে যথেষ্ট হবে। (অর্থাৎ সুন্নত ও নফল নামায তথা পবিত্র কুরআন পড়া ত্যাগ ক’রে ঘরকে কবর বানিয়ে দিয়ো না। যেহেতু কবরে এ সব বৈধ নয়)।

ঠ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাউস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি সূরা বাকারা দশটি আয়াত অতি ভোরবেলায় পাঠ করে, তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান তার নিকটবর্তী হতে পারে না। সন্ধ্যায় সময় পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত তার নিকট শয়তান যেতে পারে না। তার জান মাল ও ইজ্জত-সম্মান নিরাপদে থাকবে, কোন প্রকার ক্ষতি তার হবে না।                   (সুনানে আদ-দারেমী)

ড) তাবরানী কিতাবে বর্ণিত আছে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা বাকারার দশটি আয়াত অর্থাৎ সুরার প্রথম চার আয়াত, আয়তুল কুরসী ও পরের দুই আয়াত আর সূরার সর্বশেষ তিনটি আয়াত তেলাওয়াত করবে, সকাল পর্যন্ত তার ঘরে শয়তান প্রবেশ করতে পারবে না।

ঢ) হযরত আবু মাসউদ আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সূরা বাকারার শেস দুই আয়াত, যে  তা রাতে পড়বে, তার জন্য তা যথেষ্ট হবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

ন) হাবেয়ী হযরত আয়ফা বিন আবদিল কালায়ী রহ. বলেন, এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল-কুরআনের কোন সূরা অধিক মর্যাদাবান? তিনি বলেন, ‘কুহুওয়াল্লাহু আহাদ’। সে পুনারয় জিজ্ঞেস করলো, আল কুরআনের কোন আয়াত অধিকতর মর্যাদাবান? তিনি বললেন, ‘আয়াতুল কুরসী’। আল্লাহ লা-ইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইউল কাইউম। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ আল-কুরআনের কোন আয়াত এমন যার বরকতে আপনার এবং আপনার উম্মতের প্রতি পৌঁছতে ভালোবাসেন। তিনি বললেন, সূরা বাকারার শেষ আয়াত। আল্লাহতায়ালা তাঁর আরশের নিচের ভান্ডার হতে তা এই ইম্মতকে দান করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতের এমন কোনো কল্যাণ নেই যা এতে নেই। (সুনানে আদ-দারমী)

ত) হযরত উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন যে, ব্যক্তি রাতে সূরা আল ইমরানের শেষের দিকের আয়াতগুলো পড়বে তার জন্য পুরো রাত নামাযে কাটানোর সওয়াব লেখা হবে। (সুনানে আদ-দারমী, মিশকাত)

তাবেয়ী হযরত মাকহুল রহ. বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমুয়ার দিন সূরা আল ইমরান পড়বে, ফেরেশতারা তার জন্য রাত পর্যন্ত দোয়া করতে থাকবেন। (আদ-দারমী)

থ) তাবেয়ী হযরত যোবায়ের ইবনে নোফায়ের রহ. বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারাকে এমন দু’টি আয়াত দ্বারা সমাপ্ত করেছেন যা  আমাকে আল্লাহর আরশের নিচে ভান্ডার থেকে দান করা হয়েছে। সূতরাং তা শিক্ষা করবে এবং তোমাদের নারীদেরকে শিক্ষা দিবে। কেননা, এতে রয়েছে ক্ষমা প্রার্থনা, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় ও দোয়া। ( সুনানে আদ-দারেমী)

দ) হযরত আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে সূরা মু’মিনের হা-মীম হতে ইলাইহিন মাছির পর্যন্ত (আয়াত : ১-৩) এবং আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে বিকাল পর্যন্ত এর কারণে তাকে নিরাপদ রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি বিকালে তা পাঠ করে সকাল পর্যন্ত এর কারণে তাকে হিফাযত করা হবে। ( জামে আত তিরমিযি ও আদ-দারেমী)

ধ) হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এসব আয়াত সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে আল্লাহতায়ালা তার ইহকাল-পরকালের সমুদয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে জামিনদার হবেন। (সুনানে আবু দাউদ)

আয়াতুল কুরসী পড়ার ফযীলত

ক) হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি এই কাঠের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেছেন : যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর আয়তুল কুরসি পড়বে তার বেহেশতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ব্যতীত আর কোন বাধা নেই। আর যে ব্যক্তি শয়ন কালে এই আয়াতুল কুরসি পড়বে আল্লাহতায়ালা তার ঘর, তার প্রতিবেশীর ঘর এবং আশে পাশের আরও কিছু সংখ্যক ঘরকে নিরাপদে রাখবেন। (মেশকাত শরীফ)

খ) হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আবু মুনযির! তুমি কি জান, মহান আল্লাহর গ্রন্থ (আল-কুরাআন) এর ভিতর তোমার যা মুখস্থ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় (মর্যাদাপূর্ণ) আয়াত কোনটি?’ আমি বললাম, ‘সেটা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী’। সুতরাং তিনি আমার বুকে চাপর মেরে বললেন, ‘আবুল মুনযির!  তোমার জ্ঞান তোমাকে ধন্য করুক’। (সহীহ মুসলিম)

(অর্থাৎ তুমি, নিজ জ্ঞানের বরর্কতে উক্ত আয়াতটির সন্ধান পেয়েছ, সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।)

গ) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বললেন : (একবার) রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানের যাকাত (ফিৎরার মাল-ধন) দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। বস্তুতঃ (আমি পাহারা দিচ্ছিলাম ইত্যবসরে) একজন আগমনকারী এসে আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরলাম এবং বললাম, ‘তোকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পেশ করব’; সে আবেদন করল, আমি একজন সত্যিকারের অভাবী। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার উপর, আমার দারুন অভাব’; কাজেই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে (রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাযির হলাম); রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবু হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচারন করেছে’? আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে তার অভাব ও (অসহায়) পরিবার-সন্তানের অভিযোগ জানাল। সুতরাং তার প্রতি আমার দয়াহলে আমি তাকে  ছেড়ে দিলাম’; তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’। আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আনুরুপ উক্তি শুনে সুনিশ্চিত হলাম যে, সে আবার আসবে। কাজেই আমি তার প্রতীক্ষায় থাকলাম। সে (পুর্ববৎ) এসে আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি বললাম, ‘অবশ্যই তোকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে পেশ করব’; সে বলল, ‘আমি অভাবী,পরিবারের দায়ত্ব আমার উপর, (আমাকে ছেড়ে দাও) আমি আর আসব না’; সুতরাং আমার মনে দয়া হল। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে উঠে (যখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে গেলাম তখন) রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘‘আবু হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচারণ করেছে’? আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! সে তার অভাব ও অসহায় সন্তানের-পরিবারের অভিযোগ জানাল। সুতরাং আমার মনে দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’; তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’। সুতরাং তৃতীয়বার তার প্রতীক্ষায় রইলাম। সে (এসে) আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরে বললাম ‘‘এবারে  তাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাযির করবই’; এটা তিনবারের মধ্যে শেষবার। ‘ফিরে আসবো না’ বলে তুই আবার ফিরে এসেছিস’’; সে বলল ‘তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কতকগুলি শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন’; আমি বললাম ‘সেগুলি কী?’ সে বলল, ‘যখন তুমি (ঘুমাবার জন্য) বিছানাই যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করে (ঘুমাবে); তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত হবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’। সুতরাং আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আবার সকালে (রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম); তিনি আমাকে বললেন, ‘‘তোমার বন্দী কী আচারণ করেছে?’’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে বলল, ‘‘আমি তোমাকে এমন কতিপয় শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ আমার কল্যাণ করবেন’’; বিধায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’; তিনি বললেন ‘‘সে শব্দগুলি কী?’’ আমি বললাম, ‘সে আমাকে বলল, ‘‘যখন তুমি বিছানাই (শোয়ার জন্য) যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুলল হাইয়্যুল কাইয়্যুম’ পড়ে নেবে’’; সে আমাকে আর বলল, “তার কারনে আল্লাহর তরফ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’’। (এ কথা শুনে) তিনি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘শোনো ! সে নিজে ভীষণ মিথ্যাবাদী; কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলেছে। হে আবু হুরায়রা! তুমি জান, তিন রাত ধরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’’ আমি বললাম, ‘জী না’; তিনি বললেন, ‘‘সে ছিল শয়তান’’। (সহীহ আল বুখারী)

ঘ) হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আবু মুনযির! তুমি কি জান, মহান আল্লাহর গ্রন্থ (আল-কুরাআন) এর ভিতর তেমার যা মুখস্থ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় (মর্যাদাপূর্ণ) আয়াত কোনটি? আমি বললাম, ‘সেটা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী’। সুতরাং তিনি আমার বুকে চাপর মেরে বললেন, ‘আবুল মুনযির! তেমার জ্ঞান তোমাকে ধন্য করুক’। (সহীহ মুসলিম)

ঙ) হযরত আবু উমাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনায় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতি ফরয নামাযের পর আয়াতুল করসী পাঠ করলে, সে পাঠকারী মু’মিন মৃত্যুর সাথে সাথেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনানে নাসায় ও তাবরানী)

চ) সহীহ বুখারী এর এক হাদীসে রাসূলে করীম সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমরা রাতে নিদ্রার জন্য বিছানায় যাও, তখন  আয়তুল করসী পড়ে নাও। এরূপ করলে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের  জন্য রক্ষী নিযুক্ত হয়ে যাবে এবং শয়তান তোমাদের কাছে আসতে পারবে না।

ছ) হযরত আবু আইউব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর ‘আয়তুল করসী’ শাহিদাল্লাহ (সূরা আল-ইমরান-৩ আয়াত : ১৮ আয়াত) এবং  কুলিল্লাহুম্মা গাইরি হিসাব পর্যন্ত পাঠ করে আল্লাহতায়ালা তার গুনাহ ক্ষমা করে তাকে জান্নাতে স্থান দিবেন। এছাড়া তার সত্তরটি প্রয়োজন মিটাবেন, এর সর্বনিম্ম প্রয়োজন হবে ‘মাগফিরাত’ (তাফসীরে রূহুল মা’আনী)

জ) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জিনিসের একটি চূড়া বা শিখর থাকে। আর আল-কুরআনের শিখর হচ্ছে সূরা বাকারা। এর একটি আয়াত আল-কুরআনের সমস্ত আয়াতের সর্দার, আর তা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী। (জামে আত তিরমিযি)

সূরা হাশর পড়ার ফযীলত

ক) সূরা হাশরের শেষাংশ প্রত্যেহ সকালে পাঠ করলে ৭০ হাজার ফেরেশতা সন্ধা পর্যন্ত ও  সন্ধায় পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত পাঠকারীর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন ও তার রক্ষণাবেক্ষন করেন। ফলে সকল প্রকার ফায়দা হাসিল হয়। যদি এ সময়ের মধ্যে সে মারা যায়। তবে শহীদি মর্তবা পাবে। এটি একটি উৎকৃষ্ট আমল। তিন বার আউযুবিল্লাহিচ্ছামিইল আলিম হিমিনাশ শায়তানির রাজীম ও একবার বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করে উক্ত আয়াতটি পড়তে হয়।

সূরা ইখলাস পাঠের ফযীলত

ক) হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লোকের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তারা ফিরে এসে রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন : হে আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! যাকে আপনি আমাদের নেতা মনোনিত করেছেন তিনি প্রত্যক নামাজে কিরাআতের শেষে সুরা ইখলাস পাঠ করতেন, রাসূল কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, সে কেন এরুপ করত তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করতো? তাকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, এ সূরায় আল্লাহর রাহমানুর রাহীমের গুণাবলী বর্ণণা করা হয়েছে, এ কারণে এ সুরা পড়তে আমি খুব ভালবাসি। এ কথা শুনে রাসুল বললেন : তাকে জানিয়ে দাও যে,আল্লাহও তাকে ভালবাসেন। (সহীহ বুখারী)

খ) হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নিত, এক ব্যক্তি নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি এই (সূরা) ‘কূল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি। তিনি বললেন, ‘এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে’। (সহীহ আল বুখারী)

গ) হযরত আবু সাইদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।”(সহীহ মুসলিম)

ফযীলতের ক্ষেত্রে সূরায়ে এখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। এ কথার অর্থ এই নয় যে, এ সূরা পুরো কুরআনের মোকাবিলায় যথেষ্ট। কারণ, কোন কিছু ফযীলতের দিক দিয়ে অন্য কোন বিষয়ের সমপর্যায়ের হলে এটা জরুরি নয় যে, এর ফলে অন্যটা না হলেও চলবে। সুতরাং কেউ সালাতে সূরা ফাতেহা  ছেড়ে সূরা এখলাস তিনবার পড়লে তার সালাত শুদ্ধ হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে, হযরত আবু আইউব আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের দোয়ার ফযীলতের ব্যাপারে বলেছেন : যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তার কোন শরিক নেই, সকল রাজত্ব তার, তার জন্য সকল প্রশংসা। এ দোয়া ১০ বার পড়ল, সে যেন ইসমাইল আলাইহিস সালামের সন্তানদের মধ্য থেকে চারজনকে মুক্ত করল।” এ দোয়ার ফযিলত জানার পর কেউ যদি কাফ্ফারার ৪ জন কৃতদাস মুক্ত করার পরিবর্তে এ যিকির করে, তবে তা গ্রহনযোগ্য হবে না। কারণ, এখানে তাকে গোলাম-ই আজাদ করতে হবে।

ঘ.যে ব্যক্তি একবার সূরা ইখলাস পাঠ করবে সেই ব্যক্তি কুরআনুল কারীম এক তৃতীয়াংশ পাঠ করার সওয়াব লাভ করবে।

ঙ.যে ব্যক্তি দশবার পাঠ করবে আল্লাহতায়ালা নিজ কুদরতি হাতে জান্নাতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাশীল একটি মহল তৈরি করবেন।

চ.যে ব্যক্তি অধিক পাঠ করবে আল্লাহতায়ালা আর জন্য জান্নাতে ওয়াজিব করে দিবেন।

ছ. যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণ পাঠ করবে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর লাশ বহন করার জন্য হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এর সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন। সেই ফেরেশতারা তাঁর লাশ বহন করবে এবং জানাযায় শরিক হবে।

সূরা নাস ও সূরা ফালাকের ফযীলত

ক) হযরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :‘তুমি কি দেখনি আজ রাতে অবতীর্ণ হয়েছে এমন কিছু আয়াত, যেরূপ আয়াত আর লক্ষ্য করা যায়নি? তা হল সূরা ফালাক ও সূরা নাস।” (সহীহ মুসলিম)

