Home ইসলাম কুরআন তিলাওয়াতের আদব

কুরআন তিলাওয়াতের আদব

by admin
0 comment

কুরআন কিন্তু যেনতেন কোনো গ্রন্থ না। এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। অতএব এটাকে আমরা অন্য দশটি বইয়ের মতো পড়তে পারি না। এটি পাঠ করার আগে–পিছে কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নইলে তা আমাদের জন্য নেকীর পরিবর্তে পাপই বয়ে আনবে। কুরআন পড়তে গিয়ে তাই বেশ কিছু আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। চলুন এবার আমরা সেসব আদব সম্পর্কে জেনে নেই।

১. নিয়ত খালেস করা : কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে নিয়ত খালেস করা।

ক) আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন : “সুতরাং তোমরা আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সাথে ডাক।”

খ) আল্লাহতায়ালা বলেন : “সুতরাং তুমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত কর।”

গ) আল্লাহতায়ালা বলেন : “তাদের এ জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে, এখলাসের সাথে।”

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করছেন : “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং এ তিলাওয়াত দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। সে দলের আবির্ভাবের পূর্বে যারা কুরআনকে তীরের ন্যায় স্থাপন করবে। কুরআন দ্রুত পড়বে, ধীর স্থীরভাবে পড়বে না।”

নিয়ত শুদ্ধ করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতেরদিন তিন শ্রেণীর লোকের ওপর আগুনের শাস্তি কঠোর করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ক্বারী। আর কুরআন তিলাওয়াত কারী ক্বারী সাহেবকে আগুনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে এ কারণে যে তিনি ইখলাসের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতেন না। অনুরূপভাবে কিয়ামতেরদিন প্রথম যে তিন শ্রেণীর লোককে তীব্র অগ্নিযাতনায় নিক্ষেপ করা হবে তাদের মধ্যেও একজন এই ক্বারী। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘যখন কিয়ামতের দিন হবে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা তাঁর বান্দাদের বিচারের উদ্দেশে আবির্ভূত হবেন।

তখন প্রতিটি জাতি ভয়ে নতজানু হয়ে পড়বে। বান্দাদের মধ্যে প্রথমে ডাকা হবে কুরআনের বাহক, আল্লাহর পথে শহীদ ও সম্পদশালী ব্যক্তিকে। ক্বারীর উদ্দেশে আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাকে তা শিখায়নি যা আমার রাসূলের ওপর নাজিল করেছিলাম? বলবে, জি, হে আমার রব। আল্লাহতায়ালা বলবেন, সুতরাং তুমি যা শিখেছো তার কী আমল করেছো? সে বলবে, আমি দিন–রাতের নানা প্রহরে নামাজে এ কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। ফেরেশতারাও তার উদ্দেশে বলবে, তুমি মিথ্যা বলেছো।

তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলবেন, বরং তোমার অভিপ্রায় ছিল লোকেরা তোমাকে ক্বারী বলে ডাকবে। আর তা তো তোমাকে বলা হয়েছেই। ফলে তুমি দুনিয়াতেই তোমার প্রতিদান পেয়ে গেছো। তুমি দুনিয়াতেই তোমার প্রতিদান পেয়ে গেছো।’ (হাদীসের পরের অংশে রয়েছে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের হেফাজত করুন) অতএব কুরআন তিলাওয়াত করার আগে প্রথম আমাদের নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে।

২.অযু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা : পবিত্র হয়ে অযু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা। অযু ছাড়াও কুরআন পড়া যাবে; কিন্তু তা অযু অবস্থায় পড়ার সমান হতে পারে না।

৩.একনিষ্ঠভাবে কুরআন পাঠ করা : একনিষ্ঠ মন নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। যা পড়া হয় তা নিয়ে গভীর চিন্তা–ভাবনা করা, তার অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা, বিনয়ীভাব গ্রহণ করা এবং নিজকে এমনভাবে হাজির করা যেন আল্লাহর সাথে সংলাপ হচ্ছে। বাস্তবেও কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে সংলাপ,যেহেতু কুরআন আল্লাহতায়ালারই বাণী

