Home ইসলাম ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

by admin
0 comment

ঈদ আরবী শব্দ; যার অর্থ ফিরে আসা। এমন দিনকে ঈদ বলা হয়, যেদিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দিবসে তাঁর বান্দাদের নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও বারবার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন। প্রতি বছরই মুসলমানদের জীবনের ফিরে আসে খুশির ঈদ। প্রথমটি উদযাপিত হয় দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম-সাধনার পর। যেমন রমাদানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ্ব-যিয়ারত, কুরবানীর গোশত ইত্যাদি নিয়ামাত তিনি বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এসব নিয়ামাত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফূর্তি করে থাকে। এ দুটি ঈদই হলো মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

আমরা সবাই জানি, ঈদ মানে আনন্দ; ঈদ মানে খুশি। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা যাকে আমরা বলি ঈদ-উল-ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটি আত্মত্যাগের কুরবানীর ঈদ বা ঈদ-উল-আযহা। ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় দানখয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরীবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। আমাদের দেশে ঈদের দিন দুটি খুবই জাঁকজমকের সাথে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। সবাই এ দিন যার যার সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। দরিদ্র ও গরীবরাও এ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা আনন্দের সাথে পালন করে। মুসলমানরা এ দিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে ঈদকার্ড বিনিময় একটি জনপিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তথ্যপ্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও আনন্দ-খুশি ও ঈদের আবেগ ভাগাভাগি করে থাকে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরীবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকে, যা ধর্মীয় দিক থেকে ধনীদের জন্য যা বাধ্যতামূলক। কুরবানীর গোশত গরীবদের মধ্যে বিতরণ করার মাধ্যমে তাদের ঈদের খুশিতে শরীক করে থাকেন।

ঈদ একটি ইবাদাত। আনন্দ ও ফূর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদাত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরীয়তসম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কুরআনে এসেছে, ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত; সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (ইউনুস-১০ আয়াত : ৫৮)

আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ এবং শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আমরা ঈদ উদযাপন করবো ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’ (বাকারা-২ আয়াত : ১৮৫)

ইসলামে ঈদের প্রচলন

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহর প্রতি নিয়ামাত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনাতে আগমন করলেন, তখন মদীনাবাসীদের দুটো উৎস ছিল “সিহিরজান” ও “নওরোজ” নামে। যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দুইদিনের কী তাৎপর্য আছে? মদীনাবাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা জাহেলী যুগে এ দুইদিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দুইদিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদ-উল-ফিতর।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১১৩৪) শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফূর্তির জন্য যে দু’টো দিন ছিল আল্লাহ তায়ালা  তা পরিবর্তন করে এমন দু’টো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফূর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে।

ঈদের নামাজ কোথায় পড়বো

ঈদের দিন স্রষ্টার উদ্দেশে মুসলমানগণ মাঠে জমায়েত হয়ে যে নামাজ পড়েন তাকে ঈদের নামাজ বলা হয়। ঈদের নামাজ সাধারণত ঈদগাহে পড়া হয়। ঈদগাহ হচ্ছে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারিত খোলা স্থান। এই স্থানে সাধারণত দুই ঈদ : ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহার নামাজ আদায় করা হয়। বৃষ্টি না থাকলে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়া উত্তম।

ঈদের  উদযাপন

বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে হযরত ইবনে জারীর (রা.)-র বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরী সনের ১০ মাস, শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করেছেন। আর ঈদ-উল-আযহা ইসলামী বর্ষপঞ্জির দ্বাদশ মাস জিলহজ্ব মাসের দশম দিনে উদযাপন করেছেন।

ঈদের নামাজ

ঈদের নামাজের ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদগণ ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন, হানাফী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ওয়াজিব। মালিকি ও শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং হাম্বলী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ফরজ। অনেক মনীষীর মতে, এটা ফরজে আইন এবং অনেকের মতে, এটি ফরজে কেফায়া।

মহিলাদের অংশগ্রহণ

বেশিরভাগ ইসলামী চিন্তাবিদ মহিলাদের ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে মহিলাদের ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করার হার তুলনামূলকভাবে কম।

ঈদের নামাজের সময়

সূর্য দিগন্ত থেকে আনুমানিক ২ মিটার উচ্চতায় পৌঁছালে ঈদের নামাজ পড়া হয়। জোহর এর নামাজের আগেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়। সুন্নাত হিসেবে ঈদুল ফিতরের নামাজ কিছুটা দেরি করে এবং ঈদ-উল-আযহার নামাজ দ্রুত আদায় করা হয়। ঈদুল ফিতরে ফিতরা প্রদান করতে হয়। ঈদ সকালে কিছুটা সময় পাওয়া গেলে ফিতরা আদায়ে সুবিধা হবে। অন্যদিকে ঈদ-উল-আযহায় ঈদের নামাজ সম্পন্ন করে আল্লাহর উদ্দেশে পশু কুরবানী করা হয়। সেজন্য ঈদের নামাজ যত দ্রুত সম্ভব আদায় করতে হবে। এই ব্যাপারে হাদিসে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে।