খ) ইমাম নাসায়ী রহ. বর্ণনা করেন : রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকবা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করার জন্য। তারপর তিনি বললেন, এ দু’টি সূরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ প্রার্থনা করেনি, আর এ দু’টি সূরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেনি।”(সুনানে নাসাঈ)

গ) হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন ‘রাসূলুল্লাহ (সূরা ফালাক্ক ও নাস অবতীর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত নিজ ভাষাতে) জিন ও বদ নজর থেকে (আল্লাহর) আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। পরিশেষে যখন উক্ত সূরা দু’ টি অবতীর্ণ হল, তখন ঐ সূরা দু’টি দ্বারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং অন্যান্য সব পরিহার করলেন’। (জামে আত তিরমিজী)

সূরা ইয়াসিন পড়ার ফযীলত

১.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : প্রত্যেক জিনিষের একটা কলব আছে। সূরা ইয়াসীন কুরআনের কলব। যে উহা একবার পড়বে আল্লাহ তার জন্য দশবার কুরআন পড়ার সওয়াব নির্ধারণ করবেন। (জামে আত তিরমিযি)

২.রাসূল পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সূরা ইয়াসিন কুরআনের হৃৎপি-।’ এ হাদিসে আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য পাঠ করবে তার মাগফিরাত হয়ে যায়। তোমরা তোমাদের মৃতদের জন্য এ সূরা তিলাওয়াত করো।

৩. হযরত মা’কেল ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সুন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। সুতরাং এ সূরাটি মুমূর্ষ লোকের জন্য তেলাওয়াত করো। (সুনানে বায়হাকী-শোয়াবুল ঈমান)

৪.হযরত মা’কেল ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন  আল-কুরআনের “ক্বালব” বা হৃদয় হলো সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তি কামনা করে এই সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে । (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ, আন নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ওহাকীম)

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জিনিসের ‘ক্বালব’ বা হৃদয় থাকে, আল-কুরআনের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসীন পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে দশবার সমগ্র কুরআন পড়ার সওয়াব দান করবেন। (জামে আত তিরমিজি, সুনানে আদ-দারেমী)

৫.হযরত জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতের বেলায় আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের  উদ্দেশ্যে সূর ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। (মালিক, ইবনে সুন্নী ও সহীহ ইবনে হাব্বান)

৬.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণিত হাদীসে আছে, আল্লাহ তার সে রাতের গুনাহ মাফ করবেন।          (বায়হাকী, আদ-দারেমী, তাবরানী ও অন্যন্য)

৭.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহতায়ালা আসমান  এবং যমীন সৃষ্টির এক হাজার বছর পূর্বে সূরা ত্বাহা এবং সূরা ইয়াসীন পাঠ করলেন। তখন ফেরেশতারা তা শুনে বললেন, ধন্য সে জাতি যাদের প্রতি তা নাযিল হবে, ধন্য সেই বক্ষ যে তা ধারণ করবে এবং ধন্য সেই মুখ যে তা উচ্চারণ করবে। (সুনানে আদ-দারেমী)

৮.হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল কুরআনের এমন একটি সূরা আছে যা এর পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং এর শ্রোতাকে মাফ করা হবে, এটাই সূরা ইয়াসীন ( তাফসীরে সূরা ইয়াসীন)

৯.তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে রিবাহ রহ. বলেন, আমার নিকট বিশ্বস্ত সূত্রে কথটি পৌঁছেছে যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দিনের প্রথম দিকে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তার  সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (ইবনে আব্বাসের রাদিয়াল্লাহু আনহু হাদীসে বর্ণিত আছে, সূরা ইয়াসীন কবরের আযাব হতে মুক্তিদাতা। (জামে আত তিরমিজি)

৯.হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি ভোরে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার যাবতীয় কাজ সহজ করে দেয়া হবে।, আর সে সন্ধা রবলায় তা পাঠ করবে ভোর পর্যন্ত তার সাব কাজ সহজ করে দেয়া হবে। (সুনানে আদ-দারেমী)

১০.হযরত আবু বকার সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনায় রাসূল রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমুয়া বারে পিতা-মাতা উভয়ের বা এক জনের কবর  যিয়ারত করবে এবং সেখানে সূর ইয়াসীন তেলাওয়াত করবে এতে মৃতের নিকট তো সওয়াব পৌঁছবেই, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকটি অক্ষরের বদলে পাঠকারীর গুনাহ মাফ করবেন। (তাফসীরে সূরা ইয়াসীন)

১১.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূল  সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক রাতে সূরা ইয়াসীন পাঠ। করবে এবং এই অভ্যাসে থেকে মারা যাবে, সে শহীদরূপে গণ্য হবে। (তাবারানী ও অন্যন্য)

১২.বায়হাকী গ্রন্থে উদ্ধৃত একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি এটা  (সূরা ইয়াসীন) পাঠ করে তাকে বিশটি হজ্জের পরিমান সওয়াব দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি তা শ্রবণ করে তাকে মহান আল্লাহর রাস্তায় এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দান করার সওয়াব দেয়া হয়। কেউ তা লেখে ধৌত করে পানি পান করলে তার পেটে এক হাজার রোগের ওষধ রয়েছে, এক হাজার নূর, এক হাজার বিশ্বাস, এক হাজার রবকত, এক হাজার রহমত প্রবেশ করে এবং তার  ভেতরকার যাবতীয় রোগ ও জটিলতা দূর হয়। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে এই মর্মে হাদীস বর্ণিত আছে। এমনও একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে সূরা ইয়াসীন পাঠ করতে থাকবে,তার জন্য জান্নাতের আটটি দরাজ খোলা  রাখা হবে। (তাফসীরে সূরা ইয়াসীন-১৯৬৩)

১৩.অন্য একটি হাদীসে আছে যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সূরা ইয়সীন পাঠ করবে, তার দিন-রাত শান্তিতে কাটবে। তার যতো অভাবই থাকুন, তা দূর হবে এবং সে ধনী ও ঐশ্বর্যশীল হবে। (তাফসীরে সূরা ইয়াসীন)

সূরা তাওবার শেষ দু’ই আয়াত পাঠের পযীলত

হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সূরা তাওবার শেষ দু’টি আয়াত সাতবার করে পাঠ করবে আল্লাহতায়ালা তার সব কাজ সহজ করে দিবেন। (কুরতুবী)

সূরা মূলক পড়ার ফযীলত

ক) হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কুরআনের ত্রিশ আয়াতে একটি সুরা (সূরা মূলক) আছে, যা এক ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। ফলে তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। সূরাটি হচ্ছে তাবারা কাল্লাজি বেইয়াদিহীল মুলক। (আবু দাউদ, জামে আত তিরমিযি, আন নাসায়ী, ইবনে মাযাহ)

সূরা কাহাফ পড়ার ফযীলত

ক) হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্ত করবে, সে দাজ্জালের (ফিৎনা) থেকে পরিএাণ পাবে।’’ অন্য বর্ণনায় ‘কাহাফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে। (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ ও আন নাসায়ী)

খ) হযরত বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি সূরা কাহাফ তেলওয়াত করেন। পাশে একটি ঘোড়া বাধা ছিলো দু’টি রশি দ্বারা। এসময় এক খন্ড মেঘ তাকে ঢেকে নিলো। তা তার নিকট হতে নিকটতর হতে লাগলো আর ঘোড়াটি লাফাতে লাগলো। ভোরে উঠে লোকটি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে উল্লেখ করলো। তিনি বললেন, এটা ছিলো রহমত যা আল-কুরআনের কারণে নেমে এসেছিলো। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

গ) হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি জুমআর দিনে সূরা কাহাফ পড়বে তার ঈমানের নূর এক জুমুয়া হতে অন্য জুমুয়া পর্যন্ত চমকিতে থাকবে।           (সুনানে বায়হাকী-দাওয়াতে কবীর)

ঘ) হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল রাসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ পড়বে তার জন্য ওই সূরা তার  বাসস্থান হতে মক্কা পর্যন্ত একটা নূর বা জ্যোতি কিয়ামত দিবসে অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি এ সূরার শেষ দশ আয়াত পড়বে দাজ্জাল তার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি অযু করে পড়বে সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা লা-ইলাহা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা’ তার নাম খোলা পত্রে লিখিত হবে অতঃপর এতে এমন সীল মার হবে যা কিয়ামত পর্যন্ত ভাঙা হবে না। (হাকিম)

সূরা রূম পাঠের ফযীলত

হযরত আবু দাউদ , তাবারানী, ইবনে সুন্নী প্রমুখ হাদীসের ইমাম হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত করেন যে, সূরা রূম এর ১৭-১৯ আয়অত তিনটি সর্ম্পকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি সকালে তা পাঠ করে তার সারা দিনের আমলের ক্রটিসমূহ এর বরকতে দূর করে দেয়া হবে। (তাফসীরে রূহুল মা’আনী)

কুরআন মাজীদ সযতেœ নিয়মিত পড়া ও তা ভুলে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ

১.আবু মুসা আশারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘এই কুরআনের প্রতি যতœ নাও। (অর্থাৎ, নিয়মিত পড়তে থাকো ও তার চর্চা রাখো।) সেই মহান সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন, উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃতি হয়ে) যায়।” (অর্থাৎ অতি শীঘ্র ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।) (সহীহ মুসলিম)

২.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কুরআন-ওয়ালা হল বাঁধা উট-ওয়ালার মত। সে যদি তা বাঁধার পর তার যথারীতি দেখাশুনা করে, তাহলে বাঁধাই থাকবে। নচেৎ ঢিল দিলেই উট পালিয়ে যাবে।” (সহীহ আল বুখারি)

৩. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে,“মহান আল্লাহ এভাবে উৎকর্ণ হয়ে কোন কথা শুনেন না, যেভাবে সেই মধুরকণ্ঠী পয়গাম্বারের প্রতি উৎকর্ন হয়ে শুনেন, যিনি মধুর কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন মাজীদ পড়তেন।” (সহীহ আল বুখারি) আল্লাহর উৎকর্ন হয়ে শুনার মধ্যে এ কথার ইঈিত রয়েছে যে, তিনি সেই তেলাওয়াতে সন্তুষ্ট হন এবং তা কবুল করেন।

৪. হযরত আবু মুসা আশারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘তোমাদের দাউদের সুললিত কণ্ঠের মত মধুর কণ্ঠ দান করা হয়েছে।” (সহীহ আল বুখারী)।

৫. মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “যদি তুমি আমাকে গত রাতে তোমার তেলাওয়াত শোনা অবস্থায় দেখতে (তাহলে তুমি কতই না খুশী হতে)!”

৬. হযরত বারা’ ইবনে আযব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এশার নামাযে সূরা ‘অততীন অযযাইতুন’ পড়তে শুনেছি। বস্তুতঃ আমি তার চেয়ে মধুর কণ্ঠ আর কারো শুনিনি।” (সহীহ আল বুখারী,সহীহ মুসলিম)

৭. হযরত আবু লুবাবাহ বাশীর ইবনে আব্দুল মুনযির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি মিষ্ট স্বরে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের মধ্যে নয়।” (অর্থাৎ আমাদের তরীকা ও নীতি-আদর্শ বহিভূত)। (আবু দাউদ)

৮. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসাউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘(হে ইবনে মাসাউদ) আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও।” আমি বললাম ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে পড়ে শুনাব, অথচ আপনার উপরে তা অবতীর্ণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, “অপরের মুখ থেকে (কুরাআন পড়া) শুনতে আমি ভালবাসি”। সুতরাং তার সামনে আমি সূরা নিসা পড়তে লাগলাম, পড়তে পড়তে যখন এই (৪১নং) আলতে পৌছালাম…যার অর্থ, “তখন তাদের কি আবস্থা হবে, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং  তোমাকেও তাদের সাক্ষী রূপে উপস্থিত করব?” তখন তিনি বললেন “যথেষ্ট, এখন থাম”। অতঃপর আমি তার দিকে ফিরে দেখি,তার নয়ন যুগল অশ্রু ঝরাচ্ছে। (সহীহ আল বুখারী)

কুরআন  পাঠের জন্য সমবেত হওয়া মুস্তাহাব

হযরত আবু হুরাইরায় রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখনই কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরসমুহের মধ্যে কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর গ্রন্থ (কুরআন) পাঠ করে, তা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অধ্যয়ন করে, তাহলে তাদের প্রতি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং তাদেরকে তাঁর রহমত ঢেকে নেয়, আর ফেরেশতাবর্গ তাদেরকে ঘিরে ফেলেন। আল্লাহ স্বীয়ং তাঁর নিকট ফেরেশতাম-লীর কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন।’’ (সহী মুসলিম) কুরআনের আয়নায় নিজেকে প্রতিবিম্বিত করার মধ্যে কী যে বরকত তা আমরা ভালোভাবেই জানি। তবুও আমরা পিছিয়ে পড়ছি এটি পাঠ বা তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে। ইতিহাস এটা স্বীকৃতি দেয় যে, মাত্র ২৩ বছরে গোটা আরব জাহানের বর্বর একটা জাতিকে কী দ্রুত সভ্যতার আলোয় বদলে দেওয়া হয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল আল-কুরআনের বদৌলতে। কুরআন আল্লাহ বাণী। সৃষ্টিকূলের ওপর যেমন ¯্রষ্টার সম্মান ও মর্যাদা অপরিসীম, তেমনি সকল বাণীর ওপর কুরআনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অতুলনীয়। মানুষের মুখ থেকে যা উচ্চারিত হয়, তার মধ্যে কুরআন পাঠ সর্বাধিক উত্তম।

কুরআন সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আল্লাহতায়ালার

কিয়ামাত পর্যন্ত আল-কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা নিজেই নিয়েছেন। আল-কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টি মূলতঃ আল্লাহর মহান কুদরতের বিশাল নিদর্শন। যে প্রজন্মের মধ্যে কুরআন সরাসরি নাযিল হয়েছে তাদের জন্য এ গ্রন্থ যেমন উপযোগী ও চির আধুনিক ছিল, তাদের পরবর্তী আগত অনাগত সকল প্রজন্মের জন্যও তা চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনাদর্শ। অতএব সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনের শেখা ও শিক্ষাদান, নিয়মিত অধ্যয়নের মাধ্যমে একে সঠিকভাবে বুঝা, উপলব্ধি করা ও যথাযথ গুরুত্বের সাথে সে অনুযায়ী আমল করা সে সব লোকদেরই অনুসৃত নীতি যারা সর্বযুগেই ছিলেন সৎ ও পূণ্যবান। বরং এ হচ্ছে সে ঠিকানা যেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও সফলতা নিহিত। কুরআন যাবতীয় বিকৃতি থেকে মুক্ত। কিয়ামাত পর্যন্ত আল-কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা নিজেই নিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয় আমি উপদেশ বাণী তথা কুরআন নাজিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই’। (হিজর-১৫ আয়াত : ৯) আল-কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টি মূলতঃ আল্লাহর মহান কুদরতের বিশাল নিদর্শন। যে প্রজন্মের মধ্যে কুরআন সরাসরি নাযিল হয়েছে তাদের জন্য এ গ্রন্থ যেমন উপযোগী ও চির আধুনিক ছিল, তাদের পরবর্তী আগত অনাগত সকল প্রজন্মের জন্যও তা চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনাদর্শ। অতএব সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনের শেখা ও শিক্ষাদান, নিয়মিত অধ্যয়নের মাধ্যমে একে সঠিকভাবে বুঝা, উপলব্ধি করা ও যথাযথ গুরুত্বের সাথে সে অনুযায়ী আমল করা সে সব লোকদেরই অনুসৃত নীতি যারা সর্বযুগেই ছিলেন সৎ ও পূণ্যবান। বরং এ হচ্ছে সে ঠিকানা যেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও সফলতা নিহিত।