৪.মিসওয়াক করা : কুরআন তিলাওয়াতের আগে মিসওয়াক করা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘তোমাদের মুখগুলো কুরআনের পথ। তাই সেগুলোকে মিসওয়াক দ্বারা সুরভিত করো।’ (ইবনে মাযাহ)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো বান্দা নামাজে দাঁড়ায়, তখন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি মনোযোগসহ তিলাওয়াত শোনেন আর এগিয়ে আসেন। এভাবে সে পড়তে থাকে আর তিনি এগোতে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ স্থাপন করেন ওই তিলাওয়াত কারীর মুখের ওপর। সে একটি আয়াত তিলাওয়াত করে তা ফেরেশতার পেটে প্রবেশ করে।’ অতএব তিলাওয়াত কারীর উচিৎ মিসওয়াক করে তিলাওয়াত করা যাতে ফেরেশতা তার মুখের গন্ধে কষ্ট না পান।

৫.পবিত্র অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা : পবিত্র অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা। অপবিত্র ব্যক্তি বা যার উপর গোসল ফরজ, সে পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত কুরআন পাঠ করবে না। সম্ভব হলে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে অন্যথায় তয়াম্মুম দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে। তবে গোসল ব্যতীত আল্লাহর যিকির করতে পারবে এবং কুরআনে আছে এমন দোয়া পাঠ করতে পারবে, কিন্তু কুরআন পাঠের নিয়তে নয়। যেমন সে বলতে পারে : “আল্লাহ তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয় আমি জালিমদের অর্ন্তভুক্ত।” কিংবা পড়তে পারবে : “হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে হেদায়েত দান করার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করে দিওনা। আর তুমি তোমার পক্ষ থেকে দান কর আমাদের রহমত। নিশ্চয় তুমি অফুরন্ত দানশীল।”

৬.আউযুবিল্লাহ পড়া : কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে আউযুবিল্লাহ পড়া। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “যখন তুমি কুরআন পাঠ কর, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও।

আয়াতের অর্থ কুরআন পড়ার শুরুতে। কতিপয় বিজ্ঞ আলিম বলেন, এ আয়াতের দাবী অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াতের সূচনায় ‘তাআউউয’ (আউযুবিল্লাহ) পড়া ওয়াজিব। অবশ্য আলিমদের সর্বসম্মত মত হলো এটি মুস্তাহাব।

যাতে তিলাওয়াতের সর্বক্ষেত্রে শয়তানের বাধা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। সূরার মাঝখান থেকে তিলাওয়াত করলে বিসমিল্লাহ পড়ার প্রয়োজন নেই, শুধু আউজুবিল্লাহ পড়লেই চলবে, সূরার শুরু থেকে পাঠ করলে বিসমিল্লাহ পড়বেন। অবশ্য সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়বেন না। কারণ এ সূরার প্রথমে বিসমিল্লাহ নেই।

৭. ময়লা আবর্জনা আছে এমন স্থানে কুরআন তিলওয়াত না করা : ময়লা আবর্জনা আছে এমন স্থানে কুরআন তিলওয়াত না করা। যেখানে গান–বাদ্য বা শোরগোল হচ্ছে এমন জায়গায় কুরআন তিলাওয়াত না করা। এ সব জায়গায় কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআনের সাথে অসম্মান ও অপমান জনিত ব্যবহার করার শামিল। প্রশ্রাব কিংবা পায়খানার জন্য তৈরীকৃত স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েজ নেই।

৮.বিসমিল্লাহ পড়া : বিসমিল্লাহ পড়া। তিলাওয়াত কারীর উচিত সূরা তাওবা ছাড়া সকল সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে তিনি এক সূরা শেষ করে বিসমিল্লাহ বলে আরেক সূরা শুরু করতেন। কেবল সূরা আনফাল শেষ করে তাওবা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তেন না।

৯.তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া : তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা তারতীলের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত কর।’

১.রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্ত্রীকে তাঁর তিলাওয়াতের ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা সেভাবে পড়তে পারবে না। বলা হলো, আপনি আমাদের তা কেমন বলুন। তখন তিনি একটি কিরআত পড়লেন। তিনি স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে পড়লেন।

২.হযরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত কেমন ছিলো? তিনি বলেন, তিনি টেনে টেনে (মদসহ) পড়তেন।