ঈদের গুরুত্ব

আমাদের জীবনে ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ এলেই আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি কেনাকাটায়। সামর্থ্যানুযায়ী চলে কেনাকাটা। বিত্তবানদের অনেকেই কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটান। অবশ্য এটা ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের সমাজে সুবিধাবঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের প্রতি আমাদের রয়েছে সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব।

অসহায় শিশুদের পার্শ্বে দাড়ানো : আসুন, এই ঈদে তাদের কথা নতুন করে ভাবি। বিশেষ করে ভেবে দেখি সুবিধাবঞ্চিত অসহায় শিশুদের কথা, যাদের কাছে একটি নতুন পোশাক অপরিসীম আনন্দের উৎস। বিত্তবানদের মধ্যে অনেকেই এ ব্যাপারে উদারহস্ত হলেও অনেকে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত। যে রাস্তা দিয়ে আমরা কেনাকাটা করতে যাই, তারই পাশে একটু সাহায্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশু। কী নির্মম নিয়তি! আমাদের মধ্যে কেউ যখন মনের খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত, তখন একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে কেউ কেউ। আমরা তাদের সারা বছরের বস্ত্রের সংকুলান হয়তো করতে পারব না, কিন্তু ঈদকে উপলক্ষ করে (যাদের সামর্থ্য আছে) অন্তত একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে তো পারি।

নিকট আতœীয়দের পার্শ্বে দাড়ানো : আমাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের মধ্যেও থাকতে পারে এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু। তাদের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের একটু সুদৃষ্টি অসংখ্য অসহায় শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাই মুসলমানদের জীবনের ঈদের তাৎপর্য অনেক। ঈদুল ফিতরের দিনে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত।

সামাজিক তাৎপর্য : ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য।

অর্থনৈতিক তাৎপর্য : সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমযান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য।

ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানবসম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ-উল-আযহা ও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের দিনে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে মানুষ অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের ফলে গোটা সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ঈদ নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখালেই বোঝা যায়; সবাই কেমন অসহনীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টিতে আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

ঈদের করণীয় বিষয়সমূহঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামাত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামাত হিসাবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদাতে পরিণত হতে পারে। নিচে করণীয়গুলো আলোচনা করা হলোÑ

১. ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবীর পাঠ করা : তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ। বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।’ (মুসতাদরাক : ১১০৬) যখন সালাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবে, তখন গুরুত্বসহকারে তাকবীর পাঠ করতে হবে।

২. ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করা : আমাদের দেশের অনেকেই ফজরের নামাজ আদায় করে না। ঈদের জন্য ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার গুরুত্বও দেয় না। অথচ ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যদি তারা ইশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারতো, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুটি নামাজের জামায়াতে শামিল হত।’ (সহীহ আল বুখারী : ৬১৫)

৩. ঈদের দিন গোসল করা : ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এদিনে সব মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। হযরত ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ (সুনানে বায়হাকী : ৫৯২০)

৪. হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া : আর ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া হলো সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘সুন্নাত হলো ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া।’ (জামে আত তিরমিযী : ৫৩৩)। উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ (সহীহ আল বুখারী : ৯৮৬)

৫. ঈদের সালাত আদায় করা : ঈদের দিনে সবচেয়ে গুর”ত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের সালাত আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দাহ সালাত আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি।’ (সহীহ বুখারী : ৯৮৯) ঈদের সালাতে মহিলাদের শামিল করানোর বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, উম্মে আতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুবলেন, ‘আমাদের রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদের ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহাতে সালাতের জন্য বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবর্তী ও গৃহবাসিনীসহ সবাইকেই। কিন্তু ঋতুবর্তী (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে; তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়া পত্যক্ষ করতে অংশ নেবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই (যা পরিধান করে আমরা ঈদের সালাতে যেতে পারি)। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরিধান করবে।’ (সহীহ মুসলিম : ২০৯৩)

৬. ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদ-উল-আযহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নাত। হযরত বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদ-উল-আযহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না।’ (জামে আত তিরমিযী : ৫৪৫)

