Home লাইফস্টাইল দুঃখই আমার জীবন সঙ্গী, বাচাও আমাকে বাচাও

দুঃখই আমার জীবন সঙ্গী, বাচাও আমাকে বাচাও

by Jafor Salah
0 comment

মেয়েলী কন্ঠে একটি আর্তচিতকার নদীর তীর থেকে ভেসে এলো। তারপরই শব্দ শোনা গেল কেউ যেন নদীতে ঝাপিয়ে পড়েছে। চৌদ্দগ্রামের শ্রেষ্ঠ ধনী মির্জা আবিদ আলীর একমাত্র সন্তান ফয়েজ। সবেমাত্র সাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
এখন যে মোটামুটি অবসর। এই সময়টুকু সে বাড়িতে বসে না থেকে ভ্রমণ ও শিকার করে সময় কাটাবার মনস্থ করলো। তার নিজের একটা ক্ষুদ্র লঞ্চ আছে । তাই লঞ্চ খানা নিয়ে সে ডাকাতিয়া নদী পথে বের হয়ে পড়ল ।
অবসর সময়টুকু প্রায়ই সে লঞ্চ নিয়ে নদীপথে ঘুরে বেড়িয়ে থাকে । শিকার করার চাইতে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করার আনন্দ পায় বেশি । অযথা পশু-পাখি হত্যার পক্ষপতি নয় সে ।
এবার প্রায় মাস খানেকের জন্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল ফয়েজ এবং ফাকে ফাকে সুযোগ সুবিধা মত পাখি শিকার করে ।
লঞ্চখানা ছোট্ট হলেও এতে নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা রয়েছে। আজ কাল পথে ঘাটে নৌ ডাকাতি হচ্ছে । যে কোন সময় নৌডাকাত বা জলদস্যূ কর্তৃক সংক্রান্ত হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সে সরকারী অনুমতি নিয়ে আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে লঞ্চখানা সজ্জিত করে নিয়েছে। ছাদের উপর ফিট রয়েছে । একটা রাশিয়ান ম্যাশিন গান, টোমাটিক। এবার বৃষ্টিগুলি আরম্ভ করতে পারলে কয়েকশত মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে। তাছাড়া রয়েছে ষ্টেনগান ও রিভলবার । একটা এক মাসের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য ও সংগ্রহ করে নিয়েছে ফয়েজ। তাই ফয়েজ একাই এই নির্জন নদীতে নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভোর বেলা থেকে ঘন্টা চারেক ও বিকেল ঘন্টা তিনেক লঞ্চ চালায় সে । বাকী সময়টুকু খাওয়া দাওয়া গোসল করে মাছ ধরে বা নদীর তীরবর্তী স্থানে পাখি শিকার করে সময় কাটায়।
সন্ধ্যার পর গল্প উপন্যাসের বই পড়ে বা আধুনিক সিনেমা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে ঠিক রাত দশটা পর্যন্ত জেগে থাকে । এরপর কেবিনের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন রাতেও ফয়েজ যথা সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

হঠাত মেয়েলী কন্ঠের আর্তচিতকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভেবে পায় না নির্জন নদী। তীরে কোন মেয়ের চিতকার কি করে আসতে পারে ? লঞ্চটা এক ক্ষণিকায় নদীর মাঝখানে। নদীর অপর পাশে দেখা যায় এক বিরাটি জলাভুমি । বহুদূর বিস্তৃত । মনে হয় যেন দুর দিগন্তে গিয়ে মিশেছে । নদীর নাম এবং আশেপাশের স্থানের নাম আগেই জেনে নিয়েছে । তাছাড়া ম্যাপ রেখেছে তার সাথে । চৌদ্দগ্রাম থানা শহরের আঠারো কিলোমিটার উত্তরে কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় তের কিলোমিটার দক্ষিণে এই ডাকাতিয়া নদী। এই নদীর দক্ষিণ পাশে ধরে ধুলা সমুদ্র নামে একটা প্রবাদ রয়েছে । এই জেলার দক্ষিন পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহাসিক কাকড়ী নদী। কাকড়ী নদীর পূর্বপাশে অবস্থিত গম্ভীর অরণ্য ভূমি। ধূল সমুদ্র জলার এক মাইলের মধ্যে কেউ সন্ধ্যার পর হাজার টাকা দিলেও যেতে রাজী হয় না।

ধূল সমুদ্র জলা সম্বন্ধে রোমাঞ্চকর বর্ণনা এখনো প্রাচীন বৃদ্ধারা তাদের নাতী নাতনিদের নিকট গল্পছলে বলে থাকে। আজ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা তখন পাহাড়-পর্বত আর জংগলে পরিপূর্ন ছিল। আর ছিল নানা হিংস্র জীব জন্তুর লীলা নিকেতন। এখানে যারা বাস করতো তাদের প্রতি মুহূর্তে নিজেদের জীবনটা বাচাবার সংগ্রাম করতে হতো । অবশ্য তখন তারা দলবদ্ধ হয়ে একত্রে বসবাস করত।
লোক মুখে শোনা যায় ধুলসমুদ্র জলার পাশে নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর এক যুবক ছিল । পাশের গ্রামের এক জমিদার কন্যার সাথে ঐ যুবকের পরিচয় হয়। এবং তাদের মাঝে গভীর ভালোবাসার জন্ম হয়। একদিন উভয়ে পরামর্শ করে গ্রাম ছেড়ে কোন দূর দেশে গিয়ে বসবাস করার পরিকল্পনা করে পালিয়ে যায়।
ছেলের পিতা ছিল গ্রামের সর্দার। সে জলার আশেপাশে পাহারা দিতে থাকে । কোথাও পালাতে হলে জলার মাঝ দিয়ে যেতে হয়। ছেলে এবং মেয়ে জলার মাঝামাঝি যখন এসে পড়ে, তখন ছেলের পক্ষের লোকজন তাদের ধরে ফেলে ।