৩.হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এক ব্যক্তি বলল, আমি এক রাক‘আতে ‘মুফাসসালে’র একটি সূরা পড়ি।

৪.হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বললেন, কাব্যের মতো স্বচ্ছন্দে!? (তিনি তার পড়ার দ্রুতগতির কথা ভেবে বিস্মিত হলেন) নিশ্চয় একটি সম্প্রদায় কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ সে তিলাওয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করে না। কিন্তু তা যখন অন্তরে পতিত হয় এবং তাতে গেঁথে যায়, তখন তা উপকারে আসে।

৫.হযরত ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা একে (কুরআন) নষ্ট খেজুরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ো না কিংবা কবিতার মতো গতিময় ছন্দেও পড়ো না। বরং এর যেখানে বিস্ময়ের কথা আছে সেখানে থামো এবং তা দিয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করো। আর সূরার সমাপ্তিতে পৌঁছা যেন তোমাদের কারো লক্ষ্য না হয়।’ বলাবাহুল্য, তারতীলের সঙ্গে তিলাওয়াত করা কুরআন নিয়ে চিন্তা করা এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক।

১০. তিলাওয়াতের কণ্ঠ সুন্দর করা : কুরআন তারতীল বা ধীর স্থীরভাবে সুন্দর করে তিলাওয়াত করা। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : “তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে তিলাওয়াত কর।” কুরআন তিলাওয়াত করবে ধীর স্থীরভাবে। কারণ ধীর স্থীরভাবে তিলাওয়াত করলে শব্দ ও অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ করা যায় এবং কুরআনের অর্থ অনুধাবন করার জন্যও সহায়ক হয়। সহীহ বুখারীতে এসেছে : “আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কেরাতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, তার কেরাত ছিল দীর্ঘ আকারের, টেনে টেনে তিনি তিলাওয়াত করতেন। এরপর তিনি রাসূলের তিলাওয়াত নকল করার জন্য পড়লেন : তিনি ‘আল্লাহ, রাহমান ও রাহীম শব্দে মদ করলেন।

হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : “রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা একটা আয়াত, আলাদা আলাদা করে পড়তেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :“তোমরা বালু ছিটানোর মত ও কবিতার আবৃতি দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত কর না। কুরআনের বিস্ময়কর বিষয়ের নিকট থামো এবং কুরআন দ্বারা তোমাদের অন্তরসমূহকে আন্দোলিত কর। তোমাদের কারো সূরা শেষ করা–ই যেন তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য না হয়।”

তিলাওয়াতের কণ্ঠ সুন্দর করা এবং সুর দিয়ে তিলাওয়াত করা। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনের ক্ষেত্রে আওয়াজ সুন্দর করার জন্য যতটুকু তাগিদ দিয়েছেন, অন্য কোন বিষয়ে তত তাগিদ দেননি।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত জুবাইর ইবনে মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “আমি মাগরিব নামাযে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরায়ে তুর পড়তে শুনেছি। এত সুন্দর কণ্ঠ ও কেরাত আমি আর কারো থেকে শুনিনি।”

সুন্দর করে মনের মাধুরী মিশিয়ে কুরআন পড়া। হযরত বারা’ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি এশার নামাজে সূরা তীন পড়েছেন। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি।’

হযরত বারা’ বিন আযেব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজ কণ্ঠ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য দান করো। কারণ সুরেলা কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।’ অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সুকণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য।’

উল্লেখিত উভয় হাদীসই বিশুদ্ধ। উল্লেখ্য যে, সুকণ্ঠ দিয়ে তিলাওয়াতের মধ্যে রয়েছে একে সৌন্দর্য দান, শ্রীবৃদ্ধিকরণ ও নতুনত্ব আনয়ন। সুরারোপ করে কুরআন তিলাওয়াত করা। এটি সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াতেরই অংশ বিশেষ। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মত নয় যে সুরসহযোগে কুরআন পড়ে না।’

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,‘আল্লাহতায়ালা কোনো রাসূলকে এতটুকু সূর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন রাসূলকে কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন।’ অতএব বুঝা গেল সুর দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআন তিলাওয়াতের আদবের অন্তর্ভুক্ত এবং তা মুস্তাহাব।

১১.উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ না করা : অন্যের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এমন উচ্চ আওয়াজে কুরআন পড়বে না।