কুরআন কেন আমাদের বুঝতে হবে

সবযুগেই মুসলিম জনসাধারণ কুরআনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। মহান আল্লাহ ততদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহকে সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ জাতির স্বীকৃতি দেবেন যতদিন তারা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করবে, হিফয করবে, হিফাযত করবে, এর অর্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, এর গূঢ় তত্ত্বব উপলদ্ধি করবে, এর নির্দেশ মেনে চলবে এবং এর নিষেধকৃত সকল কিছু পরিহার করবে। ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বীশেষে সকল জাতির জীবনে এ গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা যেহেতু অপরিসীম, সেহেতু মুসলমানগণ এ গ্রন্থের প্রতি সর্বাধিক যতœ ও গুরুত্ব দিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন জাতির গ্রন্থ এ রকম গুরুত্ব পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেনি। কুরআন কারীমের এ অপরিসীম গুরুত্বের কারণে সারা বিশ্বের মুসলিম মানসে কুরআনের পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন ও কুরআন বুঝার এক অভূতপূর্ব সাড়া ও বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, যেন কুরআন কারীমের এ বিশাল চর্চা থেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিষ্ঠাবান মুসলিম মাত্রই উপকৃত হতে পারে।

১.কুরআন হচ্ছে দ্বীনের সকল জ্ঞানের উৎস এবং মৌলভিত্তির আধার। দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ এর মাধ্যমেই শুধু অর্জিত হয়। কুরআন নাযিল হয়েছে এর বিধান অনুযায়ী আমল করার জন্য। আমলের জন্য বোঝা ও উপলব্ধির প্রয়োজন। না বুঝে আমল করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে অথচ বুঝে না তার উদাহরণ হল-যেমন একদললোকের কাছে তাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটি নির্দেশিকা আসল, যাতে লিখা আছে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না, কিসে তাদের মঙ্গল হবে এবং কিভাবে ভুলপথে চললে শক্র তাদেরকে পাকড়াও করবে, তারা সে নির্দেশিকা মাথায় রেখে খুবই সম্মান দেখাল এবং সুন্দর সূরে তা পড়ল কিন্তু বুঝার চেষ্টা না করে ভুল পথে চলল, ফলে অনিবার্যরুপেই তারা শক্র দ্বারা আক্রান্ত হল।

২.কুরআনের অর্থ না বুঝার মানেই হল দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকা। আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু  আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘‘এটা সে সময় যখন মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে, ফলে তারা তা অর্জন করতে সক্ষম হবে না।’’ তখন যিয়াদ ইবন লাবিদ আল-আনসারী বললেন, কিভাবে জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে অথচ আমরা কুরআন পড়েছি? আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই কুরআন পড়ব, আর আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে কুরআন পড়াব। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘হে যিয়াদ তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক তোমার মৃত্যু হোক) আমি তো তোমাকে মদীনাবাসী ফাকীহদের মধ্যে গণ্য করতাম। এ তাওরাত এবং ইনজিল ইয়াহুদ ও নাসারাদের কাছে আছে। কিন্তু তা তাদের কি কাজে এসেছে?’’ জুবায়ের বললেন, এরপর আমরা উবাদাহ ইবন আস-সামিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, তুমি কি শুনেছ তোমার ভাই আবুদ্দারদা কি বলছে? আর আবুদ্দারদা কি বলেছে তা তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আবুদ্দারদা সত্য বলেছে, তুমি চাইলে আমি তোমার কাছে সে ইলম সম্পর্কে বলব যা সর্বপ্রথম উঠিয়ে নেয়া হবে, তা হল খুশূ ও বিনয়। তুমি হয়ত কোন মাসজিদে প্রবেশ করে সেখানে কোন বিনয়ী লোক পাবে না।

অতএব বুঝা গেল যে, ইলম ও জ্ঞান উঠে যাওয়ার কারণই হল এমন ব্যক্তিগণের অভাব ও অনুপস্থিতি যারা ইলমকে ধারণ করবেন এবং সঠিকভাবে উপলব্ধি করবেন ও আমল করবেন।

৩.কুরআন বুঝা ও কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণার বিপুল সাওয়াব রয়েছে। উকবা ইবন আমের আল-জুহানী বলেন, আমরা আহলে সুফফার সাথে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘‘তোমাদের কোন ব্যক্তির এটা পছন্দ যে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়াই এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করে বুতহান অথবা আকীক প্রান্তরে গিয়ে দু’টো বিশালকায় উট নিয়ে আসবে?’’ আমরা বললাম, আমাদের সবারই তা পছন্দ। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন মাসজিদে গিয়ে কিতাবুল্লার দু’টো আয়াত শেখা কিংবা পড়া দু’ উটের চেয়েও তার জন্য উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে এবং চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। আর যতগুলো আয়াত সে অধ্যয়ন করবে তা সমসংখ্যক উটের চেয়ে উত্তম।’’ যদি জ্ঞানার্জন সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাকর কাজ হয়ে থাকে তাহলে এর অগ্রভাগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আল্লাহর কালাম জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করা। কেননা জ্ঞানের মর্যাদা জ্ঞানগত বিষয়ের মর্যাদার উপর নির্ভর করে। কিতাবুল্লাহ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে সম্মানিত বিষয়; সুতরাং এর জ্ঞানার্জনই হল সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাকর কাজ।

৪.মুসলমানদের অনৈক্য, ভুল বুঝাবুঝি ও হানাহানি দূর করে ভালবাসা, সম্প্রীতি ও হৃদ্যতা আনয়নের বিশুদ্ধ উপকরণই হল আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝা ও হৃদয়ঙ্গম করা। কুরআনকে সঠিকভাবে না বুঝাই হল যত অনৈক্যের মূল। ইবরাহীম আত-তাইমী বলেন, ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একদিন একাকী ছিলেন, তিনি স্বগতোক্তি করে বললেন, কিভাবে এ উম্মতের মধ্যে বিভেদ থাকতে পারে, অথচ তাদের রাসূল এক এবং কিবলা এক!? এরপর তিনি ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কে ডেকে পাঠালেন ও জিজ্ঞাসা করলেন, এ উম্মত কিভাবে বিভক্ত হতে পারে অথচ তাদের রাসূল এক ও কিবলা এক? ইবন আববাস বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা অধ্যয়ন করেছি এবং জেনেছি কোন ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আর আমাদের পর একদললোক আসবে যারা কুরআন পড়বে অথচ জানবে না কোন ব্যাপারে কুরআন নাযিল হয়েছে। ফলে সে ব্যাপারে তারা নিজস্ব মতামত দেবে। আর যখন তাদের নিজস্ব মতামত হবে তারা মতভেদ করবে এবং এভাবে মতভেদ করতে করতেই তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে…।

৫.কুরআন শেখা ও তা সঠিকভাবে বুঝা থেকে যারা বিরত থাকে ও মুখ ফিরিয়ে রাখে তারা মূলত কুরআনী জীবন যাপন থেকে সরে গিয়ে অন্য জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, যাদের কাছে কুরআনের জ্ঞান এসেছে অথচ সে জ্ঞান থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ও তা পরিত্যাগ করেছে, তাদেরকে তিনি জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করেননি, বরং অজ্ঞানতার মধ্যেই তারা হাবুডুবু খেয়েছে। তিনি ইয়াহুদদের সম্পর্কে বলেন,‘‘আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর কাছ থেকে একজন রাসূল এলো, তাদের সাথে যা আছে তা সমর্থন করে, তখন আহলে কিতাবের একটি দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পেছনে ফেলে দিল, (এভাবে যে,) মনে হয় যেন তারা জানে না। আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলায়মানের রাজত্বে পাঠ করত।’’

ইয়াহুদদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব আসার পর তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বলে আল্লাহ তাদেরকে এমন এক নিকৃষ্ট গ্রন্থের ফিতনায় তাদেরকে আক্রান্ত করেছিলেন যা সুলায়মান আলাইহিস সালামের রাজত্বে শয়তান তিলাওয়াত করতো।

আল্লাহ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার শাস্তি সম্পর্কে বলেন,‘‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাব অন্ধ অবস্থায়।’’

তিনি আরো বলেন,‘‘আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াত সমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’’

কুরআন বুঝা সহজ

কুরআনের পঠন-পাঠন, তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এবং কুরআনের অনুশাসন মেনে চলাকে আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন বলে সূরা আল-কামারে মোট চারবার ঘোষণা দিয়েছেন। ‘‘আর আমি নিশ্চয়ই কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?

আল-কুরআনের শব্দমালা সহজেই তিলাওয়াত ও হিফয করা যায়, এর অর্থ সহজেই বোধগম্য হয় এবং শেখা যায়; কেননা তা বাক্য বিন্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে সাবলীল ও সুন্দর, শৈল্পিকতায় সবচেয়ে নিপূণ ও শ্রেষ্ঠ, অর্থের দিক থেকে সবচেয়ে সত্যবাদী, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে সবচেয়ে স্পষ্ট। যে বা যারাই কুরআনের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের জন্য তা নিতান্তই সহজ করে দেন। পৃথিবীর বড় বড় অমুসলিম বিজ্ঞানী যারা আরবী ভাষা শিখেনি তাদের অনেকেই শুধু কুরআনের তরজমা পড়েই আল্লাহর গবংংধমব পেয়ে যায় এবং সেজন্যই পাশ্চাত্যের অনেক বড় পন্ডিত হয়েও তারা ইসলাম গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না।

আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘‘অত:পর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’’

‘‘আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহ প্রিয় কাওমকে তদ্বারা সতর্ক করতে পার।’’

কুরআনকে সহজ করে দিয়ে আল্লাহ আমাদের উপর বড়ই অনুগ্রহ করেছেন। তা না হলে এটা অন্য ধর্মের মত পুরোহিতদের কঠিন নিয়ন্ত্রণেই আবদ্ধ থাকত। অতএব আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কে আছেন কুরআনের দিকে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসবেন, কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করবেন, কুরআন শিখবেন এবং কুরআনের মর্মবাণী উপলব্ধি করে জীবনকে কুরআনের রঙে রঙিন করবেন?

কুরআন বুঝা এবং কুরআন নিয়ে গবেষণা সকল মুসমানের কাজ

কুরআন বুঝা এবং কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা শুধু আলেমদের মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে ঐ পরিমাণ কুরআন চর্চা করা, যতটুকু সাধ্য আল্লাহ তাকে দিয়েছেন এবং যতটুকু জ্ঞান, বুদ্ধি ও বুঝ তার রয়েছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সকলকেই কুরআন বুঝা ও তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার প্রতি আহবান করেছেন। কোন নির্দিষ্ট শ্রেণীকে তিনি বিশেষভাবে এ দায়িত্ব দেননি। কুরআন বুঝা ও গবেষণা যদি কোন একদয়ালোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হত তাহলে কুরআনের কল্যাণ সীমিত হয়ে যেত এবং আয়াতের আহবান স্পষ্টভাবে শুধু তাদের ব্যাপারেই ব্যক্ত করা হত, কিন্তু কুরআনের আহবান এমনটি নয়-এটা উম্মাহর সকলেরই জানা।

হযরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কুরআনের তাফসীর চারভাগে বিভক্ত; এক প্রকার আরবরা তাদের নিজেদের কথা থেকেই জানে। দ্বিতীয় প্রকার তাফসীর না বুঝার ওজর কারো পক্ষ থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। তৃতীয় প্রকার তাফসীর অনুধাবন শুধু আলেমগণের পক্ষেই সম্ভব। আর চতুর্থ প্রকার আল্লাহ ছাড়া আর কেই জানেন না।

তন্মধ্যে যে তাফসীর না বুঝার ক্ষেত্রে কারো ওজর শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয় তা হলো কুরআনে যে সব আহকাম ও বিধান স্পষ্ট, হৃদয়কে নাড়া দেয়া সুন্দর উপদেশাবলী, শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণসমূহ এবং সে সব সাধারণ বক্তব্য যা আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

যেমন আপনি যখন আল্লাহর কালাম নিয়ে ভাববেন, আপনি কি উপলব্ধি করবেন? আপনি উপলব্ধি করবেন, আপনি এমন এক সত্তাকে পেয়েছেন সকল কিছুই যার মালিকানাভূক্ত, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, প্রতিটি বিষয়ই তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সবকিছুর উৎস তিনি এবং তাঁর কাছেই সবার প্রত্যাবর্তন, তিনি আরশের উপর আছেন, জগতের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই, তিনি বান্দার অন্তরের কথাও জানেন, তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল অবস্থা তাঁর জানা, তিনি একাই জগত পরিচালনা করছেন, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা, তিনি দান করেন ও কেড়ে নেন, তিনিই পুরস্কুত করেন ও শাস্তি দান করেন, তিনিই সম্মানিত করেন ও অপদস্থ করেন, তিনিই সৃষ্টি করেন ও রিয্ক দেন, তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, তিনিই তাকদীর ও ফয়সালা নির্ধারণ করেন, তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন অণুও আন্দোলিত হয় না, তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোন একটি পাতাও ঝরে না, যমীন ও আসমানের কোন কিছু তাঁর অজ্ঞাত নেই…