৭. ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়; যেমন (ক) হাফেয ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন : তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’; অর্থ আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (খ) ‘ঈদ মুবারক’ ইনশাআল্লাহ। (গ) ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

৮. নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা : ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। এ দিনে সব মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামাত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দার ওপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ (সহীহ আলজামে : ১৮৮৭) হযরত ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন : ‘নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ (যাদুল মায়াদ)

৯. ঈদের খুতবা শ্রবণ করা : ঈদের খুতবা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘আমি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন : আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে।’ (সুনানে আবূ দাউদ : ১১৫৭)

১০. দোয়া ও ইস্তেগফার করা : ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক বান্দাহকে মাপ করে দেন। মুয়ারিরক আলঈজলী (রহ.) বলেন, ঈদের এই দিনে আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে এভাবে মাপ করে দেবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামায়াতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে।’ (লাতাইফুল মায়ারিফ)

১১. মুসাফাহা ও মুআনাকা করা : মুসাফাহা ও মুআনাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, ‘একদা হযরত হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুনবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলেন, তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মুআনাকা (কোলাকুলি) করলেন।’ (শারহুস সুন্নাহ)

১২. ফিতরাহ দেয়া : রমযান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্যসামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতরাহ বলা হয়ে থাকে। হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন।’ (সহীহ আল বুখারী : ১৫০৩)

১৩. এতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো : এতিমের খোঁজখবর নেয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআনে বলা হয়েছে, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, এতিম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে (সূরা আদদাহর-৭৬ আয়াত: ৮)

১৪.আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়া : ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহীহ আল বুখারী : ৬১৩৮)

১৫. প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেয়া : ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, এতিম, মিসকীন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (নিসা-৪ আয়াত : ৩৬)

১৬. মনমালিন্য দূর করা : জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনমলিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ (সহীহ মুসলিম : ৬৬৯৭)

১৭. আনন্দ প্রকাশ করা : ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যেখানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। হযরত উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুবর্ণনা করেন : ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (সহীহ আল বুখারী : ৯৫২)

ঈদে বর্জনীয় বিষয়সমূহ

ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আর আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ পালনে অনেকে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হচ্ছি, যা আমাদের বর্জন করা দরকার। ঈদে বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলোÑ

১. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা : ঈদের দিন সিয়াম পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন সিয়াম পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ (সহীহ মুসলিম : ২৭৩০)

২. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন : বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ : ৪০৩৩)

৩. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ : পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর বেশ ধারণ ও নারী পুরুষের বেশ ধারণ হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদিস থেকে জানা যায়, হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, ‘রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন।’ (আবু দাউদ : ৪০৯৯)

৪. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া : ঈদের দিনে নারীদের বেপর্দা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ [সূরা আহযাব : ৩৩] নারীগণ পর্দা পালন করে বের হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জাহান্নামবাসী দুই ধরনের লোক, যাদের আমি এখনও দেখতে পাইনি। একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আরেক দল এমন নারী যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মতো হবে, অন্যদের আকর্ষণ করবে ও অন্যরাও তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না, যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম : ৫৭০৪)

৫. গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা : ঈদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন গান বাজনাÑ যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যাভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।’ (সহীহ বুখারী : ৫৫৯০)

৬. বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করা : অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। আল কুরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে।’ (মুমিনুন-২৩ আয়াত : ০৩)

৭. জামায়াতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করা : ঈদের আনন্দে এমনভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের সালাতে অমনোযোগী।’ (আল মাউন-১০৭ আয়াত : ৪-৫); ঈমানদার বান্দাহগণ সালাত আদায়ে কোনো গাফলতি করে না। কুরআনের ঘোষণা, ‘আর যারা নিজেদের সালাতের হিফাযত করে।’ (মায়ারিজ-৭০ আয়াত : ৩৪)

৮. অবাধে নারীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ : দেখা যায়, অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকটাত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়। হযরত উকবাহ ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে।’ মদীনার আনসারদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল হে আল্লাহর রাসূল! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি উত্তরে বললেন, ‘এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু।’ (সহীহ আল বুখারী : ৫২৩২)

৯. অপচয় ও অপব্যয় করা : ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা কোনভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ (বনি ইসরাঈল-১৭ আয়াত : ২৬-২৭); আরো বলা হয়েছে, ‘এবং তোমরা খাও, পান করো এবং অপচয় করো না।’ (আরাফ-৭ আয়াত : ৩১)

১০. ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা : অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাহাবায়ে কিরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এজন্য রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদাত করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহীহ মুসলিম : ৪৫৯০)