কারো কষ্টের কারণ হলে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করবে না। যেমন নামাযী, ঘুমন্ত বা অসুস্থ ব্যক্তির নিকট। একদা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতক সাহাবাদের দেখলেন, তারা নামাযে উচ্চ স্বরে কেরাতে পড়ছে, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন : “নামাযী ব্যক্তি নিজ রব আল্লাহর সাথে মোনাজাত করে, অতএব তার লক্ষ্য রাখা উচিত, কিভাবে সে প্রার্থনা করবে। কুরআন পাঠের সময় একজনের আওয়াজ অপর জনের আওয়াজের চেয়ে যেন উচ্চ না হয়।”

উচ্চারণে জোর দিয়ে পড়া। অর্থাৎ তিলাওয়াত কারী পুরুষ হলে মেয়েদের মতো কণ্ঠ মোলায়েম করে পড়বে না। তদ্রুপ তিলাওয়াত কারী নারী হলে পুরুষের মতো করে উচ্চস্বরে পড়বে না। প্রত্যেকে নিজের স্বাভাবিক স্বরে কুরআন পড়বে। আল্লাহতায়ালার পবিত্র গ্রন্থ আবৃত্তি করতে গিয়ে কেউ কারও নকল করবে না।

একজন আরেকজনের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত না করা। কারণ এভাবে স্বর উঁচু করার মধ্য দিয়ে অন্যকে কষ্ট দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মনে রেখো, তোমরা সবাই আপন রবের সঙ্গে সঙ্গোপনে কথা বলছো। অতএব একে অপরকে কষ্ট দেবে না। একজন অপরের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত করবে না।’

হযরত আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু–কে রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন পাঠের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তিনি টেনে টেনে পড়তেন। ”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করার সময় ”বিসমিল্লাহ্” টেনে পড়তেন, একইভাবে ”আররাহমান” টেনে পড়তেন, ”আররাহীম” টেনে পড়তেন। (সহীহ আল বুখারী)

১২.তেলাওয়াতে সেজদা

তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত এলে সিজদা দেয়া। সিজদার নিয়ম হলো, তাকবীর দিয়ে সিজদায় চলে যাওয়া।

কুরআন তিলাওয়াতের সময় সেজদার আয়াত আসলে সেজদা করা, তবে ওজু থাকা জরুরি। সিজদার নিয়ম : প্রথমে আল্লাহু আকবার বলে সিজাদায় যাবে এবং সিজদায় গিয়ে বলবে : সুবাহানা রাব্বিয়াল আলা অতঃপর দোয়া করবে। সিজদা থেকে তাকবীর বলে মাথা উঠাবে, তবে নামাজের ন্যায় সালাম ফিরাবে না।

বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সিজদায় মাথা উঠাতে ও নামাতে তাকবির বলতেন। তিনি বলতেন,

“রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এরূপ করেছেন।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্যেকবার মাথা উঠাতে ও নামাতে, বসতে ও দাঁড়াতে তাকবির বলতে দেখেছি।” এ হাদিস নামাযের সিজদা ও নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতের সিজদা উভয়কেই শামিল করে। এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের কতিপয় আদব।

১৩.ওয়াকফ করা : আয়াত শেষে ওয়াকফ করা। কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, আয়াতের সমাপ্তি স্থলে ওয়াকফ করা। যদিও তা অর্থগত দিক থেকে পরবর্তী আয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কারণ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে কেটে কেটে পড়তেন। ওয়াকফ করতেন। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে টুকরো টুকরো করে পড়তেন।

১৪. ঘুম পেলে বা ঝিমুলি এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা : রাতে ঘুম পেলে বা ঝিমুনি এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ে, ফলে তার জিহ্বায় কুরআন এমনভাবে জড়িয়ে আসে যে সে কী পড়ছে তা টের না পায়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।’ অর্থাৎ তার উচিত এমতাবস্থায় নামাজ না পড়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। যাতে তার মুখে কুরআন ও অন্য কোনো শব্দের মিশ্রণ না ঘটে এবং কুরআনের আয়াত এলোমেলো হয়ে না যায়।