এরপর ভাবুন আল-কুরআনে কিভাবে তিনি তাঁর নিজের প্রশংসা করেছেন, গুণগান বর্ণনা করেছেন, বান্দাদেরকে নসীহত করেছেন আর বান্দাদেরকে ঐ পথের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে রয়েছে তাদের সুখ-শান্তি ও সাফল্য এবং সতর্ক করেছেন সে সব বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে যাতে রয়েছে তাদের অশান্তি ও ধ্বংস। কুরআনের মাধ্যমেই বান্দা অতি সহজেই জানতে পারছে আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও মহান গুণাবলী সহ তাঁর পরিচয়। আল-কুরআন বান্দার সামনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামতসমূহ তুলে ধরেছে, আর অনুগত বান্দাদের জন্য আল্লাহর দেয়া মর্যাদা, সুখ-শান্তি ও মহা পুরস্কারের সংবাদ এবং পাপিষ্ঠ ও অবাধ্য বান্দাদের য়াবহ ও মর্মান্তিক শাস্তির দুঃসংবাদ প্রদান করেছে। এ বিষয়গুলো এবং এছাড়াও আরো বহুবিধ বিষয় আল্লাহর যে কোন বান্দা চাইলেই সহজে অনুধাবন করতে পারে। তবে এজন্যে তাদের প্রয়োজন কুরআন অধ্যয়ন করা এবং কুরআন নিয়ে কিছুটা চিন্তা-গবেষণা করা এবং এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত অথচ অঁঃযবহঃরপ কিছু তাফসীরের সাহায্য নেয়া।

পাশাপাশি কুরআনে এমন সব বিষয়ও দেখা যায় যা বুঝার জন্য আলেম ও স্কলারদের বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, সাধারণ মানুষ মাত্রই তা বুঝতে পারে না। যেমন কুরআনের কাব্যিক অভিব্যক্তি, সাহিত্যিক শৈল্পিকতা এবং আরবীভাষার অলংকরণ ও বর্ণনাভঙ্গির বহু সুক্ষ বিষয় আরবী ভাষায় পারদর্শী বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। একইভাবে কুরআন থেকে হালাল-হারামের প্রতিটি বিষয় গবেষণা করে বের করা ফাকীহ ও মুহাদ্দিস-মুফাসসির ছাড়া অন্য সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। কুরআনে খুবই স্বল্প কিছু শব্দ ও বাক্য রয়েছে যার মর্ম শুধু আল্লাহই জানেন, যেমন কিছু সূরার শুরুতে ‘আলিফ-লাম-মীম’ ইত্যাদি ঊীঢ়ৎবংংরড়হ-সমূহ।

কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি কোথায়

কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরী। সতর্কতার অভাবে এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভুল-ক্রটি হয়ে যেতে পারে; কেননা অনেক সময় কুরআনের কোন বক্তব্যের সাধারণ অর্থ কেউ বুঝে থাকতে পারেন, অথচ ঐ বক্তব্য দ্বারা বিশেষ অর্থটিই উদ্দেশ্য, সাধারণ ও ব্যাপক অর্থ নয়। কখনো পাঠক বুঝে থাকতে পারেন এমন অর্থ যা বুঝানো কুরআনের উদ্ধেশ্য নয়। এমনটি সাহাবাগণের কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

১.হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘‘কিয়ামতেরদিন যার হিসাব নেয়া হবে তার আযাব হবে।’’ আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেন নি,‘‘অতঃপর অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব নিকাশ করা হবে।’’ তিনি বললেন, ‘‘এটা সে হিসাব নয়, বরং এটা শুধু উপস্থাপন মাত্র। কিয়ামতেরদিন যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেয়া হবে, তার আযাব হবে।’’

এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা  হিসাবের সাধারণ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছিলেন যা কম বেশী সব ধরনের হিসাবকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করে দিলেন যে, আলতে উল্লিখিত হিসাব মানে হল-মুমিন ব্যক্তির কাছে তার আমল উপস্থাপন, যাতে সে আল্লাহর সে অনুগ্রহ অনুধাবন করতে পারে যা তিনি দুনিয়ায় তার দোষ গোপন করার মাধ্যমে এবং আখিরাতে ক্ষমা করার মাধ্যম করেছিলেন।

২.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন অবতীর্ণ ‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলম দ্বারা মিশ্রিত করেনি।’’ আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তার নিজের উপর যুলম করে নি? তিনি বললেন, ‘‘আয়াতটির ব্যাপারে তোমরা যা বলছ বিষয়টি তেমন নয়, বরং যুলম মানে এখানে শির্ক। তোমরা কি শোন নি লুকমান তার ছেলেকে বলছিলেন, “হে বৎস, তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম।’’ (লুকমান-৩১ আয়াত : ১৩)

এ ধরনের উদাহরণ অনেক। তবে এছাড়াও আরো অনেক ধরনের ভুল হয়ে থাকতে পারে। যেমন :

১.চিন্তা-গবেষণার ক্রটির কারণে অনুধাবনে ক্রটি।

২.যে সব মৌলিক বিষয় একজন মুসলিমের জানা থাকা উচিত, তা জানা না থাকার কারণে কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে ক্রটি।

৩.প্রবৃত্তির অনুবর্তী হওয়ার কারণে সৃষ্ট ক্রটি। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও আকীদায় পূর্ব থেকেই একটি বিষয় স্থির হয়ে আছে, যে কোন ভাবেই সে নিজের ধারণাটি কুরআনের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। ফলে আয়াত দ্বারা সেভাবে বুঝা না গেলেও সে নিজের আকীদা ও পূর্বাহ্নে স্থিরীকৃত বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আয়াতের বিপরীত অর্থ বুঝে থাকে। অথচ মুলিম মাত্রই উচিত হল সর্বাবস্থায় আল্লাহর মাকসুদ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝে নেয়া। কেননা সঠিকভাবে বুঝার জন্য ব্যক্তির সদিচ্ছা, সত্যানুসন্ধিৎসা এবং ভেতর ও বাহিরের সত্যিকার তাকওয়া থাকা প্রয়োজন। প্রবৃত্তির অনুসরণ, দুনিয়া পূজা, প্রশংসা পাওয়ার লোভ ও তাকওয়া বিসর্জন ইত্যদির উপস্থিতিতে সঠিক বুঝ ও উপলব্ধি কখনোই আসবে না।

আরেকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার মানে এটা নয় যে, ব্যক্তি নিজেকে মুফাসসির হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, তাই এখন থেকে আলেমগণের তাফসীর না দেখে এবং ভালভাবে বুঝে না নিয়েই প্রত্যেক আয়াতের ব্যাখ্যায় নিজ অভিমত পেশ করবেন না। ভুলে গেলে চলবে না, তাফসীর মানেই হল আল্লাহতায়ালা কর্তৃক উদ্দিষ্ট অর্থের বর্ণনা, সঠিক নিয়ম-নীতির আলোকে তাফসীর করা না হলে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

৪.হযরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘‘যে ব্যক্তি কোন জ্ঞান ছাড়া কুরআনের ব্যাপারে বক্তব্য প্রদান করে, সে জাহান্নামে তার স্থান বেছে নিয়া।’’

৫.হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কোন যমীন আমাকে আশ্রয় দেবে আর কোন আকাশ আমাকে ছাল দান করবে যদি আমি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে এমন কিছূ বলি যা আমি জানি না’।

৬.হযরত উবায়দুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে ইয়াসার তার বাবার কাছ থেকে বর্ণনা করে বলেন,‘যখন তুমি আল্লাহ সম্পর্কে বক্তব্য দেবে তখন থেমে গিয়ে দেখ, এর পূর্বে ও পরে কি আছে।’ প্রখ্যাত তাবেয়ী মাসরুক বলেন,‘তাফসীর করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাক;  কেননা তাতো আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা ছাড়া আর কিছু নয়।’ সাহাবা এবং তাবেয়ীগণের এ সকল বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় তারা তাফসীরের ক্ষেত্রে ইলম ও জ্ঞান ছাড়া কথা বলতে কি বিশাল সতর্কতা অবলম্বন করতেন।

কিভাবে আমরা সঠিকভাবে কুরআন বুঝব?

কুরআন সঠিকভাবে বুঝার জন্য কুরআন গবেষণার সঠিক নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। নিম্নে সে সব নিয়ম-নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো-

১. কুরআন বুঝার সহজ পথ অনুসরণ। এ পথটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে-

এক : কুরআনের তাফসীর প্রথমত কুরআন দিয়ে করা, তারপর সুন্নাহ দিয়ে এবং তারপর সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে। তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল কুরআন দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। যদি কেউ কুরআনকে বিশুদ্ধরূপে বুঝতে চায় তাহলে তার উচিত সামগ্রিকভাবে কুরআনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং পুরো আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি খেয়াল রাখা। পাশাপাশি অন্য সূরায় যদি একই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত আয়াত থাকে তাহলে সে আয়াতের অর্থ কি তা জেনে নেয়া। যদি কোন আলতে বক্তব্য অস্পষ্ট থাকে তাহলে অন্য আলতে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, যদি কোথাও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত থাকে তাহলে অন্যত্র বিস্তারিত বক্তব্য থাকবে। যারা কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ করে এবং কিছু অংশ বাদ দেয় আল্লাহ কুরআনে তাদের নিন্দা করেছেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর?’’

সুতরাং যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে।

আল্লাহর বাণী,‘‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন।’’

এখানে ‘আল্লাহর স্মরণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি কুরআন, নাকি আল্লাহ যে সব কিতাব নাযিল করেছেন সেগুলো, অথবা তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ?

আমরা যদি আয়াতটির পূর্বাপর বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে,‘আল্লাহর যিকর বা স্মরণ’ দ্বারা এখানে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, অন্যগুলো নয়; কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘‘তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয়েই জান্নাত হতে এক সাথে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শক্র। অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত  আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না’। ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য  হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী (কুরআন) এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’।’’

এরপর আসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি। স্বয়ং আল্লাহই  রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার সুন্নার মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন। আল্লাহ বলেন,‘‘এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা করে।’’

ইমাম শাফেয়ী বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব হুকুম দিয়েছেন তার সবই তিনি কুরআন থেকে যা বুঝেছেন তার অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহ বলেন,‘‘নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না।’’

‘‘আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, শুধু এজন্য যে, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে, তা তাদের জন্য তুমি স্পষ্ট করে দেবে এবং এটি হিদায়াত ও রহমত সেই কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।’’

কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে কুরআনের তাফসীর করা না গেলে সে ক্ষেত্রে কুরআনের তাফসীর করতে হবে সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে; কেননা তারাই কুরআন নাযিলের অবস্থা ও প্রেক্ষাপট সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা অন্যরা করতে পারেনি। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থেকে তারা সঠিক ইলম, প্রজ্ঞা ও ইসলামের মূল মাকাসিদের জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়েছিলেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ যিনি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই, আল্লাহর কিতাবে যে আয়াতই নাযিল হত, আমি জানতাম সে আয়াতটি কার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং কোথায় নাযিল হয়েছে। আমার চেয়েও কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে বেশী জানে এমন কারো সন্ধান পেলে অবশ্যই আমি তার কাছে আসতাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এক ব্যক্তি যখন দশটি আয়াত শিখত, তিনি সেগুলোর অর্থ ভালভাবে হৃদলঙ্গম করা ও আমল করা ছাড়া সেগুলো অতিক্রম করে অন্য আয়াতের দিকে যেতেন না।’তারা ইলম ও আমলের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছিলেন।

দুই : আসবাবুন নুযূল তথা নাযিলের কারণ ও প্রেক্ষাপট জানা। আল-কুরআন মূলত আল্লাহর কালাম বা বক্তব্য, যার একটি শাব্দিক অর্থ রয়েছে। অনেক সময়ই সে শাব্দিক অর্থ বুঝার জন্য প্রয়োজন সার্বিক  প্রেক্ষাপট ও যাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন তাদের বিষয়টি অবগত হয়া। এটি জানা না থাকলে কুরআনের আয়াত নিয়ে মুসলিম মানসে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা ও সংশয়। বুকাইর নামক একজন আলেম প্রখ্যাত তাবেয়ী নাফে‘কে জিজ্ঞাসা করলেন, হারুরী সম্প্রদায় সম্পর্কে ইবন উমারের অভিমত কেমন ছিল? তিনি বললেন, তিনি তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টির অধম বলে মনে করতেন; কেননা কাফিরদের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতসমূহকে তারা মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত।’

তিন : আরবী ভাষা জানা। কুরআন সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। অতএব যে সঠিকভাবে কুরআন বুঝতে চায় তাকে অবশ্যই আরবী ভাষা বুঝতে হবে। সাথে সাথে কথায়, কাজে ও কুরআন নাযিলের নানা  প্রেক্ষাপটে আরবদের ‘আদাত ও প্রথার সাথে পরিচিত হতে হবে।

এ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে যদি আমরা এমন তাফসীর পেতে চাই যা আমাদেরকে কুরআন সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, তাহলে আমাদেরকে এমন তাফসীর ও ব্যাখা গ্রন্থ চয়ন করতে হবে যাতে উক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। এ ধরনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হাফিয ইবন কাসীরের তাফসীরুল কুরআনিয়া আযীম, শায়খ আবদুর রহমান আস-সা‘দীর তাইসীরুল কারীম আর-রাহমান, আবু বাকর আল-জাযায়েরীর আইসারুত তাফাসীর, আবুল আ‘লা মাওদুদীর তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ কুতুবের ফী যিলালিল কুরআন, ড. মুহাম্মাদ আল-আশকার এর যুবদাতুয তাফাসীর ইত্যাদি।

তাফসীর পড়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে অনেকের তাফসীরে কিছু কিছু ভুল রয়েছে, আবার অনেকের আকীদাগত বিভ্রান্তি আছে। এ সব ভুল ও বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।

২.যা উপকারী ও সবার জন্য মঙ্গলজনক কুরআন বুঝা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সবসময় তাতেই নিজেকে সম্পৃক্ত ও নিয়োজিত রাখতে হবে। আর যা উপকারী ও প্রয়োজনীয় নয় তা এড়িয়ে যেতে হবে। আল্লাহ নিজেও মানুষের নানা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে উত্তরে এমন বিষয় সমূহ তুলে ধরেছেন যা মানুষের জন্য কল্যাণকর। এর প্রকৃত উদাহরণ পাই আমরা নিম্নোক্ত আয়াতটিতে। আল্লাহ বলেন,‘‘তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, ‘তা মানুষের ও হজ্জের জন্য সময় নির্ধারক’। আর ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। কিন্তু ভাল কাজ হল, যে তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা গৃহসমূহে তার দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’’

এ আয়াতটিতে লোকেরা চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। হয়তো তারা জানতে চেয়েছে চাঁদটা শুরুতে কেন ছোট থাকে তারপর বড় হয়, অথবা চাঁদের হাকীকত কি কিংবা চাঁদের উপকারিতা কি ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহ সরাসরি তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছেন যা জানার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হয়। এমন উদাহরণ কুরআনে আরো অনেক আছে। মোদ্দাকথা হল, কুরআনের বর্ণনার বাইরে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই, কুরআন বুঝার সময় এ কথাটিও মনে রাখতে হবে।।