১১. জুয়া খেলা ও আতশবাজি করা : এগুলো শরীয়তবিরোধী কাজ। আল্লাহ তায়ালা  বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (মায়িদাহ-৫ আয়াত : ৯০)

১২. মানুষকে কষ্ট দেয়া : ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আঁকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্যরা নিরাপদ।’ (সহীহ বুখারী : ৬৪৮৪)

১৩. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা : অনেকে ঈদের আনন্দে মাতওয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঈদের সালাত আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের সালাত আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।

ঈদের রাত ইবাদতের শ্রেষ্ঠ রাত

ঈদ আমাদের মাঝে আনন্দের বার্তা যেমন নিয়ে আসে, তেমনি নিয়ে আসে আল্লাহর নৈকট্যলাভের মহাসুযোগ। বিশেষত ঈদের রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ফযিলতময়। তাই ঈদের রাতে জেগে থাকা এবং ইবাদত করার গরুত্ব, মাহাত্ম্য এবং ফযিলত বহু হাদিসেই বর্ণিত হয়েছে। সেসব হাদিসের আলোকেই তোলে ধরা হলো ঈদের রাতে ইবাদতের গুরুত্ব ও ফয়িলত। যেমনÑ হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহুহতে বর্ণিত, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত জাগবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। যেদিন (হাশরের দিন) সবার অন্তর মারা যাবে, সেদিন তার অন্তর মরবে না।

১. হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুহতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পাঁচ রাত জেগে থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। পাঁচটি রাত হলো এক. জিলহজ্ব মাসের আট তারিখের রাত। দুই. জিলহজ্বের ৯ তারিখের রাত। তিন. ঈদ-উল-আযহার রাত। চার. ঈদুল ফিতরের রাত। পাঁচ. ১৫ শাবানের রাত।

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এমন পাঁচটি রাত আছে, যে রাতে কোনো দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। রাতগুলো হলো এক. জুমার রাত; দুই. রজব মাসের প্রথম রাত; তিন. শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত; চার. ঈদুল ফিতরের রাত ও পাঁচ. ঈদ-উল-আযহার রাত।

বর্ণিত হাদিসগুলোয় ঈদের রাতসহ অন্যান্য গরুত্বপূর্ণ রাতগুলোর অন্যতম। ওপরে বর্ণিত হাদিসগুলো ছাড়াও আরও অসংখ্য হাদিসে ঈদের রাতে ইবাদতের গুরুত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে দিন মানুষের অন্তর মারা যাবে, সেদিন ঈদের রাতের ইবাদতকারীর অন্তর মরবে না। হাদিসের মর্মার্থ তো এই, কেয়ামতে ভয়াবহ আজাবের সময় প্রতিটি মানুষের অন্তর যখন হাশরের ময়দানে ভয় আশঙ্কা অস্থিরতায় মৃতপ্রায় হয়ে থাকবে। মানুষের হুশ-জ্ঞান বলতে থাকবে না কিছু। ঈদের রাতে আমলকারীর হৃদয় তখনও সজীব ও সতেজ থাকবে। সেদিন তার অন্তর মারা পড়বে না। বরং থাকবে সদা প্রফুল। ঈদের রাতের আরেকটি বড় প্রাপ্তি হলো, এ রাতে দোয়া কবুল করা হয়। কোনো দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। বরং আল্লাহ তায়ালার দরবারে তা সরাসরি কবুল হয়। তাই আমরা আমাদের ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের রাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের প্রয়োজনগুলো চাইতে পারি। আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা কামনা, কবরের আজাব থেকে মুক্তি, জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই চেয়ে নিয়ে পরদিন সকালে একেবারে নিষ্পাপ মাসুম বাচ্ছার মতো পবিত্র ঈদের মাঠে আল্লাহর পুরস্কার গ্রহণ এবং প্রতিদান লাভের শ্রেষ্ঠ সুযোগ অন্য কোনো রাতে আছে কি? নেই। সুতরাং এই দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ লাভ এবং মঙ্গল কামনা করা সেইসঙ্গে কামনা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের এই তো মহাসুযোগ! ফটকা ফুটানো, আতশবাজি করা, হৈ-হুল্লোড় আর দাপাদাপিতে পার করে দেই আমাদের ঈদের রাত। অনেকে সারা রাত মার্কেটিং করে শেষ করি। কিন্তু একবারও আল্লাহর ইবাদতের কথা মনে করি না। একজন মুসলমানের এমনটি কখনও কাম্য হতে পারে না। আসুন, আমরা ফটকাবাজিতে কিংবা ঈদ-মার্কেটে নয় বরং সুন্দর, মার্জিত ও শালীন উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত করে ঈদের রাতটা পার করি।

You may also like