১৫.ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা : ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীলংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়বে! তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য।’ (সহীহ মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘তোমরা (লোকজনকে) একত্রিত করো। আমি তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো। ফলে সাহাবীদের মধ্যে যারা ছিলেন সমবেত হলেন। অতপর তিনি তাঁদের সামনে কুলহু আল্লাহহু আহাদ (সূরা ইখলাস) পড়লেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন আমরা একে অপরকে বলতে লাগলাম, এটা বোধ হয় আসমান থেকে আসা কোনো খবর, যা সংগ্রহ করতে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। এক্ষণে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বের হলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের বলেছি, তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো। শুনে রাখো, সেটি কুরআনের এক তৃতয়াংশের সমান।’(সহীহ মুসলিম) অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ–লাম–সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।

১৬. রুকূ ও সিজদায় কুরআন তিলাওয়াত না করা : রুকূ ও সিজদায় তিলাওয়াত না করা। সহীহ হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘হে লোকসকল, নবুওয়াতের সুসংবাদের মধ্যে কেবল সুন্দর স্বপ্নগুলোই অবশিষ্ট আছে, যা একজন মুসলমান দেখে বা তাকে দেখানো হয়। জেনো রাখো,আমাকে রুকূ ও সিজদায় কুরআন পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। রুকূতে রবের বড়ত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করবে। আর সিজদায় বেশি বেশি দোয়ায় সচেষ্ট হবে। তবে তা কবূলের অধিক যোগ্য বিবেচিত হবে। (সহীহ মুসলিম)

এর হিকমত বা রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিল রহ. বলেন, ‘রুকূ ও সিজদা নতি প্রকাশের জায়গা। তাই নতি প্রকাশের স্থানে কুরআন না পড়া শ্রেয়। হ্যা, রুকু সিজদায় গিয়ে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করবে।

১৭. ধৈর্য্য নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা : ধৈর্য্য নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। যিনি অনায়াসে কুরআন পড়তে পারেন না তিনি আটকে আটকে ধৈর্যসহ পড়বেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কুরআন পাঠে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে সে সম্মানিত রাসূল ও পুণ্যত্মা ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে। আর যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কুরআন তিলাওয়াত করবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী লেখা হবে।’(সহীহ আল বুখারী)

অতএব কেউ যদি এই কষ্টের ওপর ধৈর্য ধরেন এবং ভালোভাবে শেখা অব্যাহত রাখেন তাহলে নিশ্চিত তিনি বিশাল প্রতিদান লাভ করবেন ইনশাআল্লাহ।

১৮.তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা। আল্লাহতায়ালা তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দনরতদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (বনি ইসরাইল–১৭ আয়াত : ১০৯)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘আমাকে তুমি তিলাওয়াত করে শুনাও।’ বললাম, আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন, ‘আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি’। অতপর আমি তাঁকে সূরা নিসা পড়ে শুনাতে লাগলাম। যখন আমি (অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর সাক্ষীরূপে? এ পৌঁছলাম, তিনি বললেন, ব্যাস, যথেষ্ট হয়েছে। তখন আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। ’(সহীহ আল বুখারী)

আরেক সাহাবী বলেন, ‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম। তিনি নামাজ পড়ছিলেন আর তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।’(আন নাসায়ী)

হযরত উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু একদিন সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি নিচের আলতে পৌঁছেন, তাঁর দুইগ– বেয়ে অশ্রুর ধারা বইতে শুরু করে। আয়াতটি ছিলো–‘সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’। ইউসূফ–১২ আয়াত : ৮৬

কাসিম একদা হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা–এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি দেখেন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু নিচের আয়াতটি বারবার আবৃত্তি করছেন আর কেঁদে কেঁদে দু‘আ করছেন। আয়াতটি হলো–‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’ (আততুর–৫২ আয়াত : ২৭)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিচের আয়াত তিলাওয়াত করেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন ‘আর মৃত্যুর যন্ত্রণা যথাযথই আসবে। যা থেকে তুমি পলায়ন করতে চাইতে’। (ক্বাফ–৫০ আয়াত : ১৯)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিচের আয়াতটি পড়তেন, তখনই তিনি কান্নাকাটি করতেন–‘আর তোমরা যদি প্রকাশ কর যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে অথবা গোপন কর, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন’। (বাকারা–২ আয়াত : ২৮৪)