৩.কুরআনের বাণী তিলাওয়াতের সাথে সাথে এর অর্থ বুঝা ও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নিয়োজিত হওয়া এবং অন্তরকে সে অর্থ দ্বারা প্রভাবিত করা। অতএব কুরআন শুধু  তিলাওয়াত করলেই হবে না, বরং এতে যে নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সেগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং আমল করতে হবে আর মানার ক্ষেত্রে ক্রটি হলে ইস্তেগফার করতে হবে।

যখন রহমতের আয়াত পড়বে তখন হৃদয়ে আনন্দের শিহরণ সৃষ্টি করে মনে মনে প্রভুর কাছে তা পাওয়ার প্রার্থনা করবে। আবার আযাবের আয়াত পড়লে যেন মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং আল্লাহর কাছে তা থেকে পানাহ চাইবে। এভাবেই স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।

৪.কুরআনের মৌলিক মাকাসিদ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জেনে রাখা, যা কুরআনিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং যা কুরআনে পৌনপুনিকভাবে এসেছে। যেমন কুরআন সবচেয়ে বেশী আলোচনা করেছে ও গুরুত্ব দিয়েছে তাওহীদের বাস্তবায়ন, শির্ককে প্রত্যাখ্যান, ঈমান ও ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহের উপর। অতএব এগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা রেখেই কুরআন বুঝার চেষ্টা করতে হবে।

৫.আল্লাহর সুন্দর নামগুলো এবং যে সকল আলতে সেগুলো এসেছে এতদুয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও সমন্বয় সাধন। অনেক সময় দেখা যায় আয়াত শেষ হয় আল্লাহর কোন একটি নাম দিয়ে। মনে রাখতে হবে আল্লাহর ঐ বিশেষ নাম আয়াতের শেষে উল্লেখ করার একটা ঝরমহরভরপধহপব আছে যেমন রহমতের আয়াত শেষ করা হয় আল্লাহর রহমতসূচক নাম দিয়ে, আবার আযাব ও শাস্তির আয়াতগুলো শেষ হয় শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কর্তৃত্বসূচক নাম দ্বারা। আরো বেশী সতর্ক থাকতে হবে যাতে আল্লাহর গুণবাচক কোন নামকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে তাবীল করা না হয়।

৬.আয়াতের প্রাসঙ্গিক ও আনুষাঙ্গিক অর্থ সহ আয়াতকে বুঝতে হবে অর্থাৎ যে সব বিষয়ের উপর আয়াতের অর্থ বুঝা নির্ভরশীল সেগুলো সহ আয়াতটিকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,‘‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)।’’

এখানে অযুর ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। তবে জানা কথা অযুর জন্য পানি দরকার, সে পানি অর্জনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা প্রয়োজন। অতএব অযু করার জন্য যত কাজের প্রয়োজন সবকিছু এ নির্দেশটির অন্তর্ভূক্ত হবে।

৭.বৈজ্ঞানিক তথ্য ও সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কারের বিষয়গুলোকে কুরআনের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সঙ্গতিপূর্ণ করা। তবে সতর্ক থাকতে হবে যে কুরআন বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়ার জন্য নাযিল করা হয়নি। সুতরাং সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভান্ডার এটি নয়। আর এ বিশ্বাসও জরুরী যে, কুরআনের সকল বৈজ্ঞানিক তথ্যই সঠিক। তবে সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন বৈজ্ঞানিক ঋধপঃং নয় এমন বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের বিষয় মনে করে আমরা কুরআনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হই। এক্ষেত্রে পাঠকের কাছে কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে ঈড়হঃৎধফরপঃরড়হ আছে বলে মনে হতে পারে এবং এ জন্য পাঠকের অসতর্কতাই দায়ী। কুরআনে মহাসত্যের বিপরীত কিছু নেই। বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আমাদের কুরআন বুঝার চেষ্টা করতে হবে। কুরআন বুঝা সহজ; কেননা আল্লাহই তা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু কুরআন বুঝার সঠিক পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

রমযান ও কুরআন

ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যাতে আমরা সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, ধর্ম প্রভৃতি সকল কিছুরই রূপায়ন দেখতে পাই। কোনো জীবনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান ও আইন-কানুন অত্যাবশ্যক। পবিত্র কুরআন এ জীবনব্যবস্থা পরিচালনার মৌলিক আইন-কানুন ও বিধি-বিধান ব্যতীত আর কিছুই নয়। সাধারণ জীবনব্যবস্থা পরিচালনা ছাড়াও কুরআনের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিদিন পাঁচবার নামাজে পবিত্র কুরআনের অংশ বিশেষ মূল আরবীতে পাঠ করতে হয়। এ জন্য ইসলাম যেখানেই গিয়েছে, আরবীতে গ্রন্থিত এর কোষগ্রন্থটি আর এর ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। ফলে, বিভিন্ন দেশে মানবগোষ্ঠীকে ইসলাম কেবল ধর্মান্তরিতই করেনি বরং সেখানকার ভাষাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। কুরআনের প্রভাবেই আফ্রিকা মহাদেশের এক তৃতীয়াংশ লোক আরবীভাষীতে পরিণত হয়েছে। তদুপরি এশিয়া ও আফ্রিকার বহু ভাষা, যথা : ফুলানী, হাউসা, উলফ, সোয়াহিলী, উর্দু, ফার্সী, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবী প্রভৃতি আজও আরবী বর্ণমালায় লেখা হয়। এ থেকে একটি বিষয় স্বচ্ছ হয় যে, কুরআন সর্বতভাবে প্রভাব তৈরী করে। এই কুরআনের সাথে রমযানের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। দেহের সঙ্গে পোশাকের যেমন নিবীড় সম্পর্ক, রমযানের সঙ্গে কুরআনের সর্ম্পকটা তেমনি গভীর। মানবজাতির ইহ ও পরকালীন সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এই মহাগ্রন্থ রহমত, বরকত মাগফিরাতের পবিত্র রমযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, রমযান হলো এমন একটি মাস যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এতে রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়াত এবং পথ চলার নির্দেশিকা ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ।(বাকারা-২ আয়াত : আয়াত-১৮৫)

কুরআন ও রমযান বান্দার জন্য আল্লাহ দরবারে সুপারিশ করবে। রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমযান এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! সারাদিন আমি তাকে খাবার এবং বৈধ উপভোগ থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করে নাও। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। রাতের ঘুম ছেড়ে দিয়ে সে তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদে আমায় তিলাওয়াত করেছে। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ তুমি কবুল করে নাও। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোজা এবং কুরআনের সুপারিশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কবুল করে নিয়ে বান্দাকে মাগফিরাত এবং ক্ষমার পুরস্কারে ভূষিত করবেন। (মিশকাত)

সুতরাং আসুন আমরা কুরআন পাঠ ও এর গবেষণায় মনোযোগ দিই। কুরআনের কারণে যেমন রমযানের মর্যাদা, তেমনি অন্যান্য কয়েকটি আসমানী কিতাবও এই রমযান মাসে নাযিল হয়েছে, এদিক থেকে রমযানের মর্যাদার উৎস একাধিক।

মুসনাদে ওয়াসেল বিন আসকা থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমযানের প্রথম রাতে হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সহীফা, ৬ই রমযান হজরত মূসা আলাইহিস সালাম এর ওপর তাওরাত, ১৩ই রমযান ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর ইঞ্জিল এবং ২৪শে রমযান (দিবাগত রাত) কুরআন নাজিল হয়েছে। কথিত আছে যে, ১৮ই রমযান হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর নিকট যাবূর কিতাব নাজিল হয়।

এই রমযান মাসেই অতীতের উম্মতগুলোর কাছেও আল্লাহ হেদায়াতের বাণী এসেছিল। এদিক থেকে রমযান হচ্ছে, মহাকল্যাণ, পুরস্কার ও হেদায়াতে ভরা মওসুম। তাইতো রমজানে কুরআন পড়া ও শেখা আরও বেশী উত্তম।

কুরআন এসেছে মানুষকে সহজ-সরল পথ দেখাতে। কুরআন হচ্ছে অন্তরের চিকিৎসা ও আলো এবং জ্ঞান ও দলীল। কুরআন হচ্ছে সৌভাগ্য ও সওয়াবের বিষয়। কুরআন হচ্ছে আল্লাহ শিক্ষা ও চিরন্তন শাসনতন্ত্র। তাই কুরআনকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ ও অনুধাবনের চেষ্টা চালাতে হবে।

রমজানে কুরআন বুঝার জন্য আমাদের অতীত নেক পূর্বপুরুষরা যা করে গেছেন তাও আমাদের জন্য উৎসাহের কারণ হতে পারে। হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রতিদিন একবার কুরআন খতম দিতেন। ইমাম মালেক রহ. রমযান আসলে কুরআন পড়া ছাড়া বাকী সব কাজ বন্ধ করে দিতেন। তিনি শিক্ষা দান, ফতওয়া ও লোকজনের সাথে বসা বন্ধ করে দিয়ে বলতেন এটা হচ্ছে কুরআনের মাস।

ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফিয়ী রহ. রমজানে তারাবীর সালাত ছাড়াই ৬০বার কুরআন খতম করতেন। আবু হানিফা রহ. রমজানে শুধু কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি দিনে এক খতম, রাতে এক খতম পড়তেন। রমজানে খুব কমই কেউ তার সাথে কথা বলতে পারত।

রমযান এলে ইমাম জুহরী বলতেন, রমযান হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত ও খানা খাওয়ানোর মাস। ইমাম মালেক (র.) রমযান এলে হাদীস অধ্যয়ন ও জ্ঞানীদের আসর ত্যাগ করতেন এবং শুধু কুরআন অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁরা এ মাসকে সৃষ্টির সাথে বয়কট এবং ¯্রষ্টার সাথে সম্পর্কের মাস বলে অভিহিত করতেন।

তিলাওয়াতের সাজদা কুরআন তিলাওয়াতের সময় নিম্মোক্ত সূরার নিম্মোক্ত স্থানগুলোতে সাজাদা করতে হয়

ক্রমিক  পারা নম্বর       সূরা নম্বর        সূরার নাম       সাজাদার আয়াত

১        ০৯      ০৭      আল আরাফ    ২০৬

২        ১৩      ১৩      আর রাদ         ১৫

৩       ১৪      ১৬      আন নাহল      ৫০

৪        ১৫      ১৭      আল ইসরা      ১০৯

৫        ১৬      ১৯      এরিয়ম  ৫৮

৬       ১৭      ২২      আল হজ্জ       ১৮

৭        ১৭      ২২      আল হজ্জ       ৭৭*

৮        ১৯      ২৫      আল ফুরকান   ৬০

৯        ১৯      ২৭      আল নামল      ২৬

১০      ২১      ৩২      আস সাজদা     ১৫

১১      ২৩      ৩৮      সোয়াদ ২৪

১২      ২৪      ৪১      হামিম আস সাজদা      ৩৮

১৩      ২৭      ৫৩      আন নাজম      ৬২

১৪      ৩০      ৮৪      আল ইনশিকাক ২১

১৫      ৩০      ৯৬      আল আলাক    ১৯

নিম্মলিখিত সূরা ও আয়াতগুলো আমরা বেশী বেশী করে পড়তে পারি

ক্রমিক  সূরা ও আয়াত  সূরা নং আয়াত

১        সূরা ফাতেহা    ১        ১-৭

২        আয়তুল কুরসী  ২        ২৫৫

৩       সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত ২        ১-৬

৪        সূরা হাশর       ৫৯      ২৩-২৪

৫        সূরা ইখলাস     ১১২     ১-৪

৬       সূরা ইয়াসিন    ৩৬     ১-৮৩

৭        সূরা কাফিরূন   ১০৯    ১-৬

৮        সূরা ফালাক    ১১৩    ১-৫

৯        সূরা নাস         ১১৪     ১-৬

১০      সূরা মূলক       ৬৭      ১-৩০

১১      সূরা যিলযালান ৯৯      ১-৮

১২      সূরা তাওবার শেষ ২ আয়াত     ৯        ১২৮-১২৯

১৩      সূরা রূম          ৩০      ১৭-১৮

সূরা ফাতেহা

ا َ لْحَمْدُ  لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ﴿٢﴾ ا َلرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ ﴿٣﴾ مَالِك يَوْم ِالدِّينِ ﴿٤﴾ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ﴿٥﴾                      اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ﴿٦﴾ صِرَاطَ الَّذِين أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِالْمَغْضُوب عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ ﴿٧﴾

উচ্চারণ : আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। আর রাহমানির রাহীম। মালিকি ইয়াওমিদ্দীন। ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন। ইহদিনাস সিরাত্বাল মুসতাক্বীম। সিরাত্বাল লাযীনা আন‘আমতা আলাইহিম, গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদদ্বোয়াল্লিন। আমীন”।

অর্থ : সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্ল¬াহতায়ালার জন্য যিনি সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা। যিনি দাতা, দয়াময় মেহেরবান। যিনি বিচার দিনের মালিক (অধিপতি), আমরা সর্বাবস্থায় একমাত্র তোমারই ইবাদত (দাসত্ব) করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সরল-সঠিক পথ দেখাও, সেসব লোকের পথ যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছো। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গযব (অভিশম্পাৎ) নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

আয়তুল কুরসী

ُاَللهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيْ الْقَيُّوْمُ ۚ لَاتَأْخُذُ هُ سِنَةٌ  وَلَا نَوْمٌ  ۚ لَّهُ  مَا فِيْ السَّمَاوَاتِ وَمَافِيْ الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِيْ يَشْفَعُ عِندَ هُ  إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَايُحِيْطُونَ بِشَيْءٍمِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ  كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَ ا لْأَرْضَ ۖ  وَلَايَئُوْدُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَالْعَلِيُّ الْعَظِيْمُ

উচ্চারণ : আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম, লা তা’খুযুহু সিনাতুঁও ওয়ালা নাউমুন, লাহু-মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি, মানযাল্লাযী ইয়াশ ফা’উ ইনদাহু ইল্লা বি‘ইযনিহি, ইয়া‘লামু মা বাইনা আইদীহিম ওয়ামা খালফাহুম, ওয়ালাইউহীতূনা বিশাইইম মিন ইলমিহি ইল্লা বিমা শা’-আ। ওয়াসিয়া কুরসিয়্যুহুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা, ওয়ালা ইয়া’উদুহু হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলীয়্যুল ‘আযীম।

অর্থ : আল্লাহ তিনিই- যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি চির জীবন্ত, জমিনের সবকিছুরই তিনি মালিক। কেউই নেই যে তার বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট সুপারিশ করতে সক্ষম। তাদের অগ্র-পশ্চাতে যা কিছু রয়েছে তিনি তা সবই অবগত। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন সে ব্যতীত তাঁর ইলমের কিছু অংশও ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। তাঁর আসন সমস্ত আসমান এবং জমিনকেই পরিব্যপ্ত করে রেখেছে। আর সমস্ত আসমান ও জমিনের রক্ষণাবেক্ষণ তাকে বিন্দুমাত্রও ক্লান্ত করে না। তিনি সুউচ্চ ও মহান। (বাকার -২৫৫)

সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত

لِلّٰهِ مَافِيْ السَّمَاوَاتِ وَمَا فِيْ الْأَرْضِ ۗ وَإِن تُبْدُوا مَافِيْ أَنفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اَللهُ ۖ فَيَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۗ وَاَللهُ عَلٰى  كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِل َإِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَ الْمُؤْمِنُونَ ۚ كُل ٌّ  آمَنَ بِا للهِ وَمَلَائِكَتِه ِ وَكُتُبِهِ وَ رُسُلِهِ لَانُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ  غُفْرَانَكَ  رَبَّنَا وَإِلَيْكَ  الْمَصِيْرُ لَايْكَلِّفُ اَللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَ عَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِيْنَا أَوْ أَخْطَأْنَا   ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إ ِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِيْنَ مِن قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَاطَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا و َاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ

উচ্চারণ : লিল্লাহি মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্ধী; ওয়াইন তুবদু মা ফি আনফুসিকুম আও তুখফুহু ইউহাসিবকুম বিহিল্লাহ; ফাইয়াগফিরু লিমাইয়াশাউ ওয়াইউ’আযযিবু মাইইয়াশাউ; ওয়াল্লাহু আল্লা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। (সূরা ২ বাকারা: আয়াত ২৮৪) আমানার রাসূলু বিমা উনযিলা ইলাইহি মির বাব্বিহী ওয়াল মু’মিনুন; কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়ামালাইকাতিহি ওয়াকুতুবিহী ওয়া রুসূলিহি; লানুফাররিকু বাইনা আহাদিম-মির রুসূলিহি; ওয়া ক্বালু সামি’না ওয়াআত’¡না, গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসীর। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ২৮৫) লাইয়্যুকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা; লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত; রাব্বানা লা তুআখিযনা ইন্নাসীনা আও আখতা’না; রাব্বানা ওয়ালা তাহমিল আলাইনা ইসরান কামাহামালতাহু আলাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিনা; রাব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা মা লা ত্বক্বাতালানা বিহি, ওয়াফু আন্না, ওয়াগফিরলানা, ওয়ার হামনা, আনতা মাওলানা ফানসুরনা আলাল ক্বাওমিল কাফিরীন। (সূরা ২ বাকারা : ২৮৬)

অর্থ : আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যাকিছু আছে, সবই আল্লাহর। তোমরা নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করো বা লুকিয়ে রাখো, আল্লাহ অবশ্যি তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন। তারপর তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন, এটা তাঁর এখতিয়ারাধীন। তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তি খাটাবার অধিকারী। রাসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে ও তাঁর রাসূলদেরকে মানে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে : “আমরা আল্লাহর রাসূলদের একজনকে আর একজন থেকে আলাদা করি না। আমরা নির্দেশ শুনেছি ও অনুগত হয়েছি। হে প্রভু! আমরা তোমার কাছে গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করছি। আমাদের তোমারই দিকে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ কারোর ওপর তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপান না। প্রত্যেক ব্যক্তি যে নেকী উপার্জন করেছে তার ফল তার নিজেরই জন্য এবং যে গোনাহ সে অর্জন করেছে, তার প্রতিফলও তারই উপর বর্তাবে। (হে ঈমানদারগণ, তোমরা এভাবে দোয়া চাও) হে আমাদের রব! ভুল-ভ্রান্তিতে আমরা যেসব গোনাহ করে বসি, তুমি সেগুলো পাকড়াও করো না। হে প্রভু! আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না, যা তুমি আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। হে আমাদের প্রতিপালক! যে বোঝা বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। আমাদের প্রতি কোমল হও, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি করুণা করো। তুমি আমাদের অভিভাবক। কাফেরদের মোকাবিলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো।

সূরা হাশরের শেষাংশ

هُوَاَللهُ الَّذِيْ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَالِمُ الْغَيْبِ وَ الشَّهَادَةِ ۖ هُوَ الرَّحْمَـٰنُ الرَّحِيْمُ ﴿٢٢﴾ هُوَ اَللهُ الَّذِيْ لَا إِلَـٰهَ إِلَّاهُوَالْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيْزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ ۚ سُبْحَانَ اللهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿٢٣﴾ هُوَ اَللهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ ۖ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ ۚ  يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِيْ السَّمَاوَاتِ وَ الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ﴿٢٤﴾

উচ্চারণ : হুওয়াল্লা হুললাযী লা-ইলাহা ইল্লাহু আ’-লিমুল গাইবি ওয়াশশাহাদাতি হুওয়ার রাহমানুর রাহীম। হুওয়াল্লা হুললাযী লা-ইলাহা ইল্লাহু আলমালিক্বুল কুদ্দুসুস সালামুল মু‘মিনুল মুহাইমিনুল আযীযুল জ্বাব্বারুল মুতাক্বাব্বিরু; সুবহানাল্লাহি-আম্মা ইউশরিকুন। হুয়াল্লা হুল খা-লিক্বুল বা-রিউল মুসাব্বিরু লাহুল আসমা-উল হুসনা; ইয়্যুসাব্বিহু লাহূ মা-ফিস্সামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্বি, ওয়া হুওয়াল আযীযুল হাকীম।

অর্থ : আল্লাহই সেই মহান সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই্ অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি রহমান ও রহীম। আল্লাহই সেই মহান সত্তা যিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি বাদশা, অতীব পবিত্র, পূর্ণাঙ্গ শান্তি, নিরাপত্তাদানকারী, হিফাযতকারী, সবার ওপর বিজয়ী, শক্তি বলে নিজের নির্দেশ কার্যকরী করতে সক্ষম। এবং সবার চেয়ে বড় হয়েই বিরাজমান থাকতে সক্ষম। আল্লাহ সেই সব শিরক থেকে পবিত্র বা লোকেরা করে থাকে। সেই পরম সত্তা তো আল্লাহই যিনি সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দানকারী এবং সেই অনুপাতে রূপদানকারী। উত্তম নামসমূহ তারই। আসমান ও যমীনের সবকিছু তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করে চলেছে। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।

সূরা আল ইখলাস

قُلْ هُوَاَللهُ أَحَدٌ   ﴿١﴾   اَللهُ الصَّمَدُ   ﴿٢﴾   لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ   ﴿٣﴾   وَلَمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ ﴿٤﴾

উচ্চারণ : ক্বুল হুয়াল্ল¬াহু আহাদ। আল্ল¬াহুস সামাদ। লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইউলাদ। ওয়ালাম ইয়াক্বুল্ল¬াহু কুফুওয়ান আহাদ।”

অর্থ : বলুন, তিনি আল্ল¬াহ এক, অদ্বিতীয় আল্ল¬াহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তার মুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেন নাই এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয় নাই। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নাই।

সূরা আল ফালাক

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ   ﴿١﴾   مِن شَرِّ مَا خَلَقَ   ﴿٢﴾   وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ    ﴿٣﴾    وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِيْ الْعُقَدِ  ﴿٤﴾

وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ﴿٥﴾

উচ্চারণ : ক্বুল আ’উযু বিরাব্বিল ফালাক্ব। মিন শাররি মা খালাক্ব। ওয়ামিন শাররি গাসিকিন ইযা ওয়াক্বাব। ওয়া মিন শাররিন নাফফাছাতি ফিল উক্বাদ। ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইযা হাসাদ।

অর্থ : বলুন আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি সকালের রবের নিকট। তার সৃষ্টি করা সব কিছুর অনিষ্ট হতে, আর রাত্রির অন্ধকারের অনিষ্ট হতে যখন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আর গিরায় ফুঁকদানকারীনীর অনিষ্ট হতে এবং হিংসুকদের অনিষ্ট হতে যখন সে হিংসা করে।

সূরা আন নাস

قُلْ أَعُوذُ  بِرَبِّ  النَّاسِ ﴿١﴾ مَلِكِ النَّاسِ ﴿٢﴾ إِلَـٰهِ النَّاسِ ﴿٣﴾ مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ ﴿٤﴾ الَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِيْ صُدُورِ النَّاسِ ﴿٥﴾ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ ﴿٦﴾

উচ্চারণ : ক্বুল আ’উযু বিরাব্বিন নাস। মলিকিন নাস। ইলাহিন নাস। মিন শাররিল ওয়াসওয়াসিল খাননাস। আল্লাযী ইউওয়াসবিসু ফি সুদুরিন নাস। মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস।

অর্থ : বলুন আমি মানুষের রব, মানুষের বাদশা, মানুষের মা’বুদের নিকট সেই বার বার ফিরে আসা কুপ্ররোচনাদাতার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে কুপ্ররোচনা দেয় মানুষের মনে- সে জ্বিন বা মানবজাতির মধ্য থেকে হোক।

সূরা আল কাফিরূন

قُلْ  يَا  أَيْهَا الْكَافِرُونَ ﴿١﴾ لَا  أَعْبُدُ  مَا  تَعْبُدُونَ ﴿٢﴾ وَلَا  أَنتُمْ عَابِدُونَ  مَا  أَعْبُدُ ﴿٣﴾ وَلَا  أَنَا عَابِدٌ  مَّا  عَبَدتُّمْ ﴿٤﴾ وَلَا أَنتُمْ  عَابِدُونَ  مَا  أَعْبُدُ ﴿٥﴾ لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ  دِيْنِ ﴿٦﴾

উচ্চারণ : ক্বুল ইয়া আইয়্যূহাল কাফেরূন। লা আ’বুদু মা তা’বুদুন ওয়ালা আনতুম আবিদুনা মা আ’বুদ। ওয়ালা আনা আবিদুম মা আবাদতুম। ওয়ালা আনতুম আবিদুনা মা আ’বুদ। লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন।

অর্থ : বলে দিন : হে কাফেররা! আমি সেই রবের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করছ। আর না তোমরা তাঁর ইবাদাত কর যার ইবাদাত আমি করি। আমি তাদের ইবাদাত করতে প্রস্তুত নই যাদের ইবাদাত তোমরা করছো। আর না তোমরা তাঁর ইবাদাত করতে প্রস্তুত যার ইবাদাত আমি করছি। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন, আর আমার জন্য আমার দ্বীন।

সূরা ইয়াসীন

يس (১) وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ (২)  إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ (৩) عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ (৪) تَنزِيلَ الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ (৫) لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أُنذِرَ آبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ (৬) لَقَدْ حَقَّ الْقَوْلُ عَلَى أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (৭) إِنَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلاَلاً فَهِيَ إِلَى الأَذْقَانِ فَهُم مُّقْمَحُونَ (৮)  وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ (৯)  وَسَوَاء عَلَيْهِمْ أَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُمْ لاَ يُؤْمِنُونَ (১০) إِنَّمَا تُنذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّكْرَ وَخَشِيَ الرَّحْمَن بِالْغَيْبِ فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَأَجْرٍ كَرِيمٍ (১১) إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ وَكُلَّ شَيْءٍ أحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِينٍ (১২) وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلاً أَصْحَابَ الْقَرْيَةِ إِذْ جَاءهَا الْمُرْسَلُونَ (১৩) إِذْ أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمُ اثْنَيْنِ فَكَذَّبُوهُمَا فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوا إِنَّا إِلَيْكُم مُّرْسَلُونَ (১৪) قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمن مِن شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ تَكْذِبُونَ (১৫) قَالُوا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُونَ (১৬) وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ (১৭) قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ (১৮) قَالُوا طَائِرُكُمْ مَعَكُمْ أَئِن ذُكِّرْتُم بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ مُّسْرِفُونَ (১৯) وَجَاء مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ (২০) اتَّبِعُوا مَن لاَّ يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُم مُّهْتَدُونَ (২১) وَمَا لِي لاَ أَعْبُدُ الَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (২২) أَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِ آلِهَةً إِن يُرِدْنِ الرَّحْمَن بِضُرٍّ لاَّ تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلاَ يُنقِذُونِ (২৩) إِنِّي إِذًا لَّفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ (২৪)  إِنِّي آمَنتُ بِرَبِّكُمْ فَاسْمَعُونِ (২৫) قِيلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُونَ (২৬) بِمَا غَفَرَ لِي رَبِّي وَجَعَلَنِي مِنَ الْمُكْرَمِينَ (২৭) وَمَا أَنزَلْنَا عَلَى قَوْمِهِ مِن بَعْدِهِ مِنْ جُندٍ مِّنَ السَّمَاء وَمَا كُنَّا مُنزِلِينَ (২৮) إِن كَانَتْ إِلاَّ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ خَامِدُونَ (২৯) يَا حَسْرَةً عَلَى الْعِبَادِ مَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ إِلاَّ كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِؤُون (৩০) أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُم مِّنْ الْقُرُونِ أَنَّهُمْ إِلَيْهِمْ لاَ يَرْجِعُونَ (৩১) وَإِن كُلٌّ لَّمَّا جَمِيعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُونَ (৩২)  وَآيَةٌ لَّهُمُ الْأَرْضُ الْمَيْتَةُ أَحْيَيْنَاهَا وَأَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَأْكُلُونَ (৩৩) وَجَعَلْنَا فِيهَا جَنَّاتٍ مِن نَّخِيلٍ وَأَعْنَابٍ وَفَجَّرْنَا فِيهَا مِنْ الْعُيُونِ (৩৪) لِيَأْكُلُوا مِن ثَمَرِهِ وَمَا عَمِلَتْهُ أَيْدِيهِمْ أَفَلَا يَشْكُرُونَ (৩৫) سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ (৩৬) وَآيَةٌ لَّهُمْ اللَّيْلُ نَسْلَخُ مِنْهُ النَّهَارَ فَإِذَا هُم مُّظْلِمُونَ (৩৭) وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (৩৮) وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ (৩৯) لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ (৪০) وَآيَةٌ لَّهُمْ أَنَّا حَمَلْنَا ذُرِّيَّتَهُمْ فِي الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ (৪১) وَخَلَقْنَا لَهُم مِّن مِّثْلِهِ مَا يَرْكَبُونَ (৪২) وَإِن نَّشَأْ نُغْرِقْهُمْ فَلَا صَرِيخَ لَهُمْ وَلَا هُمْ يُنقَذُونَ (৪৩)  إِلَّا رَحْمَةً مِّنَّا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ (৪৪)  وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّقُوا مَا بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَمَا خَلْفَكُمْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (৪৫)  وَمَا تَأْتِيهِم مِّنْ آيَةٍ مِّنْ آيَاتِ رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ (৪৬) وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ أَنفِقُوا مِمَّا رَزَقَكُمْ اللَّهُ قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنُطْعِمُ مَن لَّوْ يَشَاء اللَّهُ أَطْعَمَهُ إِنْ أَنتُمْ إِلَّا فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ (৪৭)  وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْوَعْدُ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ (৪৮)  مَا يَنظُرُونَ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً تَأْخُذُهُمْ وَهُمْ يَخِصِّمُونَ (৪৯)  فَلَا يَسْتَطِيعُونَ تَوْصِيَةً وَلَا إِلَى أَهْلِهِمْ يَرْجِعُونَ (৫০) وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ (৫১) قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَن بَعَثَنَا مِن مَّرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (৫২) إِن كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ جَمِيعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُونَ (৫৩)  فَالْيَوْمَ لَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَلَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ (৫৪)  إِنَّ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ الْيَوْمَ فِي شُغُلٍ فَاكِهُونَ (৫৫)  هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِؤُونَ (৫৬) لَهُمْ فِيهَا فَاكِهَةٌ وَلَهُم مَّا يَدَّعُونَ (৫৭)  سَلَامٌ قَوْلًا مِن رَّبٍّ رَّحِيمٍ (৫৮)  وَامْتَازُوا الْيَوْمَ أَيُّهَا الْمُجْرِمُونَ (৫৯)  أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ (৬০)  وَأَنْ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ (৬১) وَلَقَدْ أَضَلَّ مِنكُمْ جِبِلًّا كَثِيرًا أَفَلَمْ تَكُونُوا تَعْقِلُونَ (৬২) هَذِهِ جَهَنَّمُ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ (৬৩)  اصْلَوْهَا الْيَوْمَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ (৬৪)  الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (৬৫)  وَلَوْ نَشَاء لَطَمَسْنَا عَلَى أَعْيُنِهِمْ فَاسْتَبَقُوا الصِّرَاطَ فَأَنَّى يُبْصِرُونَ (৬৬) وَلَوْ نَشَاء لَمَسَخْنَاهُمْ عَلَى مَكَانَتِهِمْ فَمَا اسْتَطَاعُوا مُضِيًّا وَلَا يَرْجِعُونَ (৬৭)  وَمَنْ نُعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ أَفَلَا يَعْقِلُونَ(৬৮) وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنبَغِي لَهُ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ (৬৯) لِيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ (৭০) أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا خَلَقْنَا لَهُمْ مِمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا أَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مَالِكُونَ (৭১) وَذَلَّلْنَاهَا لَهُمْ فَمِنْهَا رَكُوبُهُمْ وَمِنْهَا يَأْكُلُونَ (৭২) وَلَهُمْ فِيهَا مَنَافِعُ وَمَشَارِبُ أَفَلَا يَشْكُرُونَ (৭৩)  وَاتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لَعَلَّهُمْ يُنصَرُونَ (৭৪)  لَا يَسْتَطِيعُونَ نَصْرَهُمْ وَهُمْ لَهُمْ جُندٌ مُّحْضَرُونَ (৭৫) فَلَا يَحْزُنكَ قَوْلُهُمْ إِنَّا نَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ (৭৬) أَوَلَمْ يَرَ الْإِنسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ (৭৭)  وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ (৭৮) قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ (৭৯) الَّذِي جَعَلَ لَكُم مِّنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنتُم مِّنْهُ تُوقِدُونَ (৮০) أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُم بَلَى وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ (৮১) إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৮২)  فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (৮৩)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