মেয়েটিকে তারা জীবন্ত জলার মাঝে পুতে ফেলে। ছেলেটিকে তারা গ্রামে নিয়ে যায়। সেই থেকে জলার মাঝে গভীর নিশীথে মেয়েলী কন্ঠে অার্ত চিতকার শুনা যায়। কেউ কেউ নাকি প্রায়ই এক অপূর্ব সুন্দর রমণীকে ওখানে হাওয়ার ভর করে গুরে বেড়াতে দেখেছে । চাদের আলোতে নাকি দেখতে একটু ও ভুল হয়নি ।

আরো আশ্চায্যের ব্যপার হলো, মেয়েটিকে হত্যার পরদিন থেকেই প্রতিরাতে একজন তরুন পুরুষ বা যুবতীকে ওই জলার মাঝে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সব সময় নাকি মেয়েটির বিপক্ষ দলের লোকেই মারা হতো। প্রায় ১০০ জনের মতো তরুণ তরুণীর মৃত্যুতে গ্রাম বাসীগন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই থেকে জলার নাম বদলে যায়। এরপরে এই জলার নাম হয় ডাকিনী । এখন এই জলা ডাকিনী জলা মানে পরিচিত।

মেয়েলী কন্ঠের চিতকার এই নির্জন জলা প্রান্তে আর বিজন বনের নদীর ধারে কোথেকে এলো ভেবে পায় না ফয়েজ। হবে কী প্রাচীন কালের সেই প্রবাদ বাক্যটিই আজ রুপ নিয়ে ওর আশপাশে হাজির হয়েছে । কিন্তু অসম্ভব সাহস ফয়েজের । রিভলবারটা বের করে সে ছোট কেবিনের দরজাটা খুলে যেই বের হতো যাচ্ছিল অমনি এক জন অপরুপ সুন্দরী মেয়ে তাকে প্রায় টেনে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো এবং কেবিনের দরোজার ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে দাড়াল । ফয়েজ বিস্মিত । হতবাক। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে মেয়েটির মুখের দিকে । কি বলতে যাচ্ছে ফয়েজ ।
মেয়েটি ফয়েজ কে বলতে লাগল চুপ একটা কথাও নয় । ওরা আসছে । শুনতে পাবে । আপনার ঘাবড়াবার কারণ নেই । একটু নিরাপদ হলেই আমি চলে যাব ।
ওরা কারা ? কে তুমি ?
সে পরে বলবো। অাপাততঃ আমাকে বাচান। বোধ হয় আমার খোজে এখানেও এসে পড়তে পারে ।
মেয়েটির কথাই ঠিক বাহিরে বহু মানুষের কোলাহল শোনা গেল।
নৌকা নিয়ে মেয়েটির খোজে বেরিয়েছে ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে লঞ্চটার চারপাশে বেশ কয়েকটা নৌকা জড়ো হয়ে গেল। মেয়েটি নদী থেকে উঠে এসেছিল । শুতে তখন ঠক ঠক করে কাপতে আরম্ভ করল । বাহির থেকে শোরগোল আরো বেশী শুনা গেছে ।
আমাকে বাচান ব্যকুল কন্ঠ মেয়েটির।
বেশ তুমি আমার বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড় । আমি তাদের দেখছি । আস্বস্ত হলো মেয়েটি ।
এতোক্ষণে ওর মুখে মৃদুহাসি ফুটে উঠলো। ভাবলো ভয় নেই একটা পুরুষের সাহায্য সে পেয়েছে। তার সাহস আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল । নারী যতই শিক্ষিত আর শক্তিশালী হোক না কেন, যতই অর্থ আর প্রতিপত্তি থাকুক না কেন, পুরুষের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া সে অসম্পূর্ণ। অসহায়, অচল।
পুরুষ আর নারী একে অপরের পরিপূরক। একজন ছাড়া, অপরজন অসম্পূর্ণ বিশেষ করে নারী পুরুষ শক্তির সাহায্য ছাড়া এই কঠোর কঠিন নির্মল পৃথিবীতে বেছে থাকা অপারগ। নারী কোমল, নারী সুন্দর, নারী মমতাময়ী, করুনাময়ী, আর স্নেহময়ী, পৃথিবী কঠিন । জীবন ও জীবিকা অনেক কঠিন । বেচে থাকার জন্য মানুষকে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় সংগ্রাম করতে হয় তা নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। এগুলোতে হয় পুরুষকে । একদল লোক তাড়া করেছে মেয়েটিকে তার পক্ষে নিজের ক্ষমতায় বেচে যাওয়া সম্ভব নয়। খোদার তরফ থেকে ফয়েজকে নিয়েছে।

You may also like