তাছাড়া আমরা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু–এর কথা জানি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর যখন খলীফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলো, তখন হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী, নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে তিনি খুব বেশি কাঁদেন।’ (সহীহ ইবনে খুযাইফা) কুরআন তিলাওয়াতের সময় কান্নাকাটি করা এবং চোখে পানি আসা বিনয় ও ঈমানের লক্ষণ, যদি কান্নাটি আসে অন্তর থেকে। কান্না কিন্তু কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে : বিনয় ও ন¤্রতার কান্না, ভীতি ও আতঙ্কের কান্না, ভালোবাসা ও অনুরাগের কান্না, খুশি ও আনন্দের কান্না এবং দুঃখ ও বেদনার কান্না। মনে রাখতে হবে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় কেবল বিনয় ও ন¤্রতার কান্নাই কাম্য; কপট তথা কৃত্রিম বা লোক দেখানোর কান্না নয়। আর বিনয়ের কান্না সেটিই যা মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার করে। যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কুরআন তিলাওয়াতের সর্বোত্তম কণ্ঠ সে ব্যক্তির, যার তিলাওয়াত কেউ শুনলে মনে হয় সে কাঁদছে।’(ইবনে মাযাহ)

তবে কান্নার ভান করা দুই ধরনের। একটি প্রশংসনীয় আরেকটি নিন্দনীয়। প্রশংসনীয় কান্না হলো, যে কান্নার ভান করার দ্বারা হৃদয় বিগলিত হয়, মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় আর সঙ্গে সঙ্গে তা হয় রিল ও লৌকিকতা মুক্ত। যেমন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কান্নার কথা বলেছিলেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বদরের কয়েদিদের ব্যাপারে কাঁদতে দেখে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে অবহিত করুন কোন জিনিসের কারণে আপনি ও আপনার সাথী কাঁদছেন? সম্ভব হলে আমি কাঁদবো, নয়তো আপনাদেরদুজনের অনুকরণে কান্নার ভান করবো।’ (সহীহ মুসলিম)

দেখুন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিন্তু তাঁর এ কথা অপছন্দও করেননি। তেমনি অনেক পূর্বসুরী বুযুর্গ বলতেন, আল্লাহর ভয়ে তোমরা কাঁদো যদি কাঁদতে না পারো তাহলে কান্নার ভান করো। পক্ষান্তরে নিন্দনীয় কান্না হলো, যে কান্নার উদ্দেশ্য মানুষের প্রশংসা বা সুনাম কুড়ানো। এটি মুনাফেকদের কান্না।

আমাদের খেলল রাখতে হবে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় যেন আমাদের অন্তর ডানে–বামে ছোটাছুটি না করে। মনোযোগসহ নিবীষ্ট চিত্তে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে।

১৯. কুরআনের মর্ম নিয়ে চিন্তা করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো এর মর্ম নিয়ে চিন্তা করা। সাধারণভাবে বলতে গেলে এটিই আসলে তিলাওয়াতের সবচেড়ে গুরুত্বপূর্ণ আদব। তিলাওয়াতের সময় চিন্তা–গবেষণা করাই এর প্রকৃত সুফল বয়ে আনে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’। (সোয়াদ–৩৮ আয়াত : ২৯)

অতএব কুরআন থেকে সে–ই উপকৃত হতে পারবে যে আল্লাহতায়ালার মহান বাণী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা–ভাবনা করবে। আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব ও মহিমার কথা মনের পর্দায় ভেসে তুলবে। কুরআন তাকে কী বলছে তা বুঝার চেষ্টা করবে। এবং এ কথা মনে রাখবে যে সে এটি বুঝার জন্য এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য তিলাওয়াত করছে। তাই কেউ যদি মুখে কুরআন পড়ে আর মন পড়ে থাকে তার অন্য কোথাও, তবে সে তিলাওয়াতের কাঙ্গিত ফায়দা অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা–ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’। (মোহাম্মদ– ৪৭ আয়াত : ২৪)