উচ্চারণ ঃ ইয়া-সী-ন্ (১) অল্ ক্ব র্নআ-নিল্ হাকীম্। (২) ইন্নাকা লামিনাল্ র্মুসালীন্। (৩) ‘আলা-ছির-ত্বিম্ মুস্তাক্বীম্। (৪) তান্যীলাল্ ‘আযীর্যি রহীম্। (৫) লিতুন্যিরা ক্বওমাম্ মা য়উন্যিরা আ-বা-য়ুহুম্ ফাহুম্ গ-ফিলূন্ । (৬) লাক্বাদ্ হাকক্বল্ ক্বওলু ‘আলা য় আক্ছারিহিম্ ফাহুম্ লা-ইয়ুমিনূন্। (৭) ইন্না-জ্বা‘আল্না-ফী য় আ’না-ক্বিহিম্ আগল্লান্ ফাহিয়া ইলাল্ আয্ক্বা-নি ফাহুম্ মুকমাহূন্। (৮) অজ্বা‘আল্না-মিম্ বাইনি আইদী হিম্ সাদ্দাঁও মিন্ খল্ফিহিম্ সাদ্দান্ ফায়াগ্শাইনা-হুম ফাহুম্ লা-ইয়ুব্ছিরূন্। (৯) অসাওয়া-য়ুন্ ‘আলাইহিম্ আ আর্ন্যাতাহুম্ আম্ লাম্ তুর্ন্যিহুম্ লা-ইয়ুমিনূন্। (১০) ইন্নামা-তুন্যিরু মানিত্তাবা‘আয্ যিকর অখশির্য়া রাহ্মা-না বিল্গাইবি ফাবার্শ্শিহু বিমাগ্ফিরতিঁও অআজরিন্ কারীম্। (১১) ইন্না-নাহ্নু নুহ্য়িল্ মাওতা- অনাক্তুবু মা-ক্বাদ্দামূ অআ-ছা-রহুম্; অকুল্লা শাইয়িন্ আহ্ছোয়াইনা-হু ফী য় ইমা-মিম্ মুবীন্। (১২) অদ্বিব্ লাহুম্ মাছালান্ আছ্হা-বাল্ র্ক্বইয়াহ্; ইয্ জ্বা-য়াহাল্ র্মুসালূন্। (১৩) ইয্ র্আসালনা য় ইলাইহিমুছ্ নাইনি ফাকায্যাবূহুমা- ফা‘আয্যায্না-বিছা-লিছিন্ ফাক্ব-লূ য় ইন্না য় ইলাইকুম্ র্মুসালূন্। (১৪) ক্বা-লূ মা য় আন্তুম ইল্লা-বাশারুম্ মিছ্লুনা- অমা য় আন্যার্লা রহ্মা-নু মিন্ শাইয়িন্ ইন্ আন্তুম ইল্লা-তাক্যিবূন্। (১৫) ক্ব-লূ রব্বুনা-ইয়া’লামু ইন্না য় ইলাইকুম্ লার্মুসালূন্। (১৬) অমা-‘আলাইনা য় ইল্লাল্ বালা-গুল্ মুবীন্। (১৭) ক্ব-লূ য় ইন্না-তাত্বোয়াইর্য়্যানা-বিকুম্, লায়িল্লাম্ তান্তাহূ লার্না জুমান্নাকুম্ অলা-ইয়ামাস্ সান্নাকুম্ মিন্না-‘আযা- বুন্ আলীম্। (১৮) ক্ব-লূ ত্বোয়া-য়িরুকুম্ মা‘আকুম্ আয়িন্ যুর্ক্কিতুম্; বাল্ আন্তুম্ ক্বওমুম্ মুস্রিফূন্। (১৯) অজ্বা-য়া মিন্ আকছোয়াল্ মাদীনাতি রাজুলুঁই ইয়াস্‘আ-ক্ব-লা ইয়া-ক্বওমিত তাবি‘উল্ মুরসালীন্ (২০) ইত্তাবি‘ঊ মাল্লা-ইয়াস্য়ালুকুম্ আজরঁও অহুম্ মুহ্তাদূন্। (২১) অমা-লিয়া লা য় আ’বুদুল্লাযী ফাত্বোয়ারানী অ ইলাইহি র্তুজ্বা‘ঊন্। (২২) আ আত্তাখিযু মিন্ দূনিহী য় আ- লিহাতান্ ইঁইয়্যুরির্দ্নি রহমা-নু বির্দ্বুরিল্ লা-তুগ্নি ‘আন্নী শাফা-‘আতুহুম্ শাইয়াঁও অলা-ইয়ুন্ক্বিযূন্। (২৩) ইন্নী য় ইযাল্লাফী দ্বলা-লিম্ মুবীন্। (২৪) ইন্নী য় আ-মান্তু বিরব্বিকুম্ ফাস্মা‘ঊন্। (২৫) ক্বীলাদ্ খুলিল্ জ্বান্নাহ্; ক্ব-লা ইয়ালাইতা ক্বওমী ইয়া’লামূন্। (২৬) বিমা-গফারলী রব্বী অ জ্বা‘আলানী মিনাল্ মুক্রমীন্। (২৭) অমা য় আন্যাল্না ‘আলা- ক্বওমিহী মিম্ বা’দিহী মিন্ জুন্দিম্ মিনাস্ সামা-য়ি অমা- কুন্না-মুন্যিলীন্। (২৮) ইন্ কা-নাত্ ইল্লা-ছোয়াইহাতাঁও ওয়া-হিদাতান্ ফাইযা-হুম্ খ-মিদূন্। (২৯) ইয়া-হাস্রতান্ ‘আলাল্ ‘ইবা-দি মা-ইয়াতীহিম্ র্মি রসূলিন্ ইল্লা-কা-নূ বিহী ইয়াস্তাহ্যিয়ূন্। (৩০) আলাম্ ইয়ারও কাম্ আহ্লাক্না-ক্ববলাহুম্ মিনাল্ কুরূনি আন্নাহুম্ ইলাইহিম্ লা-ইর্য়াজ্বি‘ঊন্। (৩১) অইন্ কুল্লুললাম্মা-জ্বামী‘উল্লাদাইনা-মুহ্দ্বোয়ারূন্। (৩২) অ আ-ইয়াতু ল্লাহুমুল্ র্আদুল্ মাইতাতু আহ্ইয়াইনা-হা অ আখ্রজনা-মিন্হা-হাব্বান্ ফামিন্হু ইয়াকুলূন্। (৩৩) অজ্বা‘আল্না- ফীহা-জ্বান্না-তিম্ মিন্ নাখীলিঁও অআ’না বিঁও অফার্জ্জ্বানা-ফীহা-মিনাল্ ‘উইয়ূন্। (৩৪) লিয়াকুলূ মিন্ ছামারিহী অমা ‘আমিলাত্হু আইদীহিম্; আফালা-ইয়াশ্কুরূন্। (৩৫) সুব্হা-নাল্লাযী খলাক্বল্ আয্ওয়াজ্বা কুল্লাহা-মিম্মা-তুম্বিতুল্ র্আদু অমিন্ আন্ফুসিহিম্ অমিম্মা-লা-ইয়া’লামূন্। (৩৬) অআ-ইয়াতুল্লা হুমুল্ লাইলু নাস্তাখু মিন্ হুন্নাহা-র ফাইযা-হুম্ মুজ্লিমূন্ (৩৭) অশ্শাম্সু তাজ্ব্রী লিমুস্তার্ক্বরিল্লাহা-; যা-লিকা তাকদীরুল্ ‘আযীযিল্ ‘আলীম্। (৩৮) অল্ ক্বমার ক্বর্দ্দানা-হু মানা-যিলা হাত্তা- ‘আ-দা কাল্ ‘র্উজুনিল্ ক্বদীম্। (৩৯) লাশ্ শাম্সু ইয়াম্বাগী লাহা য় আন্ তুদ্রিকাল্ ক্বমার অলাল্লাইলু সা-বিকুন্ নাহার্-; অ কুল্লুন্ ফী ফালাকিইঁ ইয়াস্বাহূন্। (৪০) অ আ-ইয়াতুল্লাহুম্ আন্না-হামাল্না র্যুরিয়্যাতাহুম্ ফিল্ ফুল্কিল্ মাশ্হূন্। (৪১) অখলাক্ব্না-লাহুম্ মিম্ মিছ্লিহী মা-ইর্য়াকাবূন্। (৪২) অইন্ নাশানুগ্রিক হুম্ ফালা-ছোয়ারীখ লাহুম্ অলা-হুম্ ইয়ুন্ক্বযূন্। (৪৩) ইল্লা-রহ্মাতাম্ মিন্না- অমাতা-‘আন্ ইলা-হীন্। (৪৪) অইযা-ক্বীলা লাহুমুত্তাকু মা-বাইনা আইদীকুম্ অমা-খল্ফাকুম্ লা‘আল্লাকুম্ র্তুহামূন্। (৪৫) অমা-তাতীহিম্ মিন্ আ-ইয়া-তীম্ মিন্ আ-ইয়া-তি রব্বিহিম্ ইল্লা-কা-নূ ‘আন্হা-মু’রিদ্বীন্। (৪৬) অ ইযা- ক্বীলা লাহুম্ আনফিকু মিম্মা-রযাক্ব কুমুল্লা-হু ক্ব-লাল্লাযীনা কাফারূ লিল্লাযীনা আ-মানূ য় আনুত্ব‘ইমু মাল্লাও ইয়াশা-য়ুল্লা-হু আত্ব্‘আমাহূ য় ইন্ আন্তুম্ ইল্লা-ফী দ্বোয়ালা-লিম্ মুবীন্। (৪৭) অ ইয়াকুলূনা মাতা-হা-যাল্ ওয়া’দু ইন্ কুন্তুম্ ছোয়া-দিক্বীন্ (৪৮) মা-ইয়ান্জুরূনা ইল্লা-ছোয়াইঁহাতাওঁ ওয়া-হিদাতান্ তাখুযুহুম্ অহুম্ ইয়াখিছ্ছিমূন্। (৪৯) ফালা-ইয়াস্তাত্বী‘ঊনা তাওছিয়াতাঁও অলা য় ইলা য় আহ্লিহিম্ ইর্য়াজ্বি‘ঊন্। (৫০) অনুফিখ ফিছ্ ছূরি ফাইযা-হুম্ মিনাল্ আজদা-ছি ইলা-রব্বিহিম্ ইয়ান্সিলূন্। (৫১)ক্ব-লূ ইয়া-অইলানা-মাম্ বা‘আছানা-মিম্ র্মাক্বদিনা-,হা-যা-মা-অ‘আর্দা রহ্মা-নু অ ছদাক্বাল্ র্মুসালূন্। (৫২) ইন্ কা- নাত্ ইল্লা- ছোয়াইহাতাঁও ওয়া-দাহিদাতান্ ফাইযা-হুম্ জ্বামী‘উল্ লাদাইনা-মুহ্দ্বোয়ারূন্। (৫৩) ফাল্ ইয়াওমা লা-তুজ্লামু নাফ্সুন্ শাইয়াঁও অলা-তুজযাওনা ইল্লা-মা-কুন্তুম্ তা’মালূন্। (৫৪) ইন্না আছ্হা-বাল্ জ্বান্নাতিল্ ইয়াওমা ফী শুগুলিন্ ফাকিহূন্। (৫৫) হুম্ অআয্ওয়া-জুহুম্ ফী জিলা-লিন্ ‘আলাল্ আর-য়িকি মুত্তাকিয়ূন্। (৫৬) লাহুম্ ফীহা-ফা-কিহাতুঁও অলাহুম্ মা- ইয়াদ্দা‘ঊন্। (৫৭) সালা-মুন্ ক্বওলাম্ র্মি রর্ব্বি রহীম্। (৫৮) ওয়াম্তা-যুল্ ইয়াওমা আইয়ুহাল্ মুজরিমূন্। (৫৯) আলাম্ আ’হাদ্ ইলাইকুম্ ইয়া-বানী য় আ-দামা আল্লা-তা’বুদুশ্ শাইত্বোয়া-না ইন্নাহূ লাকুম্ ‘আদুওয়্যুম্ মুবীন্। (৬০) অআ নি’বুদূনী হা-যা-ছির- তুম্ মুস্তাক্বীম্। (৬১) অলাক্বদ্ আদ্বোয়াল্লা মিন্কুম্ জ্বিবিল্লান্ কাছীর-; আফালাম্ তাকূনূ তা’ক্বিলূন্। (৬২) হা-যিহী জ্বাহান্নামুল্লাতী কুন্তুম্ তূ‘আদূন্। (৬৩) ইছ্লাওহাল্ ইয়াওমা বিমা-কুন্তুম্ তাক্ফুরূন্। (৬৪) আল্ইয়াওমা নাখ্তিমু ‘আলা য় আফ্ওয়া-হিহিম্ অ তুকাল্লিমুনা য় আইদীহিম্ অতাশ্হাদু র্আজুলুহুম্ বিমা-কা-নূ ইয়াক্সিবূন্। (৬৫) অলাও নাশা-য়ু লাত্বোয়ামাস্না-‘আলা য় আ’ ইয়ুনিহিম্ ফাস্তাবাক্বছ্ ছির-ত্বোয়া ফাআন্না-ইয়ুব্ছিরূন্। (৬৬) অলাও নাশা-য়ু লামাসাখ্না-হুম্ ‘আলা-মাকা-নাতিহিম্ ফামাস্ তাত্বোয়া-‘ঊ মুদ্বিয়্যাওঁ অলা- ইর্য়াজ্বি‘ঊন্। (৬৭) অ মান্ নু‘আ র্ম্মিহু নুনাক্কিস্হু ফিল্ খল্ক্ব ; আফালা-ইয়া’ক্বিলূন্। (৬৮) অমা-‘আল্লাম্না-হুশ্ শি’রা অমা-ইয়াম্বাগী লাহ্; ইন্ হুওয়া ইল্লা-যিক্রুঁও অক্বর্ আ-নুম্ মুবীন্। (৬৯) লিইয়ুন্যির মান্ কা-না হাইয়্যাঁও অ ইয়াহিকক্বল্ ক্বওলু ‘আলাল্ কা-ফিরীন্। (৭০) আওয়া লাম্ ইয়ারাও আন্না-খলাক্না-লাহুম্ মিম্মা-‘আমিলাত্ আইদীনা য় আন্‘আ-মান্ ফাহুম্ লাহা-মা-লিকূন্। (৭১) অ যাল্লাল্না-হা লাহুম্ ফামিন্হা- রকূবুহুম্ অ মিন্হা-ইয়াকুলূন্। (৭২) অলাহুম্ ফীহা-মানা-ফি‘ঊ অমাশা-রিব্; আফালা- ইয়াশ্কুরূন্। (৭৩) অত্তাখযূ মিন্ দূনিল্লা-হি আ-লিহাতাল্ লা‘আল্লাহুম্ ইয়ুন্ছোয়ারূন্। (৭৪) লা-ইয়াস্তাত্বী‘ঊনা নাছ্রহুম্ অহুম্ লাহুম্ জ্বুন্দুম্ মুহ্দ্বোয়ারূন্। (৭৫) ফালা- ইয়াহ্যুন্কা ক্বওলুহুম্; ইন্না-না’লামু মা-ইয়ুর্সিরূনা অমা-ইয়ু’লিনূন্। (৭৬) আওয়ালাম্ ইয়ারল্ ইন্সা-নু আন্না-খলাক্ব্ না-হু মিন্ নুত্ব্ ফাত্ব্ন্ ফাইযা-হুঅ খছীমুম্ মুবীন্। (৭৭) অ দ্বোয়ারাবা লানা-মাছালাঁও অ নাসিয়া খল্ক্বাহ্; ক্ব-লা মাইঁ ইয়ুহ্য়িল্ ‘ইজোয়া-মা অহিয়া রমীম্। (৭৮) কুল্ ইয়ুহ্য়ীহাল্লাযী য় আন্শায়াহা য় আও অলা র্মারাহ্; অহুওয়া বিকুল্লি খল্ক্বিন্ ‘আলীমুনি। (৭৯) ৩৬.৮০। ল্লাযী জ্বা‘আলা লাকুম্ মিনাশ্ শাজ্বারিল্ আখ্দ্বোয়ারি না-রন্ ফাইযা য় আন্তুম্ মিন্হু তূক্বিদূ ন্। (৮০) আওয়া লাইসাল্লাযী খলাক্বস্ সামা-ওয়া-তি অল্ র্আদ্বোয়া বিক্ব-দিরিন্ ‘আলা য় আইঁ ইয়াখ্লুক্ব মিছ্লাহুম্; বালা-অহুওয়াল্ খল্লাকুল্ ‘আলীম্। (৮১) ইন্নামা য় আম্রুহূ য় ইযা য় আর-দা শাইয়ান্ আইঁ ইয়াকুলা লাহূ কুন্ ফাইয়াকূন্ (৮২) ফাসুব্হা-নাল্ লাযী বিয়াদিহী মালাকূতু কুল্লি শাইয়িঁও অ ইলাইহি র্তুজ্বাঊ’ন্ (৮৩)