হযরত ‘হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একরাতে আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামাজ পড়লাম। তিনি বাকারা শুরু করলেন। আমি মনে মনে বললাম, তিনি একশত আয়াত পড়ে রুকূ করবেন। অবশ্য তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম, তিনি দুইশত আয়াত পড়ে রুকু করবেন। কিন্তু তিনি পড়েই চললেন। মনে মনে বললাম, তিনি হয়তো এ সূরা দিয়েই একরাত পড়বেন। এরপরও তিনি পড়েই চললেন। (বাকারা শেষ করে) নিসা শুরু করলেন। নিসা পড়ে তিনি আলে–ইমরান শুরু করে তাও শেষ করলেন। তিনি মন্থর গতিতে পড়ছিলেন। তাসবীহ সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে তাসবীহ পড়েন। প্রার্থনা সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে প্রার্থনা করেন। শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত কোনো আয়াত পড়লে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তারপর তিনি রুকূতে যান।’ (আন নাসায়ী, সহীহ মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খারেজী সম্প্রদায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের গলা অতিক্রম করবে না। (সহীহ আল বুখারী)

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না।’ (আবু দাউদ)

যায়েদ বিন সাবেতকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সাত দিনে কুরআন খতম করাটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? তিনি বললেন, এটা ভালো। অবশ্য আমি এটাকে পনের দিনে বা দশ দিনে খতম করাই পছন্দ করি। আমাকে জিজ্ঞেস করো, তা কেন? তিনি বললেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। যায়েদ বললেন, যাতে আমি তার স্থানে স্থানে চিন্তা করি এবং থামি।’ (মুয়াক্তা মালেক)

আমাদের কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে হবে কেবল আমলের জন্য : ‘হযরত আবু আবদুর রহমান রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের কুরআন পড়িয়েছেন তারা বলেছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দশ আয়াত শিখতেন। তারপর আরও দশ আয়াত ততক্ষণ শিখতেন না যাবৎ তাঁরা এ কয়টি আলতে কী এলেম আছে আর কী আমল আছে, তা না জানতেন। তাঁরা বলেন, সুতরাং আমরা এলেম শিখেছি এবং আমল শিখেছি।’ (সুমনাদে আহমাদ)

যে ব্যক্তিই আল্লাহ উদ্দেশ্যে একনিষ্ঠভাবে কুরআন পাঠ করবে সেই তার সওয়াবের অধিকারী হবে। কিন্তু এই সওয়াব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে যখন হৃদয়–মন উপস্থিত রেখে আয়াতগুলোর অর্থ বুঝে গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে তা পাঠ করবে। তখন একেকটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ থেকে সত্তরগুণ; কখনও সাতশত গুণ পর্যন্ত সওয়াব দৃদ্ধি করা হবে।

২০. মাঝামাঝি সূরে কুরআন পাঠ করা : উচ্চস্বরে ও নিরবের মাঝামাঝি স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করা। সরবে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা কোনো রাসূলকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন রাসূলকে কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন।’ (আবু দাউদ, আন নাসায়ী)

অনুরূপ তিনি ইরশাদ করেছেন,‘সরবে কুরআন তিলাওয়াত প্রকাশ্য সদকাকারীর ন্যায় এবং নিরবে কুরআন তিলাওয়াত গোপনে সদকাকারীর ন্যায়।’ (আবু দাউদ)

প্রথম হাদীসে সরবে আর দ্বিতীয় হাদীসে নিরবে পড়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাহলে কীভাবে সিদ্ধান্তে আসবো? হ্যা, উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ইমাম নববী রহ. বলেন, যেখানে রিল, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙ্গানো বা নামাজরত ব্যক্তি কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেখানে নিরবে পড়া উত্তম। কারণ, নামাজী ব্যক্তির পাশে সরবে তিলাওয়াত করলে তার পড়ায় বিঘœ ঘটবে। তাছাড়া তিলাওয়াতেও ব্যাঘাত ঘটবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে নিরবে পড়াই শ্রেয়। এছাড়া অন্য সময় সরবে পড়া উত্তম। কারণ এতে স্বর উঁচু করা, কষ্ট ও চেষ্টা ব্যয় করার অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়। তদুপরি সরবে তিলাওয়াত পাঠক হৃদয়কে জাগ্রত করে। তার চিন্তাকে কুরআনের প্রতি নিবীষ্ট এবং কর্ণকে এর দিকে উৎকর্ণ করে। এর ফলে পাঠক বেশি লাভবান হন। এভাবে তা বেশি আত্মস্থ হওয়া, শয়তানকে বিতাড়ন করা, ঘুম তাড়ানো ও উদ্যম সৃষ্টিতে অধিক সহায়ক। (আল ইতকান)

হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিরবে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর উমর করতেন সরবে। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সরবে পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘সরবে পড়ে আমি শয়তানকে বিতাড়ন করি এবং ঝিমুনি তাড়াই। অতপর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু বাড়াতে আর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু কমাতে। (মুসান্নাফ)

আরেকটি কথা, ধরুন আপনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন। কিছুক্ষণ সরবে পড়ার পর একটু ক্লান্ত হয়ে গেলেন। এবার একটু আওয়াজ কমিয়ে পড়তে লাগলেন। তারপর যখন ক্লান্তি কেটে গেল তো আবার সরবে পড়া শুরু করলেন। আমাদের অনেকেরই হয়তো এমন হয় ঠিক না? জেনে রাখুন, এতে কোনো সমস্যা নেই।

২১. আদবসহ বসা : যথাসম্ভব আদবসহ বসা। বসা, দাঁড়ানো, চলমান ও হেলান দেয়া–সর্বাবস্থায় তিলাওয়াত করার অনুমতি রয়েছে। কারণ আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে’। (ইমরান–৩ আয়াত :১৯১)

তবে উদাহরণ স্বরূপ বিনয়ের সঙ্গে বসে পড়া হেলান দিয়ে পড়ার চেয়ে উত্তম। জায়েযের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনোটাতেই সমস্যা নেই। কিন্তু উত্তমের কথা বিবেচনা করলে বিনয় ও ন¤্রতার সঙ্গে বসে পড়াই শ্রেয়। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে চারজানু হয়ে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার জিকির করতেন।

২২.তিনদিনের কম সময়ে খতম না করা : কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো তিনদিনের কম সময়ে খতম না করা। কেননা আগেই উল্লেখ করেছি যে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না।’ (আবু দাউদ)

২৪. সুন্দর পোশাক পরিধান করবে।

২৫. কিবলামুখী হয়ে বসবে।

২৬. হাই উঠলে কুরআন পড়া বন্ধ করে দিবে।

২৭. বিনা প্রয়োজনে কুরআন পড়া অবস্থায় কারো সাথে কথা বলবে না।

২৮. সওয়াবের আয়াত পাঠ করলে থামবে এবং উক্ত সওয়াব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। আর শাস্তির আয়াত পাঠ করলে তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।

২৯. (পঠন ব্যতিত) কুরআনকে খুলে রাখবে না বা তার ওপরে কোনো কিছু চাপিয়ে রাখবে না।

৩০. বাজারে বা এমন স্থানে কুরআন পড়বে না যেখানে মানুষ আজেবাজে কথা–কাজে লিপ্ত।

৩১.দিন–রাতে কতটুকু কুরআন পাঠ করবে : রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ সাধারণত প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাঁদের কেউ সাতদিনের কম সময়ে সাধারণত কুরআন খতম করতেন না। বরং তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করার ব্যাপারে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

অতএব সম্মানিত পাঠকের কাছে নিবেদন, আসুন আমরা আমাদের দিনের একটি অংশ কুরআন পাঠের জন্য নির্ধারণ করি। যত ব্যস্তই থাকি না কেন ওই অংশটুকু পড়ে নিতে সচেষ্ট হই। যুক্তি হচ্ছে যে কাজ সব–সময় করা হয় তা অল্প হলেও বিচ্ছিন্নভাবে বেশি কাজ করার চেয়ে উত্তম। অবহেলা বা গাফিলতির কারণে যদি কুরআন পড়া না হয় তাহলে পরবর্তী দিন যেন আবারও পড়ার জন্য সচেষ্ট হই সকলে।

রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষ্য হচ্ছে ‘কোনো মানুষ যদি কুরআনের নির্দিষ্ট অংশ না পড়ে ই ঘুমিয়ে পড়ে তবে ফজর ও জোহর নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে যেন তা পড়ে নেয়। তাহলে তার আমলনামায় তা রাতে পড়ার মতো সওয়াব লিখে দেওয়া হবে।’ (সহীহ মুসলিম)

You may also like