অর্থ ঃ ইয়া-সীন (১) প্রজ্ঞাময় কোরআনের কসম। (২) নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রসূলগণের একজন। (৩) সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। (৪) কোরআন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ (৫) যাতে আপনি এমন এক জাতিকে সতর্ক করেন, যাদের পূর্ব পুরুষগণকেও সতর্ক করা হয়নি। ফলে তারা গাফেল। (৬) তাদের অধিকাংশের জন্যে শাস্তির বিষয় অবধারিত হয়েছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না। (৭) আমি তাদের গর্দানে চিবুক পর্যন্ত বেড়ী পরিয়েছি। ফলে তাদের মস্তক উর্দ্ধমুখী হয়ে গেছে। (৮) আমি তাদের সামনে ও পিছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা দেখে না। (৯) আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন বা না করুন, তাদের পক্ষে দুয়েই সমান; তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না। (১০) আপনি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দিন ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের। (১১) আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি। (১২) আপনি তাদের কাছে সে জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করুন, যখন সেখানে রসূল আগমন করেছিলেন। (১৩) আমি তাদের নিকট দুজন রসূল প্রেরণ করেছিলাম, অতঃপর ওরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। তখন আমি তাদেরকে শক্তিশালী করলাম তৃতীয় একজনের মাধ্যমে। তারা সবাই বলল, আমরা তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। (১৪) তারা বলল, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, রহমান আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলে যাচ্ছ। (১৫) রাসূলগণ বলল, আমাদের পরওয়ারদেগার জানেন, আমরা অবশ্যই তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। (১৬) পরিস্কারভাবে আল্লাহর বাণী পৌছে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব। (১৭) তারা বলল, আমরা তোমাদেরকে অশুভ-অকল্যাণকর দেখছি। যদি তোমরা বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। (১৮) রসূলগণ বলল, তোমাদের অকল্যাণ তোমাদের সাথেই! এটা কি এজন্যে যে, আমরা তোমাদেরকে সদুপদেশ দিয়েছি? বস্তুতঃ তোমরা সীমা লংঘনকারী সম্প্রদায় বৈ নও। (১৯) অতঃপর শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি দৌড়ে এল। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা রসূলগণের অনুসরণ কর। (২০) অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত। (২১)  আমার কি হল যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে, আমি তাঁর এবাদত করব না? (২২) আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। (২৩) এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হব। (২৪) আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব আমার কাছ থেকে শুনে নাও। (২৫) তাকে বলা হল, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলল হায়, আমার সম্প্রদায় যদি কোন ক্রমে জানতে পারত- (২৬) যে আমার পরওয়ারদেগার আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (২৭) তারপর আমি তার সম্প্রদায়ের উপর আকাশ থেকে কোন বাহিনী অবতীর্ণ করিনি এবং আমি (বাহিনী) অবতরণকারীও না। (২৮) বস্তুতঃ এ ছিল এক মহানাদ। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্তদ্ধ হয়ে গেল। (২৯) বান্দাদের জন্যে আক্ষেপ যে, তাদের কাছে এমন কোন রসূলই আগমন করেনি যাদের প্রতি তারা বিদ্রুপ করে না। (৩০) তারা কি প্রত্যক্ষ করে না, তাদের পূর্বে আমি কত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি যে, তারা তাদের মধ্যে আর ফিরে আসবে না। (৩১) ওদের সবাইকে সমবেত অবস্থায় আমার দরবারে উপস্থিত হতেই হবে। (৩২) তাদের জন্যে একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা থেকে ভক্ষণ করে। (৩৩) আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং প্রবাহিত করি তাতে নির্ঝরিণী। (৩৪) যাতে তারা তার ফল খায়। তাদের হাত একে সৃষ্টি করে না। অতঃপর তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না কেন? (৩৫) পবিত্র তিনি যিনি যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, তাদেরই মানুষকে এবং যা তারা জানে না, তার প্রত্যেককে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন। (৩৬) তাদের জন্যে এক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়। (৩৭) সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। (৩৮) চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। (৩৯) সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। (৪০) তাদের জন্যে একটি নিদর্শন এই যে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিকে বোঝাই নৌকায় আরোহণ করিয়েছি। (৪১) এবং তাদের জন্যে নৌকার অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি, যাতে তারা আরোহণ করে। (৪২) আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে নিমজ্জত করতে পারি, তখন তাদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই এবং তারা পরিত্রাণও পাবে না। (৪৩) কিন্তু আমারই পক্ষ থেকে কৃপা এবং তাদেরকে কিছু কাল জীবনোপভোগ করার সুযোগ দেয়ার কারণে তা করি না। (৪৪) আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা সামনের আযাব ও পেছনের আযাবকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়, তখন তারা তা অগ্রাহ্য করে। (৪৫) যখনই তাদের পালনকর্তার নির্দেশাবলীর মধ্যে থেকে কোন নির্দেশ তাদের কাছে আসে, তখনই তারা তা থেকে মুখে ফিরিয়ে নেয়। (৪৬) যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় কর। তখন কাফেররা মুমিনগণকে বলে, ইচ্ছা করলেই আল্লাহ যাকে খাওয়াতে পারতেন, আমরা তাকে কেন খাওয়াব? তোমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত রয়েছ। (৪৭) তারা বলে, তোমরা সত্যবাদী হলে বল এই ওয়াদা কবে পূর্ণ হবে? (৪৮) তারা কেবল একটা ভয়াবহ শব্দের অপেক্ষা করছে, যা তাদেরকে আঘাত করবে তাদের পারস্পরিক বাকবিতন্ডাকালে। (৪৯) তখন তারা ওছিয়ত করতেও সক্ষম হবে না। এবং তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারবে না। (৫০) শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। (৫১) তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উখিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রসূলগণ সত্য বলেছিলেন। (৫২) এটা তো হবে কেবল এক মহানাদ। সে মুহুর্তেই তাদের সবাইকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে। (৫৩) আজকের দিনে কারও প্রতি জুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা করবে কেবল তারই প্রতিদান পাবে। (৫৪) এদিন জান্নাতীরা আনন্দে মশগুল থাকবে। (৫৫) তারা এবং তাদের স্ত্রীরা উপবিষ্ট থাকবে ছায়াময় পরিবেশে আসনে হেলান দিয়ে। (৫৬) সেখানে তাদের জন্যে থাকবে ফল-মূল এবং যা চাইবে। (৫৭) করুণাময় পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হবে সালাম। (৫৮) হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও। (৫৯) হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্রু? (৬০) এবং আমার এবাদত কর। এটাই সরল পথ। (৬১) শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বুঝনি? (৬২) এই সে জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হতো। (৬৩) তোমাদের কুফরের কারণে আজ এতে প্রবেশ কর। (৬৪) আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে। (৬৫) আমি ইচ্ছা করলে তাদের দৃষ্টি শক্তি বিলুপ্ত করে দিতে পারতাম, তখন তারা পথের দিকে দৌড়াতে চাইলে কেমন করে দেখতে পেত! (৬৬) আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্ব স্ব স্থানে আকার বিকৃত করতে পারতাম, ফলে তারা আগেও চলতে পারত না এবং পেছনেও ফিরে যেতে পারত না। (৬৭) আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি, তাকে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেই। তবুও কি তারা বুঝে না? (৬৮) আমি রসূলকে কবিতা শিক্ষা দেইনি এবং তা তার জন্যে শোভনীয়ও নয়। এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কোরআন। (৬৯) যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। (৭০) তারা কি দেখে না, তাদের জন্যে আমি আমার নিজ হাতের তৈরী বস্তুর দ্বারা চতুস্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তারাই এগুলোর মালিক। (৭১) আমি এগুলোকে তাদের হাতে অসহায় করে দিয়েছি। ফলে এদের কতক তাদের বাহন এবং কতক তারা ভক্ষণ করে। (৭২) তাদের জন্যে চতুস্পদ জন্তুর মধ্যে অনেক উপকারিতা ও পানীয় রয়েছে। তবুও কেন তারা শুকরিয়া আদায় করে না? (৭৩) তারা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যাতে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারে। (৭৪) অথচ এসব উপাস্য তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম হবে না এবং এগুলো তাদের বাহিনী রূপে ধৃত হয়ে আসবে। (৭৫) অতএব তাদের কথা যেন আপনাকে দুঃখিত না করে। আমি জানি যা তারা গোপনে করে এবং যা তারা প্রকাশ্যে করে। (৭৬) মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি বীর্য থেকে? অতঃপর তখনই সে হয়ে গেল প্রকাশ্য বাকবিতন্ডাকারী। (৭৭)  সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভূত কথা বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে কে জীবিত করবে অস্থিসমূহকে যখন সেগুলো পচে গলে যাবে? (৭৮) বলুন, যিনি প্রথমবার সেগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জীবিত করবেন। তিনি সর্বপ্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত। (৭৯) যিনি তোমাদের জন্যে সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন উৎপন্ন করেন। তখন তোমরা তা থেকে আগুন জ্বালাও। (৮০) যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যাঁ তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। (৮১) তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, ‘হও’ তখনই তা হয়ে যায়। (৮২) অতএব পবিত্র তিনি, যাঁর হাতে সবকিছুর রাজত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (৮৩)

You